‘ঢাকা প্রেমিয়ার লীগও এর থেকে ভালোভাবে হয়’- বাংলাদেশ প্রেমিয়ার লীগ শুরুর ঠিক দুই দিন আগে এই টুর্নামেন্টের সবচেয়ে বড় তারকা সাকিব আল হাসানের এমন এক মন্তব্যে তোলপাড় পড়ে গেছে বিপিএলের মান নিয়ে।
সাকিব বলেছেন, ক্যারিবিয়ান প্রেমিয়ার লীগ কিংবা পাকিস্তান সুপার লীগও এর চেয়ে অনেক ভালো হয়। আজ মাশরাফী বিন মোত্তর্জাও সাকিব আল হাসানের কথার সাথে সুর মিলিয়ে বলেছেন, “ক্রিকেট বোর্ডকে দেখতে হবে দলের মালিক লাভ করে কি না। লাভ করলেই চেহারা বদলে যাবে।”
যারা নিয়মিত ক্রিকেট খেলা দেখেন এবং খোঁজখবর রাখেন তাদের দৃষ্টিতে বাংলাদেশ প্রেমিয়ার লীগ, ‘দায়সারা গোছে চলে’।
বিতর্কিত বাংলাদেশ প্রেমিয়ার লীগ ২০২৩
ক্রিকেট অনুসারী রাইয়ান কবির রাজিন বলছেন, “বিপিএল যদি ঠিকঠাক চালাতে না পারে বিসিবি তবে চালাবে না। কিন্তু এই গোঁজামিল কেন?”
চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্সের আনুষ্ঠানিক ক্রিকেটার ফটোশুটে দেখা গেছে ক্রিকেটাররা এসেছেন জিন্স পরে, দলের ট্রাউজারও দেয়া হয়নি।
ক্রিকেটে বিশেষত পেশাদার ক্রিকেটে এমন দৃশ্য বিরল।
কিন্তু বাংলাদেশ প্রেমিয়ার লীগ গত দশ-এগারো বছর ধরেই এমন সব ঘটনার জন্ম দিয়েছে যা আসলে টুর্নামেন্টটিকে ‘হাসির খোরাক’ করে তুলেছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
বিপিএলের সবচেয়ে আলোচিত বিতর্কের মধ্যে আছে ক্রিকেটারদের পাওনা টাকা না দেয়া, আম্পায়ারিং এবং উইকেটের মান নিয়ে প্রশ্ন।
সাকিব-বিপিএলের গভর্নিং বডির কথার লড়াই
সাকিব আল হাসান বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড এবং বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের অবিচ্ছেদ্য অংশের মতো। সাকিব তো বাংলাদেশ ক্রিকেটের সেরা তারকা হয়ে আছেন দীর্ঘ ১৫ বছর ধরেই। সেই সাকিব বিপিএল খেলার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে এবারের আসর মাঠে গড়ানোর আগে সমালোচনা করতে বাধ্যই হয়েছেন।
বিপিএলের অব্যবস্থাপনা নিয়ে মুখ খুলেছেন সাকিব। বলেছিলেন, বাংলাদেশের ঢাকা প্রিমিয়ার লিগও ঢের ভালো বিপিএলের চেয়েও। এ-ও বলেছেন, টুর্নামেন্টের প্রধান নির্বাহী হলে বদলে দিতেন বিপিএলের চিত্র।
সাকিবের এমন ইচ্ছাকে স্বাগত জানিয়েছে বিপিএলের গভর্নিং কাউন্সিল। তবে এটাও জানিয়েছে, সাকিব বিপিএলের চেয়েও ডিপিএল এগিয়ে রাখলেও, খেলেন কেবল ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্টই। ডিপিএল তো মিস দিয়েছেন অহরহ।
আচমকা খেলার সময়সূচি এগিয়ে আনা
সম্ভবত বিপিএলের বিতর্কের মধ্যে ওপরের দিকে থাকবে এটি। বিপিএল মাঠে গড়ার বেশি আগে থেকে গণমাধ্যম থেকে শুরু করে সাধারণ দর্শক সকলে জানতো, টুর্নামেন্টের খেলা প্রতিদিন শুরু হবে দুপুর ২টা এবং সন্ধ্যা ৭টায়। ব্যতিক্রম কেবল শুক্রবারে। সাপ্তাহিক বন্ধের দিনে খেলা শুরু হবে দুপুর ২টা ৩০ মিনিটে এবং সন্ধ্যা ৭টা ১৫ মিনিটে।
বিপিএলের এই সময়সূচি আচমকাই বদলে দিয়েছে আয়োজক কমিটি। সময়সূচি বদলানো সমস্যা নয়। তবে কারণ ব্যাখ্যা না করা এবং খেলা শুরু হওয়ার মাত্র দেড় ঘণ্টা আগে আচমকা সময় বদলে দেওয়াটাই সবচেয়ে বড় বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
যদিও বিপিএলের গভর্নিং কাউন্সিল জানিয়েছিল, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু সেই সত্যতা পাওয়া যায়নি বিপিএলের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে।
বিপিএল এডিআরএস বিতর্ক
টুর্নামেন্ট শুরুর আগে যখন বিপিএলের গভর্নিং কাউন্সিলের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, ডিআরএস কেন ব্যবস্থা করেনি তারা? তখন তারা জানিয়েছিল, সীমাবদ্ধতার কথা। সেই সীমাবদ্ধতা এড়িয়ে অ্যাডিশনাল ডিসিশন রিভিউ সিস্টেম নিয়ে আসছে তারা।
এমন সিস্টেমই নিয়ে এসেছে বিপিএলের আয়োজক কমিটি, যা সমাধানের চেয়েও সংশয় বাড়িয়েছে বেশি। ঢাকা ডমিনেটর্স এবং খুলনা টাইগার্সের মধ্যকার ম্যাচে যে চিত্র দেখা গেছে। যেখানে মাঠের আম্পায়ার গাজী সোহেল সৌম্যকে এলবি আউট দেন।
এডিআরএস নিয়ে সৌম্য জানিয়েছে, বল তার গ্লাভস ছুঁয়ে গেছে। তবে বিপিএলের অতি আধুনিক এডিআরএসে সেটি ধরা পড়েনি। ফলে টিভি আম্পায়ার আউটের সিদ্ধান্ত বহাল রাখে। সৌম্য সঙ্গে সঙ্গে সেই সিদ্ধান্তের আবারও বিরোধিতা জানান। মাঠের আম্পায়ার বলে দেন কট বিহাইন্ড হয়েছেন সৌম্য। যদিও শেষ পর্যন্ত সৌম্যকে আবারও নট আউট ঘোষণা দেন টিভি আম্পায়ার।
আম্পায়ারিং নিয়ে সাকিব-তামিমের ক্ষোভ : বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটে আম্পায়ারিং নিয়ে সাকিব বরাবরই বিরক্ত। একই দৃশ্য দেখা গেছে বিপিএল শুরু হওয়ার দুই দিনের মধ্যে। সাকিবের দল ফরচুন বরিশালের ম্যাচেই মাঠেই সাকিবকে ক্ষোভ ঝাড়তে দেখা গেছে আম্পায়ারের প্রতি।
রেজাউর রাজার একটি বল সাকিবের মাথার ওপর দিয়ে গেলে লেগ আম্পায়ার ওয়াইডের কল দেননি। কিন্তু বলটি নিশ্চিতভাবে ওয়াইড ছিল। আম্পায়ারের এমন সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেননি সাকিব। সঙ্গে সঙ্গে ক্ষোভ ঝেড়েছেন এই অলরাউন্ডার।
সাকিবের ম্যাচের ঠিক আগেই ক্ষোভ ঝেড়েছেন তামিম ইকবালও। সেই ম্যাচে সৌম্যকে আউট দেওয়া, না দেওয়া নিয়ে যে নাটক হয়েছে, সেই বিষয়ে আম্পায়ারের সঙ্গে আলোচনা করেন তামিম। এই সময় আক্ষেপের সুরেই তামিম বলেন, ‘এমন হলে আমরা কই যাব?’
বিপিএলে অধিনায়ক ছাড়া টস
এটি ঠিক বিতর্কের বিষয় নয়। তবে চমকে দেওয়ার মতো বটে। ফরচুন বরিশাল এবং সিলেট স্ট্রাইকার্সের মধ্যকার ম্যাচে নিয়মিত অধিনায়ক মাশরাফীকে ছাড়া টস করে সিলেট ফ্র্যাঞ্চাইজি। মাশরাফীর বদলে টসে যান মুশফিকুর রহিম।
অবশ্য এই বিষয়ে পরবর্তীতে যথাযথ ব্যাখ্যা দিয়েছে সিলেট ফ্র্যাঞ্চাইজি। একই ম্যাচে বরিশালের হয়ে অধিনায়ক হিসেবে সাকিব না এসে মিরাজ আসেন। পরবর্তীতে বরিশাল ফ্র্যাঞ্চাইজি জানিয়েছে, তারা প্রথম ম্যাচের জন্য অধিনায়ক হিসেবে মিরাজকেই বেছে নিয়েছে। ম্যাচ বাই ম্যাচ অধিনায়ক বদলাতে পারেন তারা।
ক্রিকেটারদের পাওনা টাকা দিতে দেরি করা
দুই হাজার বারো সালে ইংল্যান্ডের কাউন্টি ক্রিকেটারদের অর্ধ মিলিয়ন পাউন্ড বেতন দেয়নি বাংলাদেশ প্রেমিয়ার লীগে কর্তৃপক্ষ।
সেবার ইংল্যান্ডের ১৩জন ক্রিকেটার বাংলাদেশ প্রেমিয়ার লীগ খেলে পাওনা না পাওয়ার বিষয়টি ব্রিটেনের জনপ্রিয় গণমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানেও এসেছিল।
সেই প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ক্রিকেটারদের যে অঙ্কের অর্থ দেয়ার কথা ছিল, কেউই তার পুরোটা পরিশোধ করেননি।
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড, দলগুলোর মালিকদের সাথে একের পর এক আলোচনা করে এই দায় মিটিয়েছে ২০১৫ সালে।
শুধু ইংল্যান্ডেরই নয় প্রায় আড়াই বছর পর ২০১৫ সালেই স্থানীয় ক্রিকেটারদের পাওনাও মিটিয়েছিল বিসিবি।
‘গ্যারান্টার’ হিসেবে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড টাকা দিয়েছিল।
তবে এই বিতর্ক এখন অনেকটাই কমে এসেছে, বাংলাদেশ প্রেমিয়ার লীগের দলগুলো আগেই ক্রিকেটারদের পাওনার বিষয়গুলো নিশ্চিত করে চুক্তি করে।
স্পট ফিক্সিংয়ের ঘটনায় বিপিএল বির্তকিত হয়েছিল
দুইহাজার তেরো সালে ঘটেছিল বাংলাদেশ প্রেমিয়ার লীগের ইতিহাসের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা।
যার এক বছর পর ২০১৪ সালে ম্যাচ ফিক্সিং ও স্পট ফিক্সিংয়ের অভিযোগে দোষী প্রমাণিত হয়ে বাংলাদেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে সম্ভাবনাময়দের একজন মোহাম্মদ আশরাফুলের ওপর বড় নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছিল।
দৈনিক প্রথম আলোতে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তখন মোহাম্মদ আশরাফুল বলেছিলেন, ২০০৪ সালে থেকেই তিনি ফিক্সিংয়ের সাথে জড়িত।
বাংলাদেশে ক্রিকেট বড় উপলক্ষ্য এবং উদযাপনের মঞ্চ হিসেবে বিবেচিত হয়।
সেখানে আশরাফুলের মতো একজন ক্রিকেটারের ফিক্সিংয়ে জড়িত থাকার ঘটনা বড় আলোড়ন তৈরি করেছিল।
আশরাফুল আর কখনোই বাংলাদেশের জাতীয় দলে ফিরতে পারেননি।
বাংলাদেশ প্রেমিয়ার লীগের আম্পায়ারিং
বাংলাদেশের ক্রিকেটে সাকিব আল হাসানের সাথে আম্পায়ারের কথা কাটাকাটি পরিচিত এক দৃশ্য হয়ে উঠেছে।
শেষবারের বিপিএলেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
এবং এটা কেবল সাকিবের সাথেই নয়, অনেক ক্রিকেটারের কাছেই বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের আম্পায়ারিং মানসম্মত হয় না।
যে কারণে এই ক্রিকেট লীগকে পুরোপুরি ভালো মানের বলা কঠিন হয়ে পড়ে।
বাংলাদেশের আম্পায়ারদের ওপর আস্থাহীনতা একটা বড় কারণে এখানে।
এবারে ইংল্যান্ডের ডেভিড মিলনস ও শ্রীলঙ্কার রবীন্দ্র ভিমালাশ্রী শুরু থেকেই বিপিএলের আম্পায়ারিংয়ের দায়িত্বে থাকবেন বলে জানা গেছে।
ডিসিশন রিভিউ সিস্টেম নিয়ে বিতর্ক
বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগে ডিসিশন রিভিউ সিস্টেম নেই, এবারও প্লে অফের আগ পর্যন্ত বিসিবি অলটারনেটিভ ডিসিশন রিভিউ সিস্টেম দিয়ে কাজ চালাবে।
আম্পায়ারদের ভুলভ্রান্তি হতে পারে এবং অতীতে হয়েছে এই কারণে ডিসিশন রিভিউ সিস্টেম নিয়ে আসা হয়েছে ক্রিকেটে, যা সংক্ষেপে ডিআরএস নামে পরিচিত।
বাংলাদেশের ক্রিকেটে এখন এটি এডিআরএস নামে হয়- যেখানে প্রযুক্তির বেশিরভাগই অনুপস্থিত থাকে।
বাংলাদেশের ক্রিকেটের আম্পায়ারদের সিদ্ধান্ত নিয়ে যে দ্বিধা তৈরি হয়, তা এই বিকল্প ডিআরএস ব্যবস্থার কারণে আরও বেড়ে যায়।
শেষ পর্যন্ত অসন্তোষ থাকে ক্রিকেটারদের মধ্যে।
হোম অ্যান্ড অ্যাওয়ে ভেন্যু নেই- মাত্র তিনটি ভেন্যুতে খেলা
বাংলাদেশ প্রেমিয়ার লীগের আরেকটি বড় দুর্বলতার জায়গা দলগুলোর ভেন্যু না থাকা।
এই টুর্নামেন্টের খেলা মাঠে গড়ায় কেবল, ঢাকা, সিলেট ও চট্টগ্রামে।
ঢাকার মিরপুরেই হয়েছে সিংহভাগ ম্যাচ।
একে তো সুনির্দিষ্ট মালিকানা নেই, সেই সাথে বাংলাদেশের বিভাগীয় স্টেডিয়াম থাকলেও সেখানে আন্তর্জাতিক মানের ক্রিকেট টুর্নামেন্ট চালানো কঠিন বলে মনে করে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড।
সাকিব আল হাসান গতকাল সাংবাদিকদের সাথে কথা বলে যেসব বিষয়ে ঠিক করার কথা বলেছেন তার মধ্যে একটি ছিল এই, ‘হোম-অ্যাওয়ে ভেন্যু।’
ক্রিকেট দর্শক এইচএম সাব্বির হোসেন বলেছেন এবারে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বিপিএল দেখবেন না।
“প্রতিবারই আশা করি আইপিএল বা অস্ট্রেলয়ান বিগ ব্যাশের মত আটটা দল থাকবে, প্রত্যেক দলের হোম ভেন্যু থাকবে, প্রত্যেক দল হোম এবং অ্যাওয়ে ভিত্তিতে খেলবে। যেমন চট্টগ্রামে এসে ঢাকার টিম দুয়োধ্বনি শুনবে আবার একই ভাবে ঢাকায় গিয়ে চট্টগ্রাম টিম।”
তিনি আশা করে থাকেন যে বিপিএলের জন্য বরিশালের বাসিন্দারা খুলনা যাবে বেড়াতে। কিন্তু এসব হয়ে ওঠে না বাংলাদেশ প্রেমিয়ার লীগে।
তিনি খানিকটা ক্ষোভ নিয়েই বলেছেন, “কিন্তু কোথায় কী? সেই উদ্ভট স্কেজুউল! দুপুর দেড়টায় কে যাবে স্টেডিয়াম খেলা দেখতে!”
সাকিব আল হাসানের গতকালের সমালোচনার প্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের কাছে জানতে চাওয়া হয়।