নিজস্ব সংবাদদাতা, বরগুনা; জেলার আমতলী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মনোরঞ্জন মিস্ত্রির কক্ষ থেকে হত্যা মামলার সন্দেহভাজন শানু হাওলাদার নামের এক আসামির অর্ধনগ্ন ঝুলান্ত লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। তবে  নিহত ব্যক্তির পরিবারের অভিযোগ, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল বাশার ও মনোরঞ্জন মিস্ত্রির দাবি করা তিন লাখ টাকা না দেওয়ায় তাকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনায় পুলিশ বলছে শানু হাওলাদার আত্মহত্যা করেছে।

আজ বৃহস্পতিবার (২৬ মার্চ ২০২০) সকাল সোয়া ৬টায় আমতলী থানা হাজতে এ ঘটনা ঘটে।

পরে এ ঘটনায় আমতলী থানার পরিদর্শক মনোরঞ্জন মিস্ত্রি ও ডিউটি অফিসার সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) আরিফুর রহমানকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।

নিহতের স্বজনদের অভিযোগ, উপজেলার গুলিশাখালী ইউনিয়নের পশ্চিম কলাগাছিয়া গ্রামে গত বছরের ৩ নভেম্বরে ইব্রাহিম নামের এক কৃষক খুন হন। ওই হত্যা মামলায় শানু হাওলাদারের সৎ ভাই মিজানুর রহমান হাওলাদার এজাহারভুক্ত আসামি। ওই মামলায় শানু হাওলদারকে গত সোমবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে সহেন্দভাজন আসামি হিসেবে আমতলী থানা পুলিশ ধরে নিয়ে আসে। পরে আমতলী থানার ওসি আবুল বাশার ও পরিদর্শক (তদন্ত) মনোরঞ্জন মিস্ত্রি আসামির পরিবারের কাছে তিন লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন। কিন্তু ওই টাকা দিতে অস্বীকার করে তার পরিবার।

টাকা না পেয়ে শানু হাওলাদারকে থানা হাজতে রেখে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের নামে নির্যাতন করে। নির্যাতন সইতে না পেরে আসামির ছেলে সাকিব হোসেন গত মঙ্গলবার (২৪ মার্চ ২০২০) ওসি আবুল বাশারকে ১০ হাজার টাকা ঘুষ দেন। কিন্তু তাতে তিনি তুষ্ট হননি। নির্যাতনের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেন। গতকাল বুধবার (২৫ মার্চ ২০২০) পরিবারের লোকজন এসে শানু হাওলাদারের সঙ্গে দেখা করতে চাইলে পুলিশ দেখা করতে দেয়নি। উল্টো পরিবারের লোকজনের সঙ্গে অশ্লীল আচরণ করে তাড়িয়ে দেন, এমন অভিযোগ নিহতের ছেলে সাকিব হোসেনের।

তবে আমতলী থানার ওসি আবুল বাশারের দাবি, আজ সকাল সোয়া ৬টার দিকে আসামি শানু টয়লেটে যাওয়ার কথা বললে পুলিশ তাকে নিয়ে যায়। পরে এক ফাঁকে আসামি শানু হাওলাদার ওসি (তদন্ত) মনোরঞ্জন মিস্ত্রির কক্ষে ফ্যানের সঙ্গে রশি পেঁচিয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন।

খবর পেয়ে বরগুনার পুলিশ সুপার মারুফ হোসেন আমতলী থানায় আসেন। তিনি ঘটনার তদন্তে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অপরাধ) মো. তোফায়েল আহম্মেদকে প্রধান করে তিন সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করেন। পরে দায়িত্বে অবহেলার দায়ে পরিদর্শক (তদন্ত) মনোরঞ্জন মিস্ত্রি ও ডিউটি অফিসার এএসআই আরিফুর রহমানকে সাময়িক বরখাস্ত করেন।

নিহত শানু হাওলাদারের ছেলে সাকিব হোসেন বলেন, ‘বিনা অপরাধে আমার বাবাকে ওসি ধরে এনে তিন লাখ টাকা ঘুষ দাবি করেছে। আমি ওসির দাবি করা ঘুষের টাকা দিতে অস্বীকার করায় আমার বাবাকে নির্যাতন করেছে। বাবার নির্যাতন সইতে না পেয়ে মঙ্গলবার দুপুরে আমি ওসিকে ১০ হাজার টাকা দেই। কিন্তু ১০ হাজার টাকায় ওসি তুষ্ট হয়নি। টাকার জন্য নির্যাতনের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিয়ে বারবার আমার কাছে ঘুষের টাকা দাবি করেন।  বুধবার সকালে আমি বাবার সাথে দেখা করতে থানায় আসি কিন্তু আমাকে দেখা করতে না দিয়ে ওসি আবুল বাশার ও পরিদর্শক মনোরঞ্জন মিস্ত্রি গালাগাল করে তাড়িয়ে দেয়। সারা দিনে আমাকে বাবার সাথে দেখা করতে দেয়নি। ওসি বলেন, টাকা নিয়ে আয় তারপর দেখা করতে দেব।’

শানু হাওলাদারের শ্যালক রাকিবুল ইসলাম বলেন, ‘দুলাভাইকে ধরে আনার পর থেকে আমি থানা প্রাঙ্গণেই ছিলাম। পুলিশ তাকে টাকার জন্য বেধরক মারধর করেছে। তার ডাক চিৎকার শুনেছি। বহুবার চেষ্টা করেছি তার সাথে দেখা করতে কিন্তু পুলিশ দেখা করতে দেয়নি। উল্টো আমাদের সাথে খারাপ আচরণ করেছে।’

নিহত শানুর স্ত্রী ঝর্ণা বেগম বলেন, ‘পাঁচজন পুলিশ যাইয়্যা সোমবার রাইতে মোর স্বামীরে ধইরা আনছে। আনার সময় মোর কাছে টাকা চাইছে। মুই টাকা দেতে রাজি অই নাই হেইয়্যার লইগ্যা মোর স্বামীকে পুলিশে পিডাইয়্যা মাইয়্যা হালাইছে। মুই এইয়্যার বিচার চাই।’ থানার ভেতরে ঝর্ণা বেগম এভাবে বিলাপ করে বারবার মুর্ছা যাচ্ছিলেন।

এ বিষয়ে আমতলী থানার ওসি মো. আবুল বাশার বলেন, ‘আসামি শানু হাওলাদার বৃহস্পতিবার সকাল সোয়া ৬টার দিকে ওয়াস রুমে যাওয়ার জন্য বলে। সে ওয়াস রুম থেকে ফিরে এসে এক ফাঁকে হাজত খানার ফ্যানের সাথে গলায় রশি পেচিয়ে আত্মহত্যা করেছে।  কিন্তু হাজত খানার ভেতরে কোনো ফ্যান থাকার কথা না, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে ওসি আগের কথা পাল্টে বলেন, ‘পরিদর্শক (তদন্ত) মনোরঞ্জনের কক্ষে ফ্যানের সাথে রশি পেঁচিয়ে আত্মত্যা করেছে। ’

তবে ঘুষের টাকা না দেওয়ায় তাকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে বলে স্বজনরা দাবি করছেন, এমন প্রশ্ন করা হলে ওসি বিষয়টি এড়িয়ে যান। নিহত শানু হাওলাদারের লাশ ময়নাতদন্তের জন্য বরগুনা মর্গে পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।

আমাদের বাণী ডট কম/২৬ মার্চ ২০২০/টিএ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।