ঢাকাঃ সরকারি প্রশাসনের নবীন কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘কোনো মানুষকে অবহেলার চোখে দেখবেন না বা তাদেরকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করবেন না। মানুষকে মানুষ হিসেবে সম্মান দিতে হবে।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার মতো দেশটাকে উন্নত করার জন্য আমরা উপযুক্ত কর্মচারি গড়ে তুলতে চাই, মানুষ যেন ন্যায়বিচার পায়। প্রশাসনের সেবা পায়। নিজেদের ভাগ্য নিজেরা গড়ার সুযোগ পায়।’

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৃহস্পতিবার দুপুরে ১১৬, ১১৭ ও ১১৮তম আইন ও প্রশাসন কোর্সের সমাপনী এবং সনদ বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে এসব বলেন।

প্রধানমন্ত্রী গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে শাহবাগের বিসিএস প্রশাসন একাডেমি মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত মূল অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি অংশগ্রহণ করেন।

প্রধানমন্ত্রী এ সময় ১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সরকারি কর্মচারিদের উদ্দেশ্যে দেওয়া জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণের উদ্ধৃতি দেন।

জাতির পিতা বলেছিলেন, ‘আপনি চাকরি করেন, আপনার মাইনে দেয় এ গরীব কৃষক। আপনার মাইনে দেয় ঐ গরীব শ্রমিক। আপনার সংসার চলে ঐ টাকায়। আমি গাড়ি চড়ি ওই টাকায়। ওদের সম্মান করে কথা বলুন, ইজ্জত করে কথা বলুন। ওরাই মালিক।’

শেখ হাসিনা স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘আমরা ছোটবেলা থেকে শিখেছি, রিকশাওয়ালাকে আপনি বলে সম্বোধন করেছি। কারণ, আমাদের বাবা-মা সেটাই শিখিয়েছিলেন।’

তিনি বলেন, ‘প্রত্যেকেরই অবদান রয়েছে এই সমাজের প্রতি। প্রত্যেকের অবদান রয়েছে দেশের প্রতি। সে কথাটা মনে রাখতে হবে। তা ছাড়া, কর্মক্ষেত্রে সবাই যেন ন্যায়বিচার পায়, সেদিকে বিশেষভাবে দৃষ্টি দিতে হবে। কারণ, আপনাদের দায়িত্ব হচ্ছে মানুষের সেবা করা।’

সরকার প্রধান আরো বলেন, ‘সমাজে যেসব উপসর্গ মাঝে মাঝে দেখা দেয়, যেমন-নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, কিশোর গ্যাং সৃষ্টি, মাদক, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, দুর্নীতি এসবের বিরুদ্ধেও আপনাদের যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। সেখানে কারো মুখ চেয়ে নয়, যারাই অপরাধী, অপরাধীকে অপরাধী হিসেবেই দেখবেন, এটাই আমার কথা।’

তিনি যোগ করেন, ‘অপরাধী যে দলের হোক বা যে কেউ হোক না কেন, অপরাধীকে অপরাধী হিসেবে দেখে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে সমাজটাকে সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে হবে। সেটাই আপনারা করবেন, আমরা চাই।’

জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন অনুষ্ঠানে সভাপত্বি করেন। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব শেখ ইউসুফ হারুন স্বাগত বক্তৃতা করেন। একাডেমির রেক্টর বদরুন নেছা কোর্সের ফলাফল প্রধানমন্ত্রীর কাছে উপস্থাপন করেন।

এ বছরের ৫ জানুয়ারি শুরু হওয়া ৫ মাসব্যাপী এবারের কোর্স করোনা বিভ্রাটে পড়ে বিলম্বিত হয় এবং অনলাইন এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির মাধ্যমে সমাপ্ত হয়। ১১৬ জন অংশগ্রহণকারীর সবাই কৃতকার্য হয়েছেন। এদের মধ্যে ৭০ জন পুরুষ এবং ৪৬ জন নারী রয়েছেন। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী তিনজন শিক্ষার্থীর হাতে রেক্টর’স পদক তুলে দেন।

প্রধানমন্ত্রী সনদ প্রাপ্ত কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আপনারা এই করোনাকালীন অবস্থার মধ্যেও প্রশিক্ষণ নিয়েছেন এবং সাফল্য অর্জন করেছেন। কাজেই, আপনাদের এই অর্জিত জ্ঞান আপনারা দেশের কাজে অবশ্যই লাগাবেন। কেননা, দেশটাকে আমরা উন্নত সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। সেটা মনে রাখতে হবে।’




‘করোনাকালীন স্বাস্থ্যবিধি মেনে কোর্স সম্পন্ন করতে পারায় শিক্ষার্থীরা অনন্য নজীর স্থাপন করেছেন,’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, আপনারা কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করছেন একটি অস্বাভাবিক অবস্থায়। সেখানে স্বাস্থ্যবিধি আপনারা যেমন মেনে চলবেন, আপনার সহকর্মী এবং দেশবাসী যেন মেনে চলে এবং আপনার কর্মস্থলে যেন সকলে মেনে চলে এই বিষয়ে আপনাদের যথেষ্ট সচেতন থাকতে হবে।

তিনি বলেন, করোনাভাইরাস আমাদের জীবন এবং বিশ্বকে স্থবির করে দিয়েছে, অনেককে আমরা হারিয়েছি। তাই, এটা যেন আর বিস্তার লাভ করতে না পারে সে জন্য যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে আপনারা চলবেন। কারণ, দ্বিতীয় পর্যায়ের যে ঢেউটা আসছে সেটা কেমন হবে আমরা জানি না।

‘অনেক দেশ পুনরায় লকডাউনে চলে গেছে,’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমরা এখনও সহনশীল অবস্থায় আছি। কিন্তু খুব সাবধানে চলতে হবে। ভ্যাকসিনের জন্য আমরা বুকিং দিয়ে রেখেছি যখনই শুরু হবে তখনই বাংলাদেশ আনতে পারবে।’

করোনার সেকেন্ড ওয়েভ মোকাবেলায় সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণে তিনি সরকারের সব পর্যায়ে ইতিমধ্যে নির্দেশনা প্রদান করেছেন উল্লেখ করে বলেন, ‘ভ্যাকসিন সংগ্রহ, রাখা এবং এর প্রয়োগ করার পর কি কি করতে হবে এ ব্যাপারে সবরকমের নির্দেশনা আমার দেওয়া আছে। সেটা মেনেই আমাদের এই অবস্থার উত্তোরণ ঘটাতে হবে।’

করোনার মধ্যেও সরকার গৃহীত প্রকল্পগুলো যেমন নিয়ম মত এবং মানসম্পন্ন হয় সে বিষয়গুলো লক্ষ্য রাখার জন্য তিনি সবাইকে বিশেষভাবে অনুরোধ করেন।

তিনি নবীন কর্মকর্তাদের সর্বাঙ্গীন কল্যাণ কামনা করে বলেন, ‘আপনারা দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশের মানুষকে ভালবেসে কাজ করবেন। এই মনভাব নিয়েই আপনাদের কর্মক্ষেত্রে দায়িত্ব পালন করে সাফল্য অর্জন করুন।’

তার সরকার যে দেশের উন্নয়ন করতে পারে সেটা প্রমাণ করেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০০৯ সাল থেকে সরকারে থাকায় আজকে ডিজিটাল বাংলাদেশ হয়েছে। প্রবৃদ্ধি ৮ ভাগের ওপরে অর্জনের যে লক্ষ্য নিয়েছিলাম, তা পূরণ করতে সক্ষম হলেও করোনার কারণে আমরা পিছিয়ে গিয়েছি।

তিনি বলেন, ‘বিশ্বের অনেক উন্নত দেশের প্রবৃদ্ধি যেখানে ঋণাত্মক ধারায় চলে গিয়েছে সেখানে আমরা ৫ দশমিক ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পেরেছি।’

তিনি করোনা মোকাবেলায় তার সরকারের দেওয়া প্রণোদনা, নগদ অর্থ সাহায্য এবং মানুষের দ্বারে খাবার পৌঁছে দেওয়ার প্রচেষ্টার উল্লেখ করে বলেন, ‘মানুষের জীবনযাত্রা যাতে সচল থাকে এজন্য করোনার মধ্যেও আমরা যথাযথ প্রচেষ্টা চালিয়েছি।’

দেশকে জানতে হলে, দেশের উন্নতি করতে হলে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চিন্তা-ভাবনা সকলকে জানার প্রচেষ্টা গ্রহণে তিনি প্রশাসনের নবীন কর্মকর্তাদের জাতির পিতার রচিত ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘কারাগারের রোজনামচা’, পাকিস্তান ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের জাতির পিতাকে নিয়ে করা প্রতিবেদন থেকে প্রকাশিত বই এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রসিডিংস নিয়ে প্রকাশিত বইটি পড়ে দেখার আহ্বান জানান।

তিনি বলেন, ‘এর মাধ্যমে আমার মনে হয়, আপনারা জাতির পিতার চিন্তা-চেতনা, দর্শন এবং তখকার বিশ্ব পরিস্থিতি এবং নিজের দেশ সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারবেন। আমি মনে করি, এটা আপনাদের চলার ক্ষেত্রে যথেষ্ট উপযোগী হবে।’

সরকারের প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি অর্জন করেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘একটি দেশকে উন্নয়নশীল করে গড়ে তুলতে যা যা করণীয় তার সবই আমরা করতে পেরেছি। এটা আমাদের ধরে রাখতে হবে।’

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।