সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটি বিখ্যাত কবিতা ‘কেউ কথা রাখেনি’। কবি জীবনের বিভিন্ন পর্বে আপন জানা মানুষদের কথা না রাখার বেদনা ও যাতনা মর্মস্পর্শী ভাষায় তুলে ধরেছেন। এভাবে তিনি তেত্রিশটি বছর পার করেছেন। কবিতার একটি ঘটনা- মামা বাড়ির মাঝি নাদের আলি বলেছিল, তুমি বড় হও দাদাঠাকুর, তোমাকে তিন প্রহরের বিল দেখাতে নিয়ে যাব। কবির প্রশ্ন- নাদের আলি আমি আর কত বড় হব? আমার মাথা ঘরের ছাদ ফুঁড়ে আকাশ স্পর্শ করলে তবে কি তিন প্রহরের বিল দেখাতে নিয়ে যাবে?

নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা এমপিওভুক্তির আশায় বছরের পর বছর, দশকের পর দশক,এমনকি কেউ কেউ জীবনটাই পার করে দিয়েছেন। কর্তা ব্যক্তিদের শরণাপন্ন হলে নানা সময় তারা এমপিওভুক্তির যে কথা শুনিয়েছেন তা কেবল ‘কথার কথা’ হিসাবে রয়ে গেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির কথা দিয়ে কথা না রাখার যে দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে তাতে করে ‘কেউ কথা রাখেনি’ কবিতার চেয়ে কয়েকগুণ দীর্ঘ কবিতা রচনা করা যায়।
নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির আন্দোলন দীর্ঘ এক যুগেরও অধিককাল ধরে চলছে। সেই আন্দোলনের প্রেক্ষিতে শিক্ষকরা বহুবার আশ্বাসের বাণী শুনেছেন। কিন্তু ঐ পর্যন্তই। সে সব আশ্বাস আর বাস্তবায়িত হয়নি। প্রসঙ্গত, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় কতিপয় প্রতিশ্রুতির ওপর আলোকপাত করা যেতে পারে। এ সকল প্রতিশ্রুতির কোনটিই আলোর মুখ দেখেনি।

২০১২ সালের ২৬ জুন বাংলাদেশের ওয়াকার্স পার্টির সভাপতি এবং সেই সময়কার শিক্ষা বিষয়ক স্থায়ী কমিটির সভাপতি রাশেদ খান মেনন জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এসে আন্দোলনরত শিক্ষক-কর্মচারীদের উদ্দেশ্যে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির আশ্বাস দিয়েছেন। এ আশ্বাসের বাস্তব প্রতিফলন দেখতে চাই। তিনি সরকারের হুঁশিয়ারি দেন, নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা না হলে পদত্যাগ করব। কিন্তু তিনি সংসদীয় কমিটির সভাপতি থাকাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হয়নি, তিনি পদত্যাগও করেননি।

২০১২ সালের ১ থেকে ৪ অক্টোবর জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থান, বিক্ষোভ মিছিল এবং পরবর্তীতে শিক্ষামন্ত্রণালয় অভিমুখে কর্মসূচি দিলে পুলিশী হামলায় অনেক শিক্ষক-কর্মচারী আহত হন। এ সময় প্রধানমন্ত্রীর এপিএস-২ সাইফুজ্জামান শিখর মুঠেফোনে প্রধানমন্ত্রীর সাথে শিক্ষক প্রতিনিধিদের বৈঠক হবে বলে জানান। এ খবর বিটিভিসহ অন্যান্য মিডিয়া প্রচার করে। কিন্তু এ খবর সঠিক প্রমাণিত হয়নি। একই বছর ৬ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব-১ মোঃ জাহাঙ্গীর আলম ১১ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাতের সম্মতিপত্র পাঠান। অজ্ঞাত কারণে সাক্ষাতকারটি স্থগিত হয়। অনেক চেষ্টা করেও পরবর্তীতে আর প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ মেলেনি।

২০১৩ সালের শুরুতে শিক্ষক-কর্মচারীরা জাতীয় প্রেসক্লাব, কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার, ন্যাম ভবন ও মুক্তাঙ্গন এলাকায় অবস্থান বিক্ষোভ, ঘেরাও ও অনশন কর্মসূচি পালন করেন। এ সময় শিক্ষকেরা পুলিশের লাঠিচার্জ. বিষাক্ত পিপার স্প্রে,জলকামান, টিয়ার গ্যাস ও রাবার বুলেট হামলার শিকার হন। আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৮ জানুয়ারি শিক্ষামন্ত্রীর বাসভবনে মন্ত্রী ও সচিবের সাথে ২০ সদস্যের শিক্ষক প্রতিনিধি দল বৈঠকে বসে। বৈঠক শেষে মিডিয়ার সামনে এক বিবৃতিতে শিক্ষামন্ত্রী এমপিওভুক্তির জন্য ৩ মাসের সময় বেধে দেন। ২০১৪ সালে নুরুল ইসলাম নাহিদ দ্বিতীয়বারের মত শিক্ষামন্ত্রী হন। তাকে নন-এমপিও শিক্ষক সংগঠনের পক্ষে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানাতে গেলে সত্বরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হবে বলে জানান।
২০১৫ সালের ২৬ অক্টোবর হতে ২২ নভেম্বর একটানা ২৮ দিন কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার ও জাতীয় প্রেসক্লাবে কালো ব্যাজ ধারণ, কাফনের কাপড় মাথায় বেধে অবস্থান, অনশনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি চলে। শেষদিনে মহাজোটের শরিক দল বিএনএফ’র প্রধান আবুল কালাম আজাদ, এমপি সমাবেশে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থকে আগামী ২০১৬ শিক্ষাবর্ষের শুরু থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির ঘোষণা দেন।

২০১৬ সালের ১১ মে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির দাবিতে আয়োজিত মহাসমাবেশে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি আরেফিন সিদ্দিক, বিশেষ অতিথি সাংসদ নবী নেওয়াজ, সাংসদ গোলাম মোস্তফা এবং বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্ট্রের সদস্য সচিব শাহজাহান আলম সাজু। অতিথিরা অচিরেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হবে বলে শিক্ষক-কর্মচারীদের আশ্বস্ত করেন।
২০১৭ সালের ১৬ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির ত্রাণ ও সমাজ কল্যাণ সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী ও শিক্ষা সম্পাদক শামসুন্নাহার চাঁপা শিক্ষকদের সমাবেশে আগামী বাজেটে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হবে বলে ঘোষণা দেন।

২০১৮ সালের ৫ জানুয়ারি জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে আমরণ অনশন ভাঙাতে এসে শিক্ষা সচিব সোহরাব হোসেন, প্রধানমন্ত্রীর ভারপ্রাপ্ত সচিব সাজ্জাদুল হাসান ও ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে দাবি মেনে নেওয়ার ঘোষণা দেন। এই ঘোষণার প্রেক্ষিতে বিভাগীয় শহরগুলোয় মহাজোটের জাতীয় ও স্থানীয় নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে আমন্ত্রিত অতিথিরা ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যা বলেন তা করেন’ বলে শিক্ষক-কর্মচারীদের আশ্বাস প্রদান করেন। এরপর অনলাইনে আবেদন গ্রহণ করা হয়। বিগত অর্থমন্ত্রী এবং শিক্ষামন্ত্রী উভয়েই গত বছরের জুলাই থেকে বেতন কার্যকর হবার কথা বলেছিলেন । কিন্তু তা হয়নি। কথা না রাখার আরো উদাহরণ দেওয়া যায়। তাতে এ লেখা কেবল দীর্ঘ হবে।
মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তি এমন একটি ইস্যু যাকে পাস কাটানোর কোন উপায় নেই। সরকার ২০৩০ সাল নাগাদ টেকসই উন্নয়নের

লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে চায়। চায় সকলের অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষাব্যবস্থা। সেই লক্ষ্য অর্জন করতে হলে অবশ্যই স্বীকৃতিপ্রাপ্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির সুরাহা করতে হবে। শিক্ষকদের বেতনপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে। নতুন শিক্ষামন্ত্রী এবং অর্থমন্ত্রী উভয়েই এমপিওভুক্তির বিষয়ে সচেতন। সংসদ সদস্যরাও এ বিষয়ে সোচ্চার। আমরা আশা করি, আর কথার কথা নয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির বিষয়ে অচিরেই কোন সিদ্ধান্ত পরিপত্র, প্রজ্ঞাপন কিংবা গেজেট আকারে প্রকাশিত হবে।

শরীফুজ্জামান আগা খান (শিক্ষক ও গবেষক)

আমাদের বাণী-আ.আ.হ/মৃধা

[wpdevart_like_box profile_id=”https://www.facebook.com/amaderbanicom-284130558933259/” connections=”show” width=”300″ height=”550″ header=”small” cover_photo=”show” locale=”en_US”]

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।