মহান মে দিবস উপলক্ষে আজ সকাল ৯ টায় নারায়ণগঞ্জ ২ নং রেল গেইটে সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্ট জেলার উদ্যোগে শ্রমিক সমাবেশ ও শহরে লাল পতাকা মিছিল অনুষ্ঠিত হয়।

সমাবেশে প্রধান বক্তার বক্তব্য রাখেন বাম গণতান্ত্রিক জোট কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক ও বাসদ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য কমরেড বজলুর রশীদ ফিরোজ। সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্ট নারায়ণগঞ্জ জেলার সভাপতি আবু নাঈম খান বিপ্লব এর সভাপতিত্বে সমাবেশে আরো বক্তব্য রাখেন সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্ট কেন্দ্রীয় কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি কমরেড আব্দুর রাজ্জাক, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ নারায়ণগঞ্জ জেলার সমন্বয়ক কমরেড নিখিল দাস, গার্মেন্টস শ্রমিক ফ্রন্ট নারায়ণগঞ্জ জেলার সভাপতি সেলিম মাহমুদ, সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্ট নারায়ণগঞ্জ জেলার সহ-সভাপতি এম এ মিল্টন, গার্মেন্টস শ্রমিক ফ্রন্ট নারায়ণগঞ্জ জেলার সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম গোলক, রি-রোলিং স্টিল মিলস শ্রমিক ফ্রন্ট নারায়ণগঞ্জ জেলার সভাপতি জামাল হোসেন, সাধারণ সম্পাদক এস এম কাদির, গার্মেন্টস শ্রমিক ফ্রন্ট নারায়ণগঞ্জ জেলার সহ-সভাপতি সাইফুল ইসলাম শরীফ ।

কমরেড বজলুর রশীদ ফিরোজ বলেন, আজ থেকে ১৩৩ বছর আগে ১৮৮৬ সালে আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেটে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত কাজ নয়, ৮ ঘণ্টা কাজ-এই দাবিতে আন্দোলন গড়ে ওঠেছিল। এ আন্দোলন করতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে আর মিথ্যা অভিযোগে ফাঁসিতে জীবন দিয়েছিলেন শ্রমিকনেতা অগাস্ট, স্পাইজ, এঞ্জেলস, ফিসার। মালিক এবং সরকার ভেবেছিল ফাঁসি দিয়ে শ্রমিক নেতাদের হত্যা করে আন্দোলন দমন করা যাবে। কিন্তু ন্যায্য দাবিতে গড়ে উঠা আন্দোলন হত্যা ও নির্যাতনের মাধ্যমে দমন করা যায় নাই। এ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীর দেশে দেশে। পরবর্তিতে ১৮৮৯ সালে বিশ^সাম্যবাদী আন্দোলনের নেতা ফ্রেডরিক এঙ্গেলসের নেতৃত্বে ‘দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের প্যারিস কংগ্রেসে’ প্রতিবছর ১ মে আন্তর্জাতিক বিক্ষোভ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত হয়। ১৮৯০ সালের নিউইয়র্কে প্রথম মে দিবসের সমাবেশের প্রস্তাবে লেখা হয়, ‘৮ ঘণ্টা কাজের দিনের দাবিপূরণের সংগ্রাম আমরা চালিয়ে যাবকিন্তু কখনো ভুলবো না, আমাদের শেষ লক্ষ্য হল (পুঁজিবাদী) মজুরি ব্যবস্থার উচ্ছেদ সাধন’। তারপর থেকেই ৮ ঘণ্টা কাজ, ন্যায্য মজুরি আর পুঁজিবাদ উচ্ছেদের সংগ্রাম একসাথেই চলছে।

তিনি বলেন, মানুষ প্রতিদিন যা কিছু ব্যবহার করে সব কিছুই মানুষের শ্রমে তৈরি। শ্রমিক কাজের বিনিময়ে মজুরি পায় আর মালিক শ্রমিককে কাজ করিয়ে মুনাফা অর্জন করে। কার্ল মার্কস হিসেব করে দেখিয়েছিলেন, শ্রমিকের মজুরি যত কম দেবে এবং যত বেশি সময় কাজ করাবে, মালিকের মুনাফা ততই বাড়বে। তাই আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে গড়ে উঠা আন্দোলনে যে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল তারা চেয়েছিল এমন মজুরি যাতে সে মানসম্পন্ন জীবনযাপন করতে পারে, সন্তানদের লেখাপড়া করাতে পারে, অসুখে চিকিৎসা, মাথা গোঁজার ঠাঁই নির্মাণ, বৃদ্ধ বয়সে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে পারে। ন্যায্য মজুরি না পেলে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেও শ্রমিকের জীবনে স্বস্তি আসবে না। মাস শেষে মজুরি পেয়ে বাড়িভাড়া, দোকানের বাকি পরিশোধ করতে না করতেই আবার দেনায় জর্জরিত হয় শ্রমিক। যেহেতু শ্রমিককে যতটুকু মজুরি কম দেয় মালিকের মুনাফা তত হয়। তাই শোষণমূলক ব্যবস্থা বহাল রেখে ন্যায্য মজুরি আদায় করা সম্ভব হবে না। যে কারণে ন্যায্য মজুরির আন্দোলন আর শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম একসাথেই করতে হবে।

কমরেড ফিরোজ বলেন, বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি বাড়ছে ৭.৫ শতাংশের বেশি, মাথাপিছু আয় এখন ১১৯০৯ ডলার, (৮৪ টাকা ডলার ধরলে ৫ সদস্যের একটি পরিবারে মাসিক আয় ৬৬ হাজার টাকার বেশি হওয়ার কথা)।কিন্তু শ্রমিকদের ৮-১০ হাজার টাকা আয় করতে হলে দিনরাত পরিশ্রম করতে হয়। বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশ, পৃথিবীর বহুদেশ বাংলাদেশকে এখন উন্নয়নের মডেল হিসেবে প্রশংসা করছে-এ সমস্ত কথা আমরা সরকারের কাছ থেকে প্রতিদিন শুনছি। কিন্তু বাংলাদেশের এই উন্নতির পিছনে প্রধান শক্তি যে শ্রমিক তারা কেন পৃথিবীর সবচেয়ে কম মজুরি পায় সে প্রশ্নে শাসকশ্রেণি নীরব। গার্মেন্টস, নিটÑসুয়েটার, রি রোলিং, পাট, চা, তাঁত, যানবাহন চালকসহ পরিবহনশ্রমিক, মোটর মেকানিক, বই বাঁধাই ও প্রেসশ্রমিক, রিক্সা চালক, দোকান, হোটেল কর্মচারী, কৃষিশ্রমিক, জেলে ও পাদুকা শ্রমিকরা মানসম্পন্ন জীবনযাপনের মতো মজুরি থেকে বঞ্চিত।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে কৃষি, শিল্প ও সেবাখাত মিলে ৬ কোটি ৩৫ লাখ শ্রমিক দিনরাত পরিশ্রম করেও নিজেদের দারিদ্র্য দূর করতে পারছে না অন্যদিকে কয়েক লাখ কোটিপতির জীবনে বিলাসিতার শেষ নেই। শ্রমিকদেরকে শোষণ করেই তাদের এই সম্পদ সৃষ্টি হয়েছে। শ্রমিকরা সচেতন হলে এই অন্যায় শোষণমূলক ব্যবস্থা পাল্টানোর সংগ্রাম করবেই, এটা মালিকরা জানে। ট্রেড ইউনিয়ন হলো শ্রমিকদের স্কুল, যেখানে সে অধিকার সচেতন হবে ও লড়াই করতে শিখবে।সে কারণে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার পথে নানা জটিলতা সৃষ্টি করে রেখেছে। শ্রম আইন, বিধিমালা, প্রশাসন, পুলিশ, মাস্তান, দালালদের ব্যবহার করে মালিক পক্ষ শ্রমিকদের সংগঠিত হতে বাধা দেয়। কারণ তারা জানে যে, সংখ্যায় বেশি হলেও অসংগঠিত শ্রমিক সব সময় দুর্বল ও অসহায়।

কমরেড ফিরোজ আরও বলেন, আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করলে শ্রমিকের শ্রম সময় কমানো যায় এই কথা বলে সমাজতান্ত্রিক দেশে ৬ ঘণ্টা কর্ম দিবস করা হয়েছিল। অথচ বাংলাদেশসহ পুঁজিবাদী দেশগুলোতে ওভার টাইম না করলে সংসার চালানো কঠিন। তাইধনিকশ্রেণির রাষ্ট্রগুলো মে দিবসের চেতনা ভুলিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু সারা দুনিয়াতে শ্রমিকরা শত নির্যাতন মোকাবেলা করেও মে দিবস পালন করে। মে দিবস এই শিক্ষা দেয়-শ্রমিকের দাবি যতই ন্যায্য হোক না কেন, লড়াই করা ছাড়া তা আদায় করা যায় না। মালিক এবং পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের কাছে দয়া বা করুণা চেয়ে অধিকার প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। শোষণ উচ্ছেদ করেই কর্মঘণ্টা কমানো এবং ন্যায্যমজুরির দাবি আদায় করা সম্ভব।

[wpdevart_like_box profile_id=”https://www.facebook.com/amaderbanicom-284130558933259/” connections=”show” width=”300″ height=”550″ header=”small” cover_photo=”show” locale=”en_US”]

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।