আন্তর্জাতিক ব্যবসা সাময়িকী ‘ফোর্বস’ এর সিঙ্গাপুরের শীর্ষ ধনীদের তালিকায় সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আজিজ খান সিঙ্গাপুরের শীর্ষ ৫০ ধনীর তালিকায় ৩৪তম অবস্থানে এসেছেন।

আর এর মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রথম ডলার বিলিওনিয়ার, অর্থাৎ ডলারের হিসেবে তিনিই দেশের প্রথম ‘শত কোটিপতি’।

বিবিসি বাংলার প্রতিবেদনে উঠে এসেছে কিভাবে আজিজ খান এই অবস্থানে পৌঁছালেন? তার প্রতিষ্ঠানে মূল ব্যবসা-বাণিজ্যই বা কী?

স্বাধীনতা পরবর্তী অস্থির এক সময়ে চারিদিকে নানা বিশৃঙ্খলা চলছিল সেসময় খুব কম মানুষের মধ্যেই ব্যবসা-বাণিজ্যের ঝোঁক ছিল। মুহাম্মদ আজিজ খান তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। সেই ছাত্র অবস্থাতেই আরও কিছু বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে ঝুঁকে পড়লেন ব্যবসার দিকে।

মুহাম্মদ আজিজ খান বলেন, ‘আমি ব্যবসা শুরু করি ১৯৭৩ সালে পুরোনো ঢাকায়। বাবার কাছ থেকে তিরিশ হাজার টাকা নিয়ে শুরু করেছিলাম। মাত্র এক বছরের মধ্যেই ব্যবসা করে সেই টাকা বাবাকে ফেরত দেই। তাই আমি অনেক সময় মজা করে বলি যে আমি ক্যাপিটাল বা পুঁজি ছাড়াই ব্যবসা করে আজকের পর্যায়ে এসেছি।’

পুরান ঢাকায় আজিজ খানের প্রথম ব্যবসা ছিল পিভিসি সামগ্রীর।

আজিজ খান বলেন, ‘আমার ব্যবসায়িক পার্টনার আগে থেকেই ব্যবসায় ছিলেন। পুরোনো ঢাকার চকবাজারে গিয়ে ব্যবসা শুরু করি। সেখানে পিভিসি বা পলি ভিনাইল ক্লোরাইডের ব্যবসায় নামি। এরপর একসময় চিটাগুড়ের ব্যবসাও করেছি। বাংলাদেশ থেকে আমিই প্রথম চিটাগুড় রফতানি করি।’

তখন আজিজ খান দিনে ব্যবসা করেন, আর রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসা প্রশাসন ইনষ্টিটিউটে এমবিএর কোর্স করেন। এভাবে ব্যবসা আর পড়ালেখা- দুটিই পাশাপাশি চলতে থাকে।

তিনি বলেন, ‘পুরনো ঢাকায় যাদের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য করতাম, তাদের কাছ থেকে অনেক সাহায্য পেয়েছি। বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোও আমাকে যথেষ্ট সাহায্য করেছে। প্রথম শুরু করেছিলাম ট্রেডিং দিয়ে। তারপর ইনফ্রাস্ট্রাকচারে যাই। সেখান থেকেই ব্যবসা করতে করতে আজকের অবস্থানে পৌঁছেছি।’

ফোর্বস তার সম্পদের যে হিসেবে দিয়েছে সেটা কি সঠিক? হিসেবটা কমবেশি ঠিকই আছে বলে মনে করেন তিনি।

আজিজ খান বলেন, ‘ফোর্বস ম্যাগাজিন যেভাবে আমাদের মূল্যায়ন করেছেন, সেটা তাদের সিস্টেমে তারা করেছেন। আমরা এখনো সিঙ্গাপুরের বাজারে তালিকাভুক্ত নই। যদি হতাম, তাহলে আমাদের ইকুইটির বাজার মূল্য হতে এক দশমিক দুই বিলিয়ন ডলার। সেটাকেই তারা হয়তো নয়শো দশ মিলিয়ন ডলার হিসেব করেছে।’

‘আমরা মনে করি এই মূল্যায়ন ঠিকই আছে। এটা কিন্তু আমার মূল্যায়ন নয়। এটা আমাদের পরিবারের মূল্যায়ন। পরিবারে আমার ভাই-বোনরা আছেন, মেয়েরা আছেন। ভাইদের মধ্যে অবশ্য ফারুক খান, ফিরোজ খান এবং ইমরান খান আমাদের ব্যবসায় নেই।’

সামিট গ্রুপের এই যে বিশাল ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য, কী কী আছে তাতে? কোন কোন খাতে তারা ব্যবসা করছেন? এই প্রশ্নের উত্তরে আজিজ খান বলেন, ‘মূলত বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ও বন্দর খাতে এবং ইন্টারনেট যোগাযোগের মূল কাঠামো ফাইবার অপটিক খাতেই আমাদের বিনিয়োগ। এছাড়া বাংলাদেশে হোটেল খাতে, এবং শপিং মলেও আমরা বিনিয়োগ করছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশে আমাদের এক দশমিক পাঁচ বিলিয়ন ডলার, অর্থাৎ বারো হাজার হতে তের হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ আছে।আগামী তিন চার বছরে আরও ২৫ হাজার কোটি টাকা আমরা বিনিয়োগ করতে পারবো।’

বাংলাদেশে এখন যত বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়, তার প্রায় পনের শতাংশ আসে সামিট গ্রুপের বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে। সামিট বাংলাদেশের বেসরকারি খাতের সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী।

এ বিষয়ে আজিজ খান বলেন, ‘এই মূহুর্তে আমাদের মোট উৎপাদন ক্ষমতায় এক হাজার নয়শো পঞ্চাশ মেগাওয়াট। আরও ৫৮০ মেগাওয়াটের কাজ চলছে। ২০২০ বা ২০২১ সাল নাগাদ শেষ হবে। পাইপলাইনে আছে আরও ২৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প। এর পাশাপাশি কাজ চলছে একটি এলএনজি টার্মিনালের।’

বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতে সামিট গ্রুপ যে এত বেশি ব্যবসা বাণিজ্য করছে সেটা সরকারের সঙ্গে তাদের রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠতার কারণেই সম্ভব বলে অনেকে মনে করেন। মুহাম্মদ আজিজ খানের একজন ভাই অবসরপ্রাপ্ত কর্ণেল ফারুক খান আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা এবং সরকারের একজন সাবেক মন্ত্রী।

আজিজ খান অবশ্য দৃঢ়তার সাথে একথা অস্বীকার করলেন যে সরকারের কাছ থেকে তারা কোন অন্যায্য সুবিধা নিয়েছেন।

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের সব সরকারের সঙ্গে আমাদের সুসম্পর্ক ছিল। বর্তমানেও খুব ভালো সম্পর্ক। আমরা বিদ্যুৎ উৎপাদন করছি ১৯৯৮ সাল হতে। তখন থেকে যত সরকার এসেছে, সবার সঙ্গেই আমাদের ভালো সম্পর্ক। কোন সরকারের সময় কমবেশি বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়েছে। কোন সরকারের সময় বেড়েছে, কোন সরকারের সময় কমেছে। কিন্তু আনুপাতিক হারে আমরা সবসময় ১৫-২০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত ছিলাম।’

তার মতে, ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর তারা বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিকে বিশেষ মনোযোগ দেয়। সেটারই সুফল পেয়েছেন তারা।

সামিট গ্রুপের অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সিঙ্গাপুরের শেয়ার বাজারে তালিকাভুক্ত করার প্রক্রিয়া চলছে। আজিজ খান নিজেও স্থায়ীভাবে সিঙ্গাপুরেই থাকেন।

কেন তিনি সিঙ্গাপুরকে তার ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্র হিসেবে বেছে নিয়েছেন? এর উত্তরে আজিজ খান বলেন, ‘দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার ফাইন্যান্সিয়াল ক্যাপিটাল কিন্তু সিঙ্গাপুর। তাদের ক্রেডিট রেটিং খুব ভালো। সেখানে কোম্পানি খুললে আমার ব্যবসার জন্য অর্থ সংগ্রহ করা সহজ। বাংলাদেশের তুলনায় সিঙ্গাপুরে ব্যাংক ঋণের সুদ অনেক কম। বাংলাদেশে যদি সুদের হার হয় ছয় শতাংশ, সিঙ্গাপুরে সেটা চার শতাংশ। আমাদের ব্যবসাটা ক্যাপিটাল ইনটেনসিভ। যেখানে বিলিয়ন ডলার ইনভেস্টমেন্ট, সেখানে কিন্তু এই দুই শতাংশ বিরাট ব্যাপার। এই দুই শতাংশ কম হারে যে আমরা ঋণ পাই, সেটার কারণেই আমরা সর্বনিম্ন দরে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারি।’আ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।