ছেলেমেয়েদের, বিশেষত শিশু, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে অধ্যয়নরতদের জন্য স্কুলব্যাগ নিয়ে স্কুলে যাওয়া আনন্দের ব্যাপারই বটে। কিন্তু সেটা আর আনন্দময় থাকে না বিদ্যালোভী অভিভাবক ও স্কুল কর্তৃপক্ষের কারণে। তারা সকল শিশুকেই ‘আইনস্টাইন’ বানাতে চায়। ফলে বিদ্যাশিক্ষা শিশুর স্বভাব ধ্বংসকারী বোঝা হয়ে ওঠে। স্কুলব্যাগের বোঝাকে কেবল শারীরিক ক্লেশ দিয়ে বুঝালেই চলবে না। ওজনদার পাঠ্যবইয়ের বোঝা কেবল বহন করা নয়, পড়তেও হয়; বাড়িতে ফিরে ঘাড়মুখ গুঁজে একগাদা হোমওয়ার্কও করতে হয়। অর্থাত্, শুষ্কজ্ঞানের বোঝাও তাদের বয়ে চলতে হয়। ফলে জগিবিচ্ছিন্ন কলুর বলদের মতো তারা শারীরিক ও মানসিক উভয়বিধ যন্ত্রণাতেই কাতর হতে থাকে।

পরিণতিতে, বড় হয়েও তারা বহির্জগতে একা চলতে অক্ষম থেকে যায়। এরূপ কৃত্রিম জ্ঞানবিদ্যাচর্চা নিয়ে সারাবিশ্বে সমালোচনা চলছে। ইউরোপে আজকাল কৃত্রিম স্কুলের বিপরীতে প্রাকৃতিক স্কুল ধারণা ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। আশার কথা হলো, বইয়ের বোঝা কমাতে সরকার নানা আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করে চললেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। ঠিক “কাজীর গরু কাগজে আছে গোয়ালে নেই” এর মতো অবস্থা।অর্থ্যাত মাঠ পর্যায়ে নেই সেই আইনের কোন বাস্তবভিত্তিক প্রয়োগ। আমরা আশা করি, শিশুশিক্ষা যতটা পারা যায় প্রাকৃতিক ও স্বাভাবিক রাখতেও সকলে তত্পর থাকবেন।

১৪ই জানুয়ারি ২০১৭ সালে উচ্চ আদালত থেকে একটি দিকনির্দেশনা পাওয়া গেছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়া শিক্ষার্থীর শরীরের ওজনের ১০ শতাংশের বেশি ভারী ব্যাগ বহন করা যাবে না বলে রায় দিয়েছেন আদালত। হাইকোর্টের এই রায় দেশের লাখ লাখ শিশুকে বাড়তি বইয়ের বোঝা থেকে মুক্তি দেবে। আনন্দদায়ক হয়ে উঠবে শিশুর শিক্ষাজীবন। শুধু বইয়ে মুখ গুঁজে নয়, হাসি-আনন্দ-খেলার ভেতর দিয়ে বিকশিত হবে শিশুরা এমনটাই ভেবেছিলাম আমরা।কিন্তু বাস্তবে সেটি আর মাঠপর্যায়ে প্রতিফলিত হতে দেখছি না। বাড়তি বই, ক্লাসে বাড়তি সময় উপস্থিতি ও বাড়িতে কিংবা ব্যাচে টিউশন করতে গিয়ে কত শিশু যে শৈশবের আনন্দ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তার কোনো হিসেব নেই। ভাব দেখে মনে হবে, যত বড় স্কুল তত বড় ব্যাগ। সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা, অনেক অভিভাবকেরও এমন ধারণা যে, সন্তানের বোঝা যত ভারী হয়, শিক্ষাও বোধহয় সে অনুপাতেই বেশি হয়।

উদাহরণ হিসেবে বলি; কয়েকদিন আগে একটা কিল্ডার গার্টেন স্কুলে গিয়েছিলাম শিক্ষার্থীদের অন্যকিছু শেখাবো বলে।সেখানে গিয়ে দেখলাম স্কুল ব্যাগের একেকটা পাহাড়সম সাইজ আর পাশে বাঁশে লম্বালম্বিভাবে ঝুলানো কিছু শপিং ব্যাগ।সেই বাঁশের ক্লিপে লাল,নীল,হলুদ সহ নানা রঙের অগণিত শপিং ব্যাগ ঝুলছে।আর ব্রেঞ্চের উপর তিল পরিমান জায়গা অবশিষ্ট নেই শুধু স্কুল ব্যাগ ছাড়া।শিক্ষার্থীদের জিজ্ঞেস করলাম এতো বই কেন আর বাঁশেই  ঝুলানো এসব কি? ওদের উত্তরে যা বুঝলাম তাতে বইয়ের পরিমাণ এতো বেশি যে স্কুল ব্যাগে জায়গা হয়না বিধায় বাড়তি শপিং ব্যাগে সেগুলো তাদের আনতে হয় আর ব্রেঞ্চে জায়গা সংকুলান না হওয়ায় সেগুলো বাঁশের সাথে ঝুলানো হয়েছে।ব্যাগ গুলো উল্টিয়ে দেখি সবই গাইড বই আর খাতায় ঠাঁসা। জিজ্ঞেস করলাম মূল বই কই যেগুলো তোমাদের জন্য নির্ধারিত।স্যার ওগুলো তো পড়ানো হয়না।তাই ওগুলো আনি না,স্যাররা গাইড দেখেই পড়ান।(সরকার বছরের শুরুতেই কোটি কোটি টাকা খরচ করে শিক্ষার্থীদের হাতে বিনামূল্য বই তুলে দিচ্ছে কি ওগুলো বাড়িতে আলমেরি বন্দি করে রাখতে)ওদের শুধু একটি কথাই বলেছি গাইড বই যদি ক্লাসে পড়তে হয় তবে আর ক্লাসে শিক্ষকের প্রয়োজন কি? শুধু বইয়ের বোঝাই নয় ওরা পরিক্ষার ভয়েও আতঙ্কিত।স্যার সামনে পরিক্ষা আছে তাই আমরা এসবে আর সময় দিতে পারবো না।বাসা থেকে বলে দিয়েছে এসবে যেন না যাই এখন।বললাম কিসের পরিক্ষা এখন? (কেননা সবে বছরের ৩ মাস চলছে) স্যার সামনে মডেল টেস্ট,আবার পিএসসি পরিক্ষা আছে।বললাম পিএসসি পরিক্ষার তো এখনো অনেক দেরি আছে।না স্যার বাসা থেকে বলে দিয়েছে এখন থেকে ভালো প্রস্তুতি না নিলে গোল্ডেন এ প্লাস পাবো না।বছরের শুরুতেই যদি একজন শিশুকে এভাবে পরিক্ষার ভয়ে আতঙ্কিত থাকতে হয় তবে তার মানসিক বিকাশ কিভাবে বিকশিত হবে সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ। শিশুকে যেন বাড়তি বইয়ের বোঝা বইতে না হয়, এর আগে এ ব্যাপারে নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। সরকারের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে একটি পরিপত্রও জারি করা হয় ২০১৪ সালে। যেখানে স্পষ্ট করে বলা আছে, শিশুরা যে ব্যাগ বহন করবে তার ওজন শিক্ষার্থীর ওজনের এক-দশমাংশের বেশি নয়। অনুমোদিত বই, উপকরণ ব্যতীত অন্য কিছু ব্যাগে করে স্কুলে যাওয়া নিরুৎসাহ করার কথাও ওই পরিপত্রে বলা ছিল। কিন্তু আমাদের দেশের স্কুলগুলো কি সেই নির্দেশনা মানছে? একজন মানুষের হাড়ের গঠন সম্পূর্ণ হতে সময় নেয় ১৮ বছর। অসম্পূর্ণ গঠনের কারণে শিশুদের হাড় ও মেরুদণ্ড থাকে অত্যন্ত নরম। ফলে ভারী ওজনের চাপ সহ্য করা শিশুদের মেরুদণ্ডের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে। এ কারণে ভারী স্কুল্ব্যাগের প্রভাবে শিশুদের ভুগতে হয় ঘাড় ও পিঠে ব্যথার মতো হাড় ও মাংসপেশির সমস্যায়। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, কাঁধে ভারী স্কুলব্যাগ বহনকারীদের মধ্যে ৬০ শতাংশেরও বেশি শিশুকে মেরুদণ্ড ও মাংসপেশির সমস্যা, কুঁজোভাবসহ ঘাড়ের ব্যথায় ভুগতে হয়।

সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো বাদ দিলে দেশের সব প্রাথমিক ও প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয় চলে নিজেদের তৈরি সিলেবাসে। সেখানে বোর্ডের বইয়ের বাইরে একাধিক বই অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আছে স্কুলের বাড়তি উপার্জনের ব্যবস্থা হিসেবে প্রতিটি বিষয়ের ওপর আলাদা আলাদা খাতা। ‘যত বই তত ভালো লেখাপড়া’—এটাই যেন কোনো কোনো স্কুলের মানদণ্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাঠ্য বইয়ের বাইরে অতিরিক্ত বই পড়ানোর বাণিজ্যিক সুবিধাও নিচ্ছে অনেক স্কুল। এই ভয়ংকর প্রবণতা শিশুদের ভবিষ্যৎ ধ্বংস করে দিচ্ছে। যে বয়সে খেলার ভেতর দিয়ে শিক্ষার আনন্দদায়ক পাঠ নেওয়ার কথা, সে বয়সে একটি শিশুকে টানতে হয় বই-খাতার বোঝা আর সাথে থাকে পরিক্ষাভীতি।শিশুদের পরিক্ষার চাপ কমানো ও তাদের মনোজগৎ সুন্দরভাবে গঠনের জন্য কয়দিন আগেই প্রধানমন্ত্রী প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি পরিক্ষা গ্রহন না করার একটা নির্দেশনা দেন।

গতকাল সংবাদপত্রে দেখলাম সেই নির্দেশনা মোতাবেক তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোন পরিক্ষা না নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।এমন সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই সেই সাথে অন্তত অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পরিক্ষামুক্ত শিক্ষা ব্যাবস্থা রাখা যায় কিনা সেটাও ভেবে দেখার অনুরোধ করবো।কেননা চিকিৎসাবিজ্ঞান মতে, এই পরিক্ষাভীতির কারনে শিক্ষার্থীরা দীর্ঘস্থায়ী শারীরিক ক্ষতির শিকার হয়। লেখাপড়ার চাপ শৈশবের প্রারম্ভেই তার মনোজগতে যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে তাতে তার ভবিষ্যতের শিক্ষাও বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে না এলে আগামী প্রজন্ম একটি বড় ক্ষতির সম্মুখীন হবে। আগামী প্রজন্ম ও দেশের ভবিষ্যতের স্বার্থে শিক্ষাকে শিশুদের জন্য আনন্দদায়ক করতেই হবে।

লেখক, চেয়ারম্যান-আলোর প্রদীপ

আমাদের বাণী-আ.আ.হ/মৃধা

[wpdevart_like_box profile_id=”https://www.facebook.com/amaderbanicom-284130558933259/” connections=”show” width=”300″ height=”550″ header=”small” cover_photo=”show” locale=”en_US”]

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।