একজন মানুষের বৈশিষ্ট হিসাবে চরম জাতীয়তাবাদ উগ্রবাদীতার একটি নাম। এটি এমন কিছু শিখায়, যা এক গ্রামের সাথে আর এক গ্রামের; এক জেলার সাথে আর এক জেলার; এক বিভাগের সাথে আর এক বিভাগের; এক দেশের সাথে আর এক দেশের; এক মহাদেশের সাথে আর এক মহাদেশের; এমনকি এক বংশের সাথে আরেক বংশের; এমনকি এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে অন্য শিক্ষা প্রতিষ্টানের বিবাদ সৃষ্টি করে।

এটি সংকীর্ণ পরিসরে মানুষকে আবেগী, আর ছোট মনের মানুষ করে তোলে।মাঝে মাঝে এমনও হয়, স্বার্থের জন্য অযৌক্তিক কিছু কথা আর দাবি কে চরম যৌক্তিক আর অধিকার বলে প্রতিষ্টিত করে। আমি একটি তুলনা করতেই পারি এ বিষয়ে, “ধরুন আপনার সর্দি আর এর জন্য রিমিডি পেতে আপনি বাবার কাছে সাহায্য চাচ্ছেন, ঠিক একই সময় আপনার চাচাত ভাই ব্রেইন ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত। সেও আপনার বাবার কাছে সাহায্য চাচ্ছে, এখন তার ক্যান্সার রোগ সাড়তে সাহায্য করায়, আপনি ঈর্ষান্বিত হয়ে বলছেন চাচাত ভাইকে ক্যান্সার চিকিৎসায় সাহায্য করাকে দোষারোপ করছেন, বলছেন তাকে সাহায্য করাতে আপনার সর্দির চিকিৎসা ঠিক মত হচ্ছে না। যদিও আপনার বাবা আপনার ঠান্ডা সমস্যার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিচ্ছেন।’

আমাদের ঢাবিয়ান ভাইদের আর সাত কলেজের ভাইদের মধ্য চলমান বিবাদকে আমি এমন উগ্র জাতীয়তাবাদকেই দায়ী করছেন।

এমন অনেক মহান ছাত্র নেতা আছেন, যারা নিজ অঞ্চল প্রভাব ধরে রাখতে এই উগ্র জাতীয়তাবাদকেই সমর্থন করছেন, কখনো বক্তব্যে কখনো মৌন সমর্থন দিয়েছেন দল মত নির্বিশেষে অনেক নেতা; অথচ তাদের অনেককে সর্বজনীন ছাত্রনেতা হিসাবেই ছাত্রসমাজ স্বপ্ন দেখত। কিন্তু তারা সে সর্বজনীন গ্রহনযোগ্যতা ধরে রাখার পরীক্ষায় ফেল করলেন বলেই আমার ধারণা।

ঢাবিয়ানরা যেটি করল, একটি ছোট ঘামাচি উঠেছে দু পায়ের মাঝে। সেটিকে খামচিয়ে খামচিয়ে বড় ফোড়ায় পরিণত করল।
অথচ, প্রধানমন্ত্রী আর দেশের শিক্ষাবিদরা মনে করেন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অধীনে কলেজগুলোকে নিয়ে আসা গেলে শিক্ষার মান উন্নত হবে।

এটি কিন্তু আমাদের আবিষ্কৃত কোন মডেল নয়, মোটেও এটি নতুন আবিষ্কৃত মডেল নয়। এটি যেমন কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় করে আসছে, তেমনি করে আসছে অক্সফোর্ড এর মত বড় বড় সব বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্বের মোটামুটি সব ভালো বিশ্ববিদ্যালয়েই অধিভুক্তির বিষয়টি আছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও কমবেশি ১০০ এর মত অধিভুক্ত প্রতিষ্ঠান আছে। সে আদর্শ মডেলকে অনুসরণ করেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীসহ শিক্ষাবিদরা অধিভুক্তির বিষয়টি সমর্থন করে আসছেন।

এটি একটি জাতীয় পর্যায়ের একটি দীর্ঘমেয়াদী সিদ্ধান্ত। কিন্তু একটা চক্র এই সিদ্ধান্তকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে, এ যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত যেন বাস্তবায়ন না হয় সে জন্য উঠে পড়ে লেগেছে।

দেশব্যাপী যে জাতীয় পরিকল্পনা ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে কলেজগুলোকে যুক্ত করবে শিক্ষার সামগ্রিক মানোন্নয়নে, তা এক বড় ধাক্কা খাবে প্রতিটি ধাপে, ঢাবি হতে শিক্ষা নিয়ে জাবি চাইবে তাদের অধীনে কোন কলেজকে না দেওয়া হোক।
চবি চাইবে তার অধীনে কোন কলেজকে অধিভুক্ত করা না হোক।

তাহলে শিক্ষাবিদদের পরামর্শে বিশ্বের বড় বিশ্ববিদ্যালয়কে অনুসরণ করে যে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রধানমন্ত্রী উদ্যোগ নিলেন তা কি ব্যার্থতায় পর্যবেশীত হচ্ছে..? এ উত্তর সময় বলে দেবে।

গতকাল যে ছেলেটির “সালেহ উদ্দিন সিফাত” ভিডিও “সাত কলেজকে নিয়ে কটূক্তি” ভাইরাল হলো তার একটি শিবিরি সংশ্লিষ্ট থাকার ছবি আমার নিকট আসায় আমি বিস্মিত হই নি, কেন হই নি! এধরণের আন্দোলনে সব শ্রেনীর মানুষ থাকাটায় স্বাভাবিক।

সাত কলেজের সমস্যাটা কোথায় বলে আমি মনে করি।

প্রথমত, তাদেরকে গণহারে ফেল করানো; দ্বিতীয়ত, ত্রুটিপূর্ণ ফলাফল; তৃতীয়ত, সেশনজট।

এই তিন সমস্যা সমাধানের দাবি জানাতে গিয়ে সিদ্দিক চোখ হারিয়েছে, মিতু আত্মহত্যা করেছে, লক্ষাধিক ছেলে মেয়ের জীবন হতে ২-৩ বছর নষ্ট হয়েছে। এগুলোকে আপনারা কি ভাবে বিচার করবেন জানিনা কিন্তু, মিতুর বিষয়টি অবশ্যই তদন্তের দাবি রাখে, কারণ মেয়েটি ৩ বিষয়ে শুধু তিন বিষয়ে ফেল করে নাই, মেয়েটি ২ বিষয়ে এ প্লাস ও পেয়েছে।

একটা মেয়ে একই সাথে ২ বিষয়ে এ প্লাস পেয়ে ৩ বিষয়ে ফেল করে কি ভাবে তা তদন্ত ছাত্র শিক্ষকদের সম্মুখেই করা উচিত।
যদি এমন হয় খাতা পুনরায় মূল্যায়নে মেয়েটি ফেল করে নি তাহলে ঐ শিক্ষকদেরকে অবশ্যই বিচারের আওতায় আনতে হবে, কেননা তারা শুধু সাত কলেজের জন্য বিপদজনক নয়, পুরা শিক্ষাব্যাবস্থার জন্য হুমকি। এদের বিচার অবশ্যই করা উচিত আর, মেয়েটির পরিবারকেও আর্থিক জরিমানা অবশ্যই প্রদান করা উচিত।

অধিভুক্ত বাতিলের আন্দোলনের কারণ খুজতে গিয়ে, ঢাবিয়ানদের সাথে উঠাবসায় কিছু তথ্য পেয়েছি, অনেকে বলেছে ৭ কলেজের জন্য তারা টিউশনি পায় না, চাকরিতে গিয়ে সমস্যা হচ্ছে আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে ভুগতে হচ্ছে, ভাইবাতে গিয়ে ৭ কলেজ বেনিফিট পাচ্ছে, এছাড়া ঢাকা শহরে তাদের অন্যতম প্রতিদ্বন্দী ৭ কলেজ, যে “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত” ” ঢাবির সার্টিফিকেট” পাবে এই বিষয়টা তারা মানতেই পারছে না।

তাদের অনেকে বলছে, সাত কলেজের জন্য তাদের সেশন জট হচ্ছে, কিন্তু আমি কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার ১ বছর পর আমার ক্লাসমেটের ছোট বোন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে আমাদের চেয়ে ১ বছর আগে মাস্টার্স করে বের হয়। সুতরাং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেশন জট শব্দটি এক চরম মিথ্যাবাদিতা তার স্বাক্ষী আমি নিজেই দিতে চাই।

ঢাবিয়ানরা যুক্তি তর্ক দিয়ে প্রতিষ্টা করতে চাচ্ছে, অধিভুক্তি বাতিলেই একমাত্র সমাধান।

কিন্তু একজন ছাত্র প্রতিনিধি হিসাবে আমি যা দেখি, ঢাকায় শুধু ঢাবিয়ানরা পোড়াশুনা করতে আসে নাই। দেখতে হবে এখানে পড়তে আসা কয়েক লক্ষ ছাত্র ছাত্রির স্বার্থ। মনটাকে একটু উদার করতে হবে; এই ছেলে মেয়েদের কি হবে আমার জানা নাই, এদের সিংহ ভাগই ৩.০০ এর নীচে সিজিপিএ পাচ্ছে। ভালো প্রতিষ্ঠানগুলোতে তো তারা আবেদনই করতে পারবে না। এই আবেদন করতে না পারার অবস্থা তৈরী যে তাদের প্রতি ষঢ়যন্ত্র নয় তা হেসে উড়ায়ে দেয়া যায়না।

গতকাল একটা ভিডিও দেখলাম, সালেহ উদ্দিন সিফাত নামের এক ঢাবিয়ান অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করে সাত কলেজ নিয়ে বিষাদাগার করছে এক দল অধিভুক্তি বাতিল চাওয়া ঢাবিয়ান ছেলেমেয়েদের মাঝে। আর ঢাবিয়ানরাও আনন্দে ফেটে পড়ছে আর মজা নিচ্ছে। আমার খুব আশ্চার্য লাগল তাদের পক্ষ হতে একজনও এই ঘৃণ্য আচরণের প্রতিবাদ করল না।

অথচ আপনারা দেখবেন, তারা সালেহ উদ্দিন এর বিষ মাখা ঘৃণ্য আচরণের প্রতিবাদ না করলেও আমার এই লিখার অনেক প্রতিবার করবে অনেকেই।

সাত কলেজের ভাইদের সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দিয়েছে ঢাবি প্রশাসন, প্রশাসন সে অনুযায়ী কাজ করছে হয়তো।
একজন ছাত্র প্রতিনিধি হিসাবে আমি সাত কলেজের সমস্যা সমাধানে কিছু স্পষ্ট পরামর্শ দিতে চাই,

প্রথমত, সাত কলেজের গণহারে ফেল করানোর ঘটনায় তদন্ত করে, তাদের ফলাফল রিকভারির ব্যবস্থা করতে পারলে সমস্যার সমাধান হয়।

দ্বিতীয়ত, ফলাফলের দীর্ঘসূত্রিতা কমাতে প্রয়োজনীয় লোকবল বিশেষ ক্ষমতাবলে ১ মাসের মধ্যে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে।

তৃতীয়ত, সাত কলেজের জন্য প্রশাসনিক ভবন নির্মানের কাজ কাগজে কলমে না রেখে ৩ মাসের মাঝে বাস্তবায়ন করা যেতে পারে, না পারলে ৭ কলেজের অর্থায়নে ভাড়ায় নেয়া ভবনে কাজ চালাতে পারে।

চতুর্থত, সাত কলেজের প্রতিটি কলেজে আলাদা প্রশাসনিক অফিস করে কেন্দ্রের কাজের চাপ কমাতে পারে।

সব শেষে, সাত কলেজের ভাইদের বলতে চাই, আপনারা আশাহত হবেন না, আপনারা যে শিক্ষকবৃন্দ দ্বারা শিক্ষা পাচ্ছেন তারা দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ পাওয়া কোন নিম্ন মানের শিক্ষক নন, বিসিএসের মাধ্যমে মেধার প্রমান দিয়ে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ শেষে শিক্ষা দিচ্ছে এসব শিক্ষকগণ।

আপনারা অধিভুক্তি বাতিল বা বাতিল নয় এমন কোন বিবাদে জড়াবেন না। কেউ এমন বিবাদ করতে চাইলে কৌশলে এরিয়ে যাবেন। আমি চাইনা, সালেহ উদ্দিন সিদাতের মত আপনারাও উগ্র আচরণ করেন; কেননা এমন কাদা ছোড়াছুড়িতে শুধু সম্পর্কই নষ্ট হয়, কোন ফল পাওয়া যায় না।

আর ঢাবিয়ান ভাইদের বলতে চাই, কোন কোন দিক বিবেচনায় সাত কলেজের অধিভুক্তি বাতিল আপনাদের নিকট যৌক্তিক হতেই পারে। আপনারা আন্দোলন করুন, কিন্তু অধিভুক্তি বাতিল চাওয়ার আন্দোলনে সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের নিয়ে কতূক্তি করা, সাত কলেজ মানান কি বেমানান, ঢাবির শাখা আছে কি নাই, এমন স্লোগান দিয়েন না; পাশাপাশি সাত কলেজের গাড়িতে আপনাদের আন্দোলনের পোস্টার লাগানো মোটেই শোভনীয় নয়। কারণ বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে হলে মনটাও তো বড় করতে হবে।

লেখক
মো: তারেক রহমান
সাবেক শিক্ষার্থী
ব্যবস্থাপনা শিক্ষা বিভাগ (৪র্থ ব্যাচ)
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।