মোঃ নূরুন্নবী ইসলাম; বিশ্ববিদ্যালয় একটি বৃহৎ উৎপাদন যন্ত্র। আরো সহজ করে বললে এটি এমন একটি লাভ জনক কারখানা যেখানে বিনিয়োগ করলে কখনই লাভ ছাড়া ক্ষতি হয় না। এই জন্য বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও চাই বিশেষ দক্ষতা আর পরিকল্পনা। আবার বিশ্ববিদ্যালয়কে রাষ্ট্রের মাথাও বলা যায়। মাথা ঠিক না থাকার অর্থ যেমন পাগল হওয়া তেমন দেশের বিশ্ববিদ্যালয় ঠিক না থাকার অর্থ দেশের জন্য তা অশনী সংকেত। সময়ের সাথে সাথে যে ভাবে একটি রাষ্ট্রকে মানিয়ে চলতে হয় আর কিভাবে তা মানিয়ে চলতে হবে সেটি নির্দৃষ্ট করতে পারে বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু নিরাশার কথা হচ্ছে এই লাভজনক প্রতিষ্ঠান আজ অলাভজনক হয়ে পড়েছে। যে গতি আর গন্তব্যে চলার কথা তা আজ ভিন্ন ধারায় প্রভাবিত হয়েছে। একজন বিমানের চালক চাইলেই বাস চালাতে পারবে না বা একজন টেক্সি চালক চাইলেই মোটর সাইকেল চালাতে পারে না। একই প্রকৃতির কাজ হলেও তার ভিতর বিশেষ ভিন্নতা তাকে আলাদা উচ্চাতায় নিয়ে যায়। পারা আর ভালোভাবে পারার মাঝে পার্থক্য আছে।বিশ্ববিদ্যালয়কে তার জায়গায় নিয়ে যাবার সময় এসেছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কি তার নিজের সম্মানজনক আর প্রত্যাশার জায়গা ধরে রাখতে পারবে?

ট্রাম্প কেন নির্বাচিত হলো, অং সান সূচির আচরণ কেমন হওয়া উচিত ছিলো, ভারতের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রভাব বাংলাদেশে কি হবে, রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের সমস্যা নাকি সম্ভাবনা, মুজিববর্ষ পালনের স্বার্থকতা কি, রাজনৈতিক ব্যবস্থার সাথে অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সম্পর্ক কি এসব জানা থাক বা না থাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তাতে কদর কমে না আবার কমেও। জাপানের প্রযুক্তিতে উন্নতি,ইরানের সামরিক শক্তি, অস্ত্র ব্যবসার এপিট-ওপিট হয়ত শিক্ষার্থীর জানা প্রয়োজন নাই কিন্তু প্রয়োজন তো তবুও আছে। বিশ্ববিদ্যালয় কি, কেন আর কোথা থেকে হয়ত এই ইতিহাস না জেনেও অনেক কিছু করা যাবে কিন্তু যারা অনেক কিছু করার পথ তৈরী করবে তারা যদি সত্য না জানে তাহলে তাদের মাধ্যমে সঠিক পথ নির্দেশ করা সম্ভব না। রাষ্ট্রকে পরিপুষ্ট করতে পরিপুষ্ট গবেষণা দরকার যা একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমেই সম্ভব।

সময়ের সাথে সাথে সামাজিক, রাজনৈতিক ও পরিবেশগত পার্থক্যসহ নানা রকমের পার্থক্য তৈরী হয় । যারা সরকার গঠন করে বা যারা সংসদে বসে আইন তৈরী করে তারা সমাজের এ পরিবর্তনগুলো নিয়ে কাজ করে না তাদের সে সময় সুযোগও থাকে না। তারা হয়ত সঠিক জানেই না কোন অবস্থায় কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে । ধরেন, দেশে দশ বছরের মধ্যে বড় ধরণের অথনৈতিক বিপর্যয় নামার সম্ভাবনা আছে। এই সংবাদ তারাই জানবে যারা আর্থ-সামাজিক অবস্থা নিয়ে ভাবে। বাইরের কোন দেশ আমাদের উপর অবৈধ কিছু চাপিয়ে দিতে চাচ্ছে তার সঠিক ব্যাখ্যা করার জন্য অবশ্যই উপযুক্ত লোক লাগবে। বিশ্ববিদ্যালয় এই কাজ গুলো করে থাকে। সময়ের সাথে সাথে কোন কোন পরিবর্তন হয়েছে এবং তার সাথে মানিয়ে নেবার জন্য কি কি করা দরকার তা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার মাধ্যমেই বেরিয়ে আসে। বিশ্ববিদ্যালয়কে তার নিজের জায়গায় রাখলে সমাজের সমস্যাগুলো সমাধান অতি দ্রুত আসবে। বাজেট সমস্যা, উৎপাদন সমস্যা, নিরাপত্তার সমস্যা, কাজের সমস্যা ও পরিবেশের সমস্যাসহ সকল ধরণের সমস্যার সকল সমাধান বেরিয়ে আসবে ।এই কাজগুলো আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়কে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিনত করবে । এজন্য সরকারের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া উচিত যাতে করে গবেষণা করার সকল রকমের উপাদান পাওয়া যায়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪ বছরের শিক্ষা জীবন এমন হবে যেন তাতে কমপক্ষে ৩ বছরের ব্যবহারিক জ্ঞান অর্জিত হয়। একজন শিক্ষার্থীর পিছনে বর্তমানেও যে টাকা খরচ করা হয় তা সঠিক প্রকিয়ায় ব্যাবহার হলে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আর বেকার বের হবে না বরং বের হবে দক্ষ জনশক্তি।যারা ঝুকি নিয়ে কাজ করবে। দেশে নতুন নতুন খাত তৈরী হবে, রাষ্ট্রের উদ্দেশ্যে সফল হবে, সরকারের কাজ হবে সহজ। সব কিছুর কিছু কিছু জানার চেয়ে একটা কিছুর সব কিছুই জানা হবে লক্ষ্য। এই লক্ষ্য নিয়ে কাজ করলে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বের দরবারে সুনাম কুড়াবে। আর তাই প্রত্যেকটি বিষয় ভিত্তিক খাতকে সাজালে সামান্য ত্যাগ অসামান্য সুফল এনে দিবে।

আমরা বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার জন্য নিচের সুপারিশগুলো গ্রহণ করতে পারি। আশা করি এই পরিবর্তনগুলো ইতিবাচক হবে,

১. বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় বা অন্য যে কোন পেশায় নামে বা বে-নামে যুক্ত হওয়া যাবে না।
২. বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা বা বিভিন্ন দল-উপদল কোন্দল বন্ধ করতে হবে।
৩. শিক্ষকদের টিভি টকশো বা পত্রিকায় শুধুমাত্র উপস্থিতি থাকবে তার গবেষণাপত্র নিয়ে, তার নতুন আবিস্কার নিয়ে।
৪. নতুন পুরাতন যাই হোক না কেন বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষকদের শতভাগ আবাসন থাকবে এবং তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞানের বিশাল ক্ষেত্র ছেড়ে অন্য কোথাও বসবাস করতে পারবে না।
৫. ক্লাসে হাজিরার বিষয়টি বাদ দিতে হবে বরং শিক্ষকের ক্লাসের মান এমন করতে হবে যে শিক্ষকের ক্লাস করতে পারলে ছাত্ররা তৃপ্ত হবে।
৬. ছোট খাট ইস্যু তৈরী করে যখন তখন মিটিং করা বন্ধ করতে হবে।এবং শিক্ষার্থী সংশ্লিষ্ট ইস্যুতে তাদের সহকারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
৭. প্রত্যেক শিক্ষকের আলাদা আলাদা রুম না রেখে সাধারন রুম রাখতে হবে এবং গবেষণা বা ক্লাস প্রস্তুতির জন্য গ্রন্থাগারের সুবিধা বাড়াতে হবে। গ্রন্থাগার তার পড়ার সুযোগ তৈরী করবে।
৮. শিক্ষকদের পড়ানোর বিষয়ে এবং গবেষণার বিষয়ে বিশেষ তদারকি থাকতে হবে।
৯. শিক্ষক তার ছাত্রসহ প্রতি মাসে ১টি করে গবেষণাত্র অবশ্যই তৈরি করবে
১০. বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের একই বিষয়ভুক্ত শিক্ষাথীদের মাধ্যমে থিসিস এবং অ্যান্টি থিসিস তৈরী এবং আলোচনা ব্যবস্থা রাখতে হবে।
১১. শিক্ষক নিয়োগ শুধুমাত্র ফলাফলের ভিত্তিতে নয় বরং সে বিষয়ে তার জ্ঞান, গবেষণা এবং শিক্ষকতায় তার আগ্রহ কেমন তার দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
১২. প্রত্যেক শিক্ষকের আসার ও যাবার সময়ে বাধ্যবাধকতা থাকবে।
১৩. পরীক্ষার উত্তরপত্র মূল্যায়ন বা ফলাফল তৈরীর বিষয়টি উক্ত প্রতিষ্ঠানের হাতে না রেখে অন্য প্রতিষ্ঠানে রাখতে হবে।যা ইউজিসি বা অন্য কোন কর্তপক্ষের মাধ্যমে হতে পারে।
১৪. শিক্ষা সফরের পরিবর্তে কাজ শিখানোর জন্য ও ব্যবহারিক জ্ঞানের জন্য ‘কর্মশালা ট্যুর’ দিতে হবে।
১৫. ছাত্রদের লেজুড়বৃত্তি ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করতে হবে।
১৬. প্রত্যেকটি ছাত্রকে তার নতুন চিন্তা বা উদ্ভাবন বিষয়ে প্রতি দুই মাস অন্তর প্রয়োজনীয় কাগজ জমা দিতে হবে।
১৭. প্রত্যেকটি গবেষণা অবশ্যই বাংলায় হবে এবং কেউ চাইলে ইংরেজি অনুবাদসহ দিতে পারে।
১৮. বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় ছুটিতে তাদের এলাকা ভিত্তিক নতুন কাজ দিতে হবে।
১৯. শিক্ষার্থীদের মাঝে টিউশন নির্ভর আয় নয় বরং কৃষি ক্ষেত্রে, কারখানায় বা অন্য যে কোন শারীরিক পেশার সাথে যুক্ত করতে হবে।
২০. বিশ্ববিদ্যালয়ের খাবার মেনুগুলো হবে সুষম খাবারের তালিকা অনুযায়ী।
হয়ত একদিনে এত কাজ করা সম্ভব হবে না বা রাতারতি পরিবর্তন সম্ভব নয় তবুও উদ্দ্যোগ নিলে কঠিন কাজটিও অনেক সহজ হয়ে যাবে। নিজেদের অস্তিত্বের লড়াইয়ে আমরা এই কাজটি করতে পারবো নিশ্চয়ই।

লেখক (এলএল.এম অধ্যয়নরত,), সভাপতি ,বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া

আমাদের বাণী ডট কম/০২ মার্চ ২০২০/এবি 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।