বিইউপি’র (বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অফ প্রফেশনালস) ছাত্র আবরার আহমেদ চৌধুরি জেব্রা ক্রসিং দিয়ে রাস্তা পার হওয়ার সময় বেপরোয়া গতির গাড়ির ধাক্কায় নিহত হয়েছে। কেউ একজন আবরারের বিশ্ববিদ্যালয়ের রক্তাত্ত আইডি কার্ডটি সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমে পোষ্ট করেছে। আবরার কেবল ভালো ছাত্রই ছিল না বিভিন্ন প্রতিযোগীতায় সে মেধার স্বাক্ষর রাখতো। ঠিক এই দিনেই দেশের বিভিন্ন স্থানে আরও কয়েকজন সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে। আবরার জানতো জেব্রা ক্রসিং দিয়ে রাস্তা পার হতে হয়। কিন্তু সে জানতো না এই নিয়ম জানলেও অনেক ড্রাইভার তা মানে না। চালকের কাছে এসব নিয়ম মেনে চলার চেয়ে প্রতিযোগীতা করে আগে যাওয়া বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাতে কারও প্রাণ গেলেও তার কিছু যায় আসে না।

এ ঘটনার পর ছাত্ররা রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ জানায়। নব নির্বাচিত মেয়র তিন মাসের মধ্যে সেখানে একটি ফুটওভারব্রিজ নির্মাণ করার অঙ্গীকার করেছেন। কিন্তু তাতে কি আদৌ সমাধান হবে? অন্য কোথাও আবার দুর্ঘটনা ঘটবে। আবার কোন আবরাবের প্রাণ যাবে। বেপরোয়া গতিতে চলা যানবাহনের লাগাম টেনে ধরবে কে? ছাত্রছাত্রীরা মেয়রের কাছে লিখিত ভাবে ১২ দফা দাবী পেশ করেছেন। রাজধানীতে বাসচাপায় দুই শিক্ষার্থী মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটেছিল। বাসচালক আরেক বাসের সাথে প্রতিযোগীতা করে বাস চালাতে গিয়ে শিক্ষার্থীদের শরীরের ওপর গাড়ি তুলে দিয়েছে। যার ফলে ঘটনাস্থলেই দুজন শিক্ষার্থী মারা গিয়েছিল এবং আহত ছিল বেশ কয়েকজন। এরপর বহু ঘটনা ঘটে গেল। শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করলো। শিক্ষার্থীরা নিজেরাই রাস্তায় নেমে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল কিভাবে নিয়ম মেনে চলতে হয়। তা নিয়ে দেশের কর্তাব্যক্তিরা প্রশংসা করেছিল। শিক্ষার্থীদের সেই আন্দোলনকে ভিন্নখাতে নেয়ারও চেষ্টা করেছিল একটি মহল। ছাত্রছাত্রীর ঘাড়ে চরে নিজের ফায়দা আদায় করতে চেয়েছিল। ছাত্রছাত্রীরা তাদের সে সুযোগ দেয়নি। তারা ঠিকই ক্লাসে ফিরেছিল। তবে তাদের সেই সময়কার দাবীগুলো পূরণ হয়নি। এবারো দেখলাম একটি বাসে আগুন দেয়ার সময় ছাত্রছাত্রীরা দুবৃত্তদের হাতে নাতে আটক করে। বাসে আগুন দিয়ে ছাত্রছাত্রীর ওপর দায় চাপাতে চেয়েছিল। ছাত্রছাত্রীরা এবারো ক্লাসে ফিরবে। কিন্তু বুকে থাকবে বন্ধুকে হারানোর দগদগে ক্ষত। যে ক্ষত মুছতে কোন প্রতিশ্রুতির প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন কেবল সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানোর।সবাই অবাক হয়ে দেখলো চাইলেই পরিস্থিতির উন্নতি সম্ভব। তবে কয়েকনি পরেই পরিস্থিতি যা ছিল তাই হলো।

প্রতিদিন অসংখ্য দুর্ঘটনা ঘটছে। উন্নত দেশেও সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। কিন্তু আমাদের দেশে যেভাবে প্রতিদিন পাখির মত মানুষ সড়কে মারা যায় সেরকম কোন পরিস্থিতি হয়না। উন্নত দেশে সড়ক দুর্ঘটনা মানেই অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রাইভেট গাড়ি দুর্ঘটনার কবলে পরা। বাসও দুর্ঘটনার কবলে পরে তবে তার সংখ্যা অনেক অনেক কম। আমাদের দেশে সড়ক দুর্ঘটনা মানে বাস, ট্রাক, নসিমন এসব। গত বছর বুলগেরিয়ায় বাস দুর্ঘটনার ঘটনায় সেদেশের তিন মন্ত্রীকে বরখাস্থ করা হয়েছে। অনেকেই বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখেছেন। সেই মন্ত্রীত্রয়ও তাদের ব্যার্থতার দায় স্বীকার করে নিয়েছেন। তার অর্থ এই নয় যে আমি বলতে চাইছি আমাদের দেশেও সড়ক দুর্ঘটনার দায় নিয়ে পদত্যাগ করতে হবে। কারণ এতে আমাদের দেশের কোন সমস্যার সমাধান হবে না। সেদেশের আইন এবং তার প্রয়োগ এবং সেই সাথে সচেতনতা একরকম আর আমাদের দেশের আইন তার প্রয়োগ এবং জনগণের সচেতনার ধরন আলাদা। চাইলেই আমরা সব বদলে ফেলতে পারি না। তবে চাইলেই মনমানসিকতা বদলাতে পারি। যেমন নিজের ভুল স্বীকার করার অভ্যাস।

সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো কি অসম্ভব একটি কাজ। সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা একটি গাণিতিক হিসাব মাত্র। অনুভূতিগুলো আজ মৃত। নিরাপদ সড়ক চাই এর এক তথ্য মতে ৩ হাজার ১০৩ টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪ হাজার ৪৩৯ জন নিহত হয়েছে। গত বছর সারা দেশের সড়ক দুর্ঘটনায় সাড়ে সাত হাজার মানুষ নিহত হয়েছে এবং প্রায় ১৬ হাজার মানুষ আহত হয়েছে। । একটু বিস্তারিত তথ্যে ২০০৫ সাল থেকে দেখানো হিসেবে দেখা যায় সেবছর ৩৯৫৫ টি, ২০০৬ সালে ৩৭৯৪ টি, ২০০৭ সালে ৪৭৬৯ টি, ২০০৮ সালে ৪৮৬৯ টি, ২০০৯ সালে ৩০৫৬ টি, ২০১০ সালে ৩১০৭ টি, ২০১১ সালে ৪৯৫৯ সালে, ২০১২ সালে ৪৮১৭ টি, ২০১৩ সালে ৪৭৫৬ টি, ২০১৪ সালে ৫৯৯৭ টি, ২০১৫ সালে ৪৫৯২ টি, ২০১৬ সালে ২৯৯৮ টি সড়ক দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটেছে। এভাবে খুব অল্প সময়ের ব্যাবধানেই বাসের প্রতিযোগীতায় কারো প্রাণ যাচ্ছে, কারো পা যাচ্ছে আবার কারো বা হাত। এর আগে বাসের চিপায় শিক্ষার্থীর হাতের দৃশ্যটি আজও চোখে ভাসে। সত্যি বাসগুলোর বড় তাড়া! আগে গেলেই যাত্রী বেশি। আর বেশি যাত্রী মানে লাভ বেশি। সব কিছুতেই হিসেব। কেবল মানুষের হাত, পা বা জীবনের কোন হিসেব থাকে না। আবার কোথাও বাসের ধাক্কারয় আহত ব্যক্তিকে চিকিৎসার ব্যবস্থা না করে ছুড়ে ফেলে দেয়া হচ্ছে। যাতে সে সুস্থ হয়ে বেঁচে তাদের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপে না যায়। যেখানে চালকের অসাবধানতা, অদক্ষতা, বিপদজনক ওভারটেকিং এসব দায়ী থাকে। শুধু দুর্ঘটনা বলে দিনের পর দিন এসব মৃত্যু মেনে নেওয়া যায় না। মানুষের জীবন এত সস্তা যে অবহেলায় চাকার নিচে পিষ্ট হলেও তাকে দুর্ঘটনা বলা হচ্ছে। আমাদের দেশে যারা মহাসড়কে বা অন্যান্য সড়কে যানবাহন চালায় তারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অশিক্ষিত। গাড়ি চালানোর সঠিক সাইড, গতি নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি বিষয়গুলো জানে না বললেই চলে। আবার জানলেও আইনের ফাঁক ফোকর খুঁজে তার মার প্যাঁচে ঠিক নিজেকে বের করে নেয়। ফলে এত এত দুর্ঘটনা ঘটলেও শাস্তির খবর আসে হাতে গোণা। অথচ এর চালকের ভুলেই কিন্তু দুর্ঘটনা ঘটার হার বেশি থাকে। কিন্তু শাস্তির ক্ষেত্রে তা লঘু অপরাধে পরিণত হয়। আমাদের দেশে দুর্ঘটনা তো দুর্ঘটনাই! মানুষের জীবনের মূল্য কোথায়!

সড়ক দুর্ঘটনা শব্দটি বর্তমানে আমাদের এত বেশী শুনতে হয় যে বিষয়টা খুব বেশিক্ষণ মাথার মধ্যে থাকে না। দুর্ঘটনা শব্দটি দিয়েই প্রতিটি ঘটনাকে দাড় করানো হচ্ছে। কিন্তু কতদিন? এভাবে দায়িত্বে অবহেলাকে দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দেয়া যাবে। লক্কড় ঝক্কর মার্কা গাড়ি রং চং করে সাজিয়ে আর কতকাল প্রাণঘাতী হয়ে মহাসড়কে চলবে। এই কাজটা করতে পারলে একদিকে যেমন রাজধানীতে গাড়ীর জট কিছুটা কমবে তেমনি দুর্ঘটনার পরিমাণও কমবে। প্রতিদিন এবেলা ওবেলা যেভাবে সড়ক দুর্ঘটনার কথা আমাদের কানে তাতে কোন দুর্ঘটনার কথা কতক্ষণ মনে থাকবে। আমাদের অনুভূতিগুলো মনে হয় অনেকটাই ভোঁতা হয়ে গেছে। ইন্দ্রিয়গুলো এত সহজে আবেগে আক্রান্ত হয় না। কান্নার শক্তিও কমে গেছে। প্রতিদিন কোথাও না কোথাও বাস, ট্রাক, নসিমন-করিমন বা মটরসাইকেল বা কোন না কোন যানবাহন দুর্ঘটনায় পরবে। কখনো আলাদা আলাদা পরিবারের সদস্যের মৃত্যুর খবর আসে আবার কখনো আসে একই পরিবারের সদস্যের মারা যাওয়ার খবর। ভোঁতা হয়ে যাওয়া অনুভূতিতে মানুষের মৃত্যু আর আগের মত ভাবায় না। শুধু সাময়িক এক ধরনের যন্ত্রণা দেয়। যে যন্ত্রণায় মিশে থাকে এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের পথ খুজে না পাওয়ার ব্যার্থতার কথা। বারবার বহু আলোচনা, যুক্তি,তর্ক, বহু লেখালেখি বহু টকশো হয়েছে এই সড়ক দুর্ঘটনার উপর। কাজের কাজ কতটুকু হয়েছে।

এসব কারণের মধ্যে রয়েছে ক্রটিপূর্ণ যানবাহন, চালকের অদক্ষতা (অনেক সময়ই দেখা যায় কয়েকনি চালকের সহকারী হিসেবে কাজ করার পরপরই গাড়ি চালানোর মত ঝুঁকিপূর্ণ দায়িত্ব তুলে নেয়), ঝুঁকিপূর্ণ গাড়ি চালনা করা ( আমাদের দেশে বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই কোন রাস্তায় কত গতিতে গাড়ি চালানো উচিত সেসব নিয়ম কানুন মেনে চলার কোন বালাই নেই। যদিও সড়কের ধারেই সর্বোচ্চ গতির বিষয়টি লেখা থাকে), মহাসড়কগুলোতে আগে চালানোর প্রবণতা (সামনের গাড়ির চেয়ে আগে না গেলে যাত্রী পাওয়া যাবে না অথবা নিজেকে দক্ষ প্রমাণ করার চেষ্টা অথবা অভ্যাসবশত অনেক চালকই এটা করে থাকে। জবাবদিহিতার অভাব, অনেক সড়কে ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক বেশী থাকে, আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল না হওয়া অর্থ্যাৎ আইন জানা সত্তেও দেখা যায় তা মেনে চলার কোনই প্রয়োজন মনে করে না অনেকে, ড্রাইভিং পেশার অনুৎকর্ষতা, ক্রটিপূর্ণ ট্রাফিক সিগনাল ব্যবস্থা, বিকল্প যানবাহনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকা, বর্তমান প্রেক্ষাপটে আইন প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়নে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া এসব। আইন করা হয় নাগরিক সুরক্ষার জন্য। আর সে আইন মেনে চলা প্রতিটি নাগরিকের নৈতিক দায়িত্ব। আমি যদি মনে করি আমি না মানলে কিছুই হবে না অন্য সবাই মানবে। সেটা ভুল। নিজে মানতে হবে অন্যকে মেনে চলতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। তাকে বোঝাতে হবে কেন আইন মেনে রাস্তায় চলাচল করা উচিত।

আমরা কেউই নিয়মের বাইরে যেতে পারি না। ঢাকা শহরে ওভারব্রীজ থাকতেও মারাত্বক ঝুঁকি নিয়ে চলন্ত গাড়ির সামনে দিয়ে হেঁটে রাস্তা পার হচ্ছে প্রতিদিন। একটু এদিক সেদিক হলে যে রক্ষা নেই তাও কিন্তু জানি। এই কাজ যে ঠিক না এটাও কিন্তু জানি। কিন্তু মানি না। দুর্ঘটনা ঘটে যাবার পর সাময়িকভাবে বোধ জাগ্রত হয়। মনে হয় কাল থেকে এটা আর করবো না। কিন্তু কাল আসার পর আর মনে থাকে না। আবার সেই পুর্বদিনের ঘটনারই পুনরাবৃত্তি করেই বাড়ি ফিরি। সড়ক দুর্ঘটনার কারণগুলো কিন্তু আমরা প্রায় সবাই জানি। সড়ক মহাসড়কে ক্রটি ও বিপদজনক মোড়গুলো কমিয়ে আনা, লাইসেন্সবিহীন সহকারীদের হাতে স্টিয়ারিং তুলে দেওয়া থেকে বিরত থাকা, চালকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, সচেতনামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করা, আইনের আধুনিকায়ন করা ইত্যাদি অনেক কার্যক্রম হাতে নেওয়া যেতে পারে। তবে সব কথার বড় কথা নিজেকে তৈরি করা। যাত্রী হিসেবে আমি যেমন রাস্তায় চলাচলের আইন মানতে বাধ্য ঠিক তেমনি একজন চালক হিসেবেও যেন কেউ আইন সঠিকভাবে মেনে চলে। উন্নত বিশ্ব যদি সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে পারে তাহলে আমরা পারবো না কেন? দুর্ঘটনা ঘটার পর কার দোষ ছিল কার দোষ ছিল না এসব না ভেবে দুর্ঘটনা যাতে না ঘটে সেটা চিন্তা করাই ভাল। কারণ দুর্ঘটনা ঘটার পর সেই দায় আর কেউ নিতে চায় না। চালকদের প্রয়োজনীয় ও পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা জরুরী। নতুন আইন দুর্ঘটনা রোধে কতটা সুফল বয়ে আনবে তা সময়ই বলে দেবে। তবে শিক্ষাগত যোগ্যতার বিষয়টি নিঃসন্দেহে প্রয়োজন ছিল। সবচেয়ে বড় কথা হলো আইনের পাশাপাশি নিজেদের আইন মেনে চলার অভ্যাসটাও করতে হবে। আমাদের দেশটা বুলগেরিয়া নয়। এদেশে প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে। সহসাই এই হার কমবে বলেও মনে হয় না। আমরা কারো পদত্যাগ বা বরখাস্থ চাই না। চাই সমাধান। আবরার আহমেদের মত কারও প্রাণ অকালে ঝরে যাক তা বন্ধ হোক।

লেখক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট  (পাবনা)।

আমাদের বাণী-আ.আ.হ/মৃধা

[wpdevart_like_box profile_id=”https://www.facebook.com/amaderbanicom-284130558933259/” connections=”show” width=”300″ height=”550″ header=”small” cover_photo=”show” locale=”en_US”]

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।