শেখ সাইফুল ইসলাম কবির, বাগেরহাট জেলা সংবাদদাতা; জেলার শরণখোলায় মাদক ব্যবসায়ী ও দখলবাজ প্রভাবশালী চক্রের অত্যাচারে কয়েকটি পরিবার প্রায় দুবছর ধরে এলাকা ছাড়া হয়েছে। জমি দখল, নিরিহ মানুষদের মারধর, ছিনতাই ও ধর্ষণের মত অভিযোগ থাকার পরও প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচেছ প্রধান হোতা মিলন। শরণখোলা উপজেলার ধানসাগর ইউনিয়নের রতিয়ারাজাপুর গ্রামের সাবেক চকিদার সোমেদ হাওলাদারের ৪ ছেলের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগে মুখ খুলতে শুরু করেছে গ্রামবাসি। বিভিন্ন অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে শরণখোলা থানা ও বাগেরহাট আদালতে কমপক্ষে ১০ টি মামলা রয়েছে। তবে পুলিশ বলছে অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।

অতিষ্ঠ এলাকাবাসি জানায়, রতিয়ারাজাপুর গ্রামের সোমেদ হাওলাদারের ছেলে নেহারুল হাওলাদার, মনির হাওলাদার, মিলন হাওলাদার ও ছগির হাওলাদার এলাকায় এক ধরণের রাম রাজত্য কায়েম করেছে। মাদক ব্যবসা ও সুদের টাকার গরমে কতিপয় রাজনৈতিক দলের ছত্র ছায়ায় থেকে দীর্ঘদিন ধরে নিরীহ মানুষকে মারধর, ধর্ষণ, চাদাবাজী, জমি দখল করে আসছে। তাদের বিরুদ্ধে কেউ কথা বললে মারধর করে এলাকা ছাড়া করে তারা। তাদের অত্যাচারে হাফেজ হাওলাদার, ছেতারা বেগম, ইউনুস হাওলাদারসহ কয়েকটি পরিবার এলাকা ছেড়ে চলে গেছে। এছাড়াও একাধিক গৃহবধুকে ধর্ষণ ও মারধর করেছে মিলন এমন অভিযোগ করেছেন অনেকেই।

রতিয়া রাজাপুর গ্রামের সাবেক ইউপি সদস্য সিদ্দিকুর রহমান  বলেন, সোমেদ হাওলাদারের ৮ ছেলে। তার ছেলেরা এলাকায় যা ইচ্ছে তাই করে। আমাকেও রামদা নিয়ে মারতে এসেছে কয়েকবার। এলাকার অনেক নিরীহ মানুষকে মারধর করেছে মিলন। এলাকার কেউ মিলনের কথা না শুনলেই মারধর শুরু করে।

মিলনের অত্যাচারে বাড়ি ছাড়া ছেতারা বেগম বলেন, একদিন হঠাৎ করে মিলন বাড়িতে প্রবেশ করে আমাকে মারধর করে। মারধর করে আমার চারটি দাত ফেলে দেয়। ঘরের মালামাল, হাঁস, মুরগিসহ দুইটা গরু নিয়ে যায়। এসব কেন নিচ্ছে জানতে চাইলে আমাকে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। কয়েকদিন আমাকে দাও নিয়ে খুজেছে মেরে ফেলার জন্য।আমাকে হাতের মাথায় পেলে মেরে ফেলবে এমন কথাও বলেছে। প্রাণ ভয়ে এখন আমি বাড়িতে আসতে পারি না। অন্য এলাকায় আশ্রয় নিয়েছি। অত্যাচারী মিলনের বিচার চাই।

স্থানীয় আরিফা, মোজাম্মেল হোসেন, দোলোয়ার, হারুন, রেক্সোনা বেগম, জাহাঙ্গীরসহ স্থানীয় অনেকে  বলেন, মিলন ও তার ভাইদের ভয়ে আমরা গ্রামের মানুষ সব সময় আতঙ্কে থাকি। গ্রামের অনেক মানুষ ওর ভয়ে পালিয়ে গেছে। গ্রামের মেয়ে ও গৃহবধুরা রাতের বেলায় প্রসাব-পায়খানার জন্য ঘরের বাইরে আসতে পারেনা। মেম্বার চেয়ারম্যান এমনকি থানায় মামলা করেও মিলনের হাত থেকে বাঁচতে পারছি না। যার কাছে নালিশ করি না কেন কেউ তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয় না।

মিলনের নির্যাতনে বাড়ি ছাড়া মোসাঃ হাসিনা বেগম বলেন, ২০১৯ সালের ১৬ অক্টোবর রাতে প্রকৃতির ডাকে বাহিরে বের হলে আগে থেকে ওৎ পেতে থাকা মিলন আমাকে ধর্ষণের চেষ্টা করে। ১৯ অক্টোবর আমি শরণখোলা থানায় মামলা দায়ের করি। মামলা করার কারণে আমার স্বামী হাফেজ হাওলাদার, মেয়ে মারিয়া ও আমাকে মারধর করে। ঘরের মালামাল লুট করে নিয়ে যায় এবং মেরে ফেলবে বলে হুমকি দেয়। প্রাণ ভয়ে এলাকা ছেড়ে চলে আসি।

প্রবাসী সাখাওয়াতের স্ত্রী মোসাঃ ফাতিমা বেগম  বলেন, মিলন ও তার ভাইদের সাথে আমাদের জমি নিয়ে বিরোধ রয়েছে। তারা আমাদের ১২ বিঘা জমি জোরপূর্বক দখল করে রেখেছে। গেল দুই বছর ওই জমিতে আমরা ধান করতে পারিনা। জমিতে গেলে মেরে ফেলবে প্রাণ ভয়ে আমি জমিতে যাই না। প্রতিকারের জন্য মামলা করলে ক্ষিপ্ত হয়ে শিশু সন্তানসহ আমাকে মারধর করে। এলাকার একজনের পাওনা পরিশোধের জন্য ১২মে বিকেলে ব্যাংক থেকে এক লক্ষ ৫০ হাজার টাকা তুলে বাড়ির উঠানে পৌছালে মিলন ও তার ভাইরা আমার উপর হামলা করে। আমাকে মারধর করে এবং আমার ব্যাগে থাকা টাকা, সাওমী নোট-৮ মোবাইল ও গলায় থাকা স্বর্ণের চেইন ছিনিয়ে নিয়ে যায়। পরবর্তীতে আমি মামলা করি। কিন্তু পুলিশ কাউকে আটক করেনি। শুধু আমি না এলাকার অনেকেই আছে যারা মিলনের অত্যাচারের শিকার হয়েছে, মার খেয়েছে। কেউ কেউ মান সম্মান ও প্রাণ ভয়ে মুখ খোলেনি। আবার যারা ভয়ভীতি উপেক্ষা করে জন প্রতিনিধি ও থানা পুলিশের দারস্থ হয়েছে তারাও পরবর্তীতে মারধর ও অত্যাচারের শিকার হয়েছে।

মিলনের প্রতিবেশী বৃদ্ধ মালেক হাওলাদার ও তার স্ত্রী আলেয়া বেগম  বলেন, ছেলেরা চট্টগ্রামে চাকুরী করে। মেঝ ছেলে বিয়ে করে বউকে আমাদের সেবা যতেœর জন্য বাড়িতে রেখে যায়্। মিলনের খারাপ নজরের কারণে বউকে ছেলের কাছে পাঠাতে বাধ্য হয়েছি। বউকে বাড়ি থেকে পাঠানোয় ক্ষিপ্ত হয়ে মেরে ফেলার ভয় দেখিয়ে আমাদের কাছ থেকে এক লক্ষ ৬ হাজার টাকা নিয়েছে মিলন।

মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রব ধলু বলেন, সোমেদ চকিদার ও তার ছেলেরা খুবই বেপরোয়া। তারা এলাকার লোকজনের উপর ইচ্ছেমত অত্যাচার নির্যাতন করে। প্রশাসন কেন ব্যবস্থা নেয় না, তা জানিনা। প্রশাসন অতিদ্রুত ব্যবস্থা না নিলে এলাকায় খুন খারাবি হয়ে যাবে।

রতিয়া রাজাপুর গ্রামের পাশে রাজাপুর বাজারের কয়েকজন ব্যবসায়ী বলেন, কিছুদিন আগে মিলন ও তার ভাইয়েরা বাজারের ৬টি দোকান চুরি করে। থানায় অভিযোগ ও স্বাক্ষী দেওয়ার পরেও তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহন করা হয়নি। মিলন ও তার ভাই মনির মাদক ব্যবসার সাথেও জড়িত বলে উল্লেখ করেন ব্যবসায়ীরা।

এসব অভিযোগের বিষয়ে মিলন ও তার ভাইদের সাথে কথা বলার জন্য বাড়িতে গেলেও তারা সাংবাদিকদের সামনে আসেনি। উল্টো অত্যাচারের শিকার যেসব মানুষ সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেছে তাদের কয়েকজনকে সংবাদকর্মীদের সামনেই হুমকী দিয়েছে মিলনের পিতা বৃদ্ধ সোমেদ হাওলাদার।

স্থানীয় ইউপি সদস্য তালুকদার হুমায়ুন কবির সুমন  বলেন, সোমেদ হাওলাদার তার ছেলে নেহারুল হাওলাদার, মনির হাওলাদার, মিলন হাওলাদার ও ছগির হাওলাদারের বিরুদ্ধে এলাকায় অনেককে মারধর, ধর্ষণ, নির্যাতন ও জমি দখলের অভিযোগ রয়েছে। মিলন ও তাদের ভাইদের অত্যাচারে এলাকার ৬-৭টি পরিবার এলাকা ছাড়া। স্থানীয় ভাবে বিভিন্ন সময় শালীসের মাধ্যমে স্থানীয়দের সাথে তাদের দীর্ঘদিনের সমস্যা সমাধান করার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু তারা কারও কথা শোনে না। থানা পুলিশও তাদের বিরুদ্ধে কোনভাবে ব্যবস্থা নিতে পারছে না। এ অবস্থায় এলাকায় শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে মিলনসহ তাদের ভাইদের আটক পূর্বক আইনের আওতায় আনার দাবি জানান তিনি।

ধান সাগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ মইনুল ইসলাম টিপু বলেন, স্থানীয় নারী ইউপি সদস্যের স্বামীকে দাও নিয়ে দাবড়াইছে মিলন ও তার ভাইয়েরা। এছাড়াও স্থানীয়দের বিভিন্ন অভিযোগের ভিত্তিতে তাদেরকে পরিষদে ডাকা হয়েছে। কিন্তু তারা পরিষদে আসেনি। বলে ওই পরিষদে না গেলে আমাদের কিছু হবে না। এর থেকে বড় ক্ষমতা আমাদের আছে।ওরা সাত-আট ভাই, এর মধ্যে নেহারুল, মিলন ও মনির এই তিন ভাই ডাকাতি থেকে শুরু করে এমন কোন অপরাধ নেই যা তারা করে না। কোন পরিবারের সাথে ঝগড়া হলে মিলন রাতে ওই বাড়িতে গিয়ে নারীদের উপর নির্যাতন করে। এসব অভিযোগে পুলিশকে বারবার জানানো এবং মামলা করা হলেও পুলিশ কেন ব্যবস্থা নেইনি তা আমরা জানিনা। আমি চাই এই সন্ত্রাসীদের কঠিন বিচার হোক।

এবিষয়ে মিলনের বাবা সোমেদ চৌকিদার তাদের বিরুদ্বে আনা অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, আমাদের সাথে প্রতিবেশিদের জমি নিয়ে বিরোধ থাকায় তারা বিভিন্ন ধরনের অপপ্রচার চালাচ্ছে।

শরণখোলা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এসকে আব্দুল্লাহ আল সাইদ বলেন, রতিয়া রাজাপুরে জমি সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে একটি গোলমাল রয়েছে। দুই পক্ষের মামলা চলমান রয়েছে। আমি দুই পক্ষের মধ্যে আপোস মীমাংসার চেষ্টা করেছি। তারপরও ওখানে যাতে কোন পরিবার নির্যাতনের স্বীকার না হয়, কেউ যাতে ঘর ছাড়া না হয়, কেউ যেন আইনশৃঙ্খলা পরিপন্থি কোন কাজ করতে না থাকে সে জন্য আমাদের কঠোর নজরদারি রয়েছে। যদি কেউ এ ধরণের অপরাধ করতে থাকে তাহলে তাদেরকে আইনের আওতায় এনে বিচারের ব্যবস্থা করার আশ্বাস দেন তিনি।

আমাদের বাণী ডট কম/০১ জুলাই  ২০২০/পিপিএম

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।