প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন: আমরা যারা অর্থনীতি বুঝি, অথবা ইসলামী অর্থনীতি বুঝি, অথবা কমপক্ষে বাজারে পণ্য বেচাকেনা বা ব্যবসায়-বাণিজ্য বুঝি, তারা নিঃসন্দেহে মুনাফাখোর, কালোবাজারী, চোরাকারবার, চোরাচালান, মজুদদার- শব্দগুলোর সঙ্গে পরিচিত।

এই শব্দগুলোর মাধ্যমে যাদেরকেই বুঝানো হোক না কেন, অতি সাধারণ মানুষের কাছেও তারা অপরাধী। ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টি না হয় বাদ দিলাম; সাধারণত সামাজিক রীতি-নীতি অনুসারে, ব্যবসা-বাণিজ্যের নিয়ম অনুসারে, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার নিয়মানুযায়ী এ কাজে জড়িতরা দেশের শত্রু, অর্থনীতির শত্রু, মানবতার শত্রু এবং সাধারণ জনগণের শত্রু।

এই শব্দগুলো দ্বারা যা কিছু বুঝানো হয় তা মানবতার কল্যাণে করা হয় না। এই মুনাফাখোর শব্দটি তাই অর্থনীতির মধ্যে সবচেয়ে বড় একটি গালি হিসেবেও বিবেচিত হয়। হ্যাঁ, আমি ব্যবসায়ী, আমি একটি দ্রব্য কিনে নিয়ে আসবো এবং সেটি বিক্রি করবো। ক্রয় করে আনতে, এই পণ্যসামগ্রী বহন করে নিয়ে আসতে অবশ্যই আমার খরচ হবে, আমার শারীরিক কষ্ট হবে। সব মিলিয়ে ক্রয়মূল্য ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক খরচ হিসাব করে, আমি পণ্যটির একটি বিক্রয় মূল্য নির্ধারণ করবো। এরসঙ্গে যেখানে বসে আমি ব্যবসা করছি, সেই ঘরের ভাড়া, বিদ্যুৎ খরচ, সেই ঘরের অন্যান্য যাবতীয় খরচ, কর্মচারীদের বেতন মিলিয়ে আমি একটি সেবা দিতে যাচ্ছি এই মনোবৃত্তি নিয়ে, আমার পণ্যের বিক্রয় মূল্য নির্ধারণ করবো। এই পণ্যমূল্য নির্ধারিত হবার পাশাপাশি, আমার যাতে দুটি পয়সা লাভ থাকে, সে চিন্তাও আমাকে করতে হবে। চাই তা শতকরা ১ ভাগ, শতকরা ২ ভাগ, শতকরা ৩ ভাগ বা ১০ ভাগ, কিন্তু ১০০ ভাগ তো আর হতে পারে না!

যখন ১, ২, ৩, ৪ এভাবে শতকরা ৫ ভাগও যোগ করে কেউ তার ব্যবসা নির্ধারণ করে, তাতে সমস্যা নেই। কিন্তু দেখা যায় মুনাফাখোররা এই সম্পদের মূল্য পাঁচগুণ পর্যন্ত বাড়িয়ে দিয়ে বিক্রি করে এবং ভোক্তাদের অসহনীয় যন্ত্রণায় ফেলে। মুনাফাখোররা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে বাজার নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করে, পণ্যের সাধারণ প্রবাহ বন্ধ করে দেয়। এভাবে তারা একটি ভোগ্য পণ্যের সঙ্কট তৈরি করে, ক্রেতাসাধারণকে জিম্মি করে, বাজারে সিন্ডিকেট তৈরি করে, ক্রেতা সাধারণকে বিপদে ফেলে, কষ্ট দিয়ে, ভোক্তাদের সামনে এক ধরনের নাভিঃশ্বাস তৈরির চেষ্টা করে। এই কাজটি কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়। সাধারণ সমাজের দৃষ্টিতে তো গ্রহণযোগ্য নয়ই, অন্যদিকে ইসলামের দৃষ্টিতে এটি একটি গর্হিত কাজ, অপরাধের কাজ, মহাপাপের কাজ; যার জন্য আল্লাহ এবং তার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিভিন্ন বাণীর মাধ্যমে সতর্ক করেছেন।

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর একটি বাণী হচ্ছে: ‘সামাজিক বন্ধন ভেঙে পড়ার অন্যতম কারণ, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি।’ (হাদিসটি মুসনাদ আহমদে বর্ণিত হয়েছে)
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ব্যাপারে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রসিদ্ধ একটি হাদিস, ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল রাহমাতুল্লাহি আলাইহ, মুসনাদে আহমদ -এ বর্ণনা করেছেন।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘মুসলিম জনগণের জন্য, পণ্য দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে, যদি কেউ কোনোরূপ হস্তক্ষেপ করে, তাহলে আল্লাহ তাআলার অধিকার হলো, তিনি কেয়ামতের দিন, তাকে জাহান্নামের একটি ভয়ঙ্কর স্থানে, আগুনের ওপর বসাবেন।’ (হাদিস নম্বর ১৯৪২)

এই হাদিস খুবই ভয়াবহ পরিণতির ইঙ্গিত বহন করে। আর তা হচ্ছে, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি যিনি করছেন, শুধু প্রত্যক্ষভাবে তিনিই দায়ী নন বরং এই দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে যারা জড়িত, প্রত্যেকেই এজন্য দায়ী। আর আল্লাহর অধিকার হচ্ছে এই দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করে সাধারণ ভোক্তাদের কষ্ট দেয়ার জন্য, যারা যারা দায়ী, প্রত্যেককেই কেয়ামতের দিবসে জাহান্নামের সেই নির্ধারিত ভয়ঙ্কর স্থানে আগুনের উপরে বসানো।

এ ক্ষেত্রে এই ভয়াবহতা কেবল যিনি দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করছেন বা মুনাফাখোরী করে চলেছেন, তিনি একাই দায়ী নন বরং যে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অথবা প্রশাসনের বাজার নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা যারা এটি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না, অথবা এদের জন্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারছেন না, তারাও সমভাবে এর জন্য দায়ী।
এমনকি পার্শ্ববর্তী কোনো দেশ থেকে আমদানির মাধ্যমে পণ্যদ্রব্য দেশে এলে, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সম্ভাবনা নেই, এমতাবস্থায় আমদানীর সুযোগ নষ্ট করার দায়ে, আশপাশের দেশের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলরাও এজন্য দায়ী। যারা এই মুনাফাখোরীর সঙ্গে জড়িত, সামান্যতম সহযোগিতা করছেন; অর্থ দিয়ে, মানসিক সাপোর্ট দিয়ে, শারীরিক পরিশ্রম দিয়ে, সবাই এই হাদিসের আলোকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করে চলেছেন।

আমাদের দেশে রোজা এলে, বা রমজান মাস এলে, দ্রব্যমূল্য হু হু করে বেড়ে ওঠে। বাজার নিয়ন্ত্রণকারী সিন্ডিকেটগুলো প্রতিটি দ্রব্যের মূল্য দ্বিগুণ, তিনগুণ, বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়ে, বিক্রির জন্য বাজারজাত করে যা ভোক্তাদের জন্য সমূহ কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

যা হোক, রমজানে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করা অনৈতিক ও গুনাহের কাজ। রমজান মাস, রহমত, বরকত মাগফিরাত ও নাজাতের মাস। পাপ পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত হওয়ার মাস। আত্মশুদ্ধি লাভ করার মাস। যার জন্য মহান আল্লাহ তা’আলা হাদিসে কুদসির মাধ্যমে বলেছেন, ‘রোজা আমার জন্য রাখা হয় এবং এর পুরস্কার আমি নিজ হাতে দেব।’ অর্থাৎ রোজা শুধু ইবাদত নয়, রোজা একটি এমন অবস্থা, যার মাধ্যমে রোজাদার সরাসরি স্রষ্টা আল্লাহ তা’আলার সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারে এবং এর প্রতিদান তিনি রোজাদারকে বিশেষভাবে দান করেন।

আল্লাহর হক এবং বান্দার হক দুটি জিনিস রয়েছে। শুধু নিরেট কিছু ইবাদত রয়েছে যা আল্লাহর হক হিসেবে পরিচিত। যেমন সালাত আদায় করা, রোজা রাখা, ঈমান আনা, হজ্ব করা ইত্যাদি। এ ছাড়াও বান্দার হক বলতে একটি বিষয় রয়েছে, যা কখনো লঙ্ঘিত হলে, বান্দা তা ক্ষমা করার আগে, আল্লাহ তা’আলাও কখনোই তা ক্ষমা করেন না।
একজন নাগরিক হিসেবে, একজন রোজাদার হিসেবে, একজন মুমিন-মুসলিম হিসেবে, সকলেরই অধিকার রয়েছে সাধারণ যোগান দেয়া খাবার-দাবারের মতো, রোজার মাসে খাবার-দাবার ক্রয় করে, খেয়ে, রোজাব্রত পালন করার, তথা সেহরি ও ইফতার করার। কিন্তু মুনাফাখোরী, অতি লোভী ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কারণে, সাধারণ মানুষ, সাধারণ মূল্যে এই নিত্য পণ্য-দ্রব্য সামগ্রী ক্রয় করতে পারেন না। বরং তা দ্বিগুণ-তিনগুণ, অথবা তারও চেয়ে বেশি মূল্যে ক্রয় করে এই রহমতের মাস অতিবাহিত করেন। রোজাব্রত পালন করার চেষ্টা করেন। পরিবার পরিজন নিয়ে কষ্ট করে থাকেন।

উল্লিখিত প্রতিটি ক্ষেত্রেই রোজাদারের অধিকার নষ্ট করা হচ্ছে, সেটা প্রশাসনিকভাবে হোক, সামাজিকভাবে বা ধর্মীয়ভাবেই হোক, রোজাদার তার প্রকৃত অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এই বঞ্চিতকরণের পেছনে ব্যবসায়ীরা যেমন জড়িত, প্রশাসনের যারা ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্বে রয়েছেন তারাও জড়িত। সামাজিকভাবে প্রতিটি বিবেকবান মানুষেরও দায়-দায়িত্ব রয়েছে এর প্রতিবাদ করা। এই সিন্ডিকেট থেকে মানুষকে বের করে নিয়ে আসার চেষ্টা করা। আর যদি তা সম্ভব না হয়, তাহলে যে হাদিসটি প্রথমেই উল্লেখ করেছিলাম: ‘জাহান্নামের একটি ভয়ঙ্কর স্থানে আগুনের উপরে বসানোর শাস্তির জন্য’ আমাদের সকলকেই তৈরি হতে হবে।

তাই যারা ব্যবসা করছেন, তারা সহনীয় অল্প মুনাফায় তাদের পণ্য সামগ্রী বিক্রি করবেন- এটাই আমাদের প্রত্যাশা। সমাজপতি এবং সমাজের প্রত্যেকটি স্তরের নেতৃস্থানীয় মানুষ, ব্যবসায়ী দায়িত্বশীলগণ, সবাই যদি সঠিকভাবে,, মানবিক দৃষ্টিতে, ধর্মীয় অনুভূতি থেকে, তাদের ব্যবসা পরিচালনা করেন, তাহলে এই মুনাফাখোরের খাতায় তাদের নাম লেখানোর প্রয়োজন হয় না।

সুষ্ঠু ভাবে, পবিত্রতার সঙ্গে, সিয়াম পালনের জন্য খাবার, নিত্যপণ্য, সহজলভ্য করা, ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে রাখার দায়িত্ব সকলেরই। কাজেই শুধু রমজান মাসে নয়, রোজার দিনেও নয়, যে কোনো সময় হোক না কেন, মুনাফাখোরী, অতি লাভের আশায় বা দ্রব্যমূল্য আকাশচুম্বী করার জন্য, কারো কোনো রকমের সংশ্লিষ্টতা থাকা উচিত নয়। রোজার মাসে তো এটা কোনো ক্রমেই উচিত নয়। কারণ এ মাসের ফজিলত অনুযায়ী ভালো কাজের জন্য যেমন সাতশ গুণ বা তারও চেয়ে বেশী সওয়াব বাড়িয়ে দেয়া হয়, আবার একটি খারাপ কাজের জন্য আল্লাহ চাইলে সাতশ গুণ বা তার চেয়েও বেশি গুনাহ বাড়িয়ে দিতে পারেন। তাই আমাদের সতর্ক হতে হবে।

রোজার মাসে দ্রব্যমূল্য যেনো বৃদ্ধি না পায়- সেজন্য আমরা চেষ্টা করব। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ মুমিন হতে পারবে না যতক্ষণ পর্যন্ত তোমরা নিজেদের জন্য যা কিছু পছন্দ করছো, তোমার ভাইয়ের জন্যও তাই পছন্দ করো।’ যারা দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করেন, তারা নিশ্চয়ই অপরের জন্য যা পছন্দ করছেন নিজের জন্য তা পছন্দ করছেন না। অতএব তাদের মুমিন হওয়ার বিষয়টিও সন্দেহাতীতভাবে, হাদিসের আলোকে তলিয়ে দেখার দাবি রাখে। তাই দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করার অপরাধে অপরাধী করে, আল্লাহ যেন আমাদের মৃত্যুবরণ না করান; আল্লাহর কাছে সেই তাওফিক কামনা করছি। আমিন!

লেখক: গবেষক, প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক ও মাসিক পত্রিকা সম্পাদক

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।