সাইফুল হক; নানা ধরনের রাজনৈতিক ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাংলাদেশের মানুষ অভ্যস্ত হলেও করোনা মহামারীর মত দেশব্যাপী এরকম স্বাস্থ্যগত দুর্যোগ নিকট অতীতে আর মোকাবিলা করতে হয়নি। দুনিয়ার অনেক দেশের মত আমাদের জন্যেও এই পরিস্থিতি অদৃষ্টপূর্ব। চীন ও পশ্চিম ইউরোপের ক’টি দেশের করুণ অভিজ্ঞতার পর আমাদের প্রস্তুতির জন্য প্রায় দু’মাস যে সময় পাওয়া গিয়েছিল সংক্রমন মোকাবিলায় তাকে আমরা উপযুক্তভাবে কাজে লাগাতে পারিনি।

কোভিড- ১৯ নামক এই ভাইরাসের সংক্রমণ ক্ষমতা সম্পর্কেও আমাদের বিশেষজ্ঞ, ডাক্তার ও নীতি-নির্ধারকদের পরিস্কার কোন ধারণা ছিল না; বরং সরকারের নীতিনির্ধারকদেরও হয়তো বৈজ্ঞানিক অপ্রমাণিত যুক্তি দিয়ে এই ধারণাই দেয়া হয়েছে যে, করোনা ভাইরাস আমাদের জন্য পশ্চিম ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত অতটা বিপজ্জনক ও প্রাণঘাতি হয়ে উঠবে না। উদ্বেগটা এখানে যে, এখনও পর্যন্ত তাদের অনেকের মধ্যে ‘বিপজ্জনক না হয়ে ওঠার’ ধারণাটি বোধ করি যথেষ্ট প্রবল। এই মে মাসকে যখন করোনা সংক্রমনের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক হিসাব বলা হচ্ছে, তখন ‘স্বাভাবিক জীবনযাত্রার’ কথা বলে ‘সীমিত আকারে’ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ঈদের কেনাকাটার জন্য মার্কেট, শপিং কমপ্লেক্স, অফিস আদালত খুলে দেয়া হচ্ছে। একদিকে ভাইরাস থেকে বাঁচতে সাধারণ ছুটির মেয়াদ বৃদ্ধি, লকডাউন, আইসোলেশন আর অন্যদিকে অপ্রস্তুতি ও অপরিকল্পিতভাবে সংক্রমনের ব্যাপক বিস্তারের কালে বস্তুত: অনেক কিছুই উন্মুক্ত করে দেয়া- একদিকে মারাত্মক সমন্বয়হীনতা আর অন্যদিকে স্ববিরোধী ও বৈপরিত্যেরই বহিঃপ্রকাশ। কথা ছিল পরিপূর্ণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে ও শ্রমিক কর্মচারীদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা নিশ্চিত করে ‘সীমিত আকারে’ গার্মেন্টস চালু করা হবে। অথচ এর মধ্যে চাকরী বাঁচাতে অধিকাংশ কারখানাতেই ৯০ শতাংশ গার্মেন্টস শ্রমিক অনিরাপদ পরিবেশে মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়েই কারখানায় যোগ দিয়েছেন; অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ন্যূনতম স্বাস্থ্যবিধির বালাই নেই, শারীরিক দূরত্ব বলেও কিছু নেই।

ফলে আইইডিসিআর এর তথ্যই বলছে করোনার হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত ঢাকা, নারায়নগঞ্জ, সাভার, আশুলিয়া, গাজীপুর, চট্টগ্রামে গার্মেন্টস শ্রমিকদের মধ্যে করোনা সংক্রমন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। আক্রান্ত হচ্ছেন ডাক্তার, নার্স, চিকিৎসাসেবী, সশস্ত্র বাহিনী, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যসহ সমাজের প্রায় সকল অংশের মানুষ। মৃত্যুর তালিকাও দীর্ঘ হচ্ছে। এরকম একটি অবস্থায় প্রবল হুমকির মধ্যে ঈদ কেনাকাটার কথা বলে ‘সীমিত আকারে’ মার্কেট, শপিং কমপ্লেক্স, কিছু অফিস-আদালতসহ বস্তুত: সবকিছু খুলে দেবার সিদ্ধান্ত যে আত্মঘাতি ও প্রকট সমন্বয়হীনতার নজির তা পরিস্কার। ‘সীমিত আকারে’ ‘স্বাস্থ্যবিধি ও শারীরিক দূরত্ব’ বজায় রাখার ঘোষণা যে নেহাত কথার কথা তা কারো অজানা নয়। গার্মেন্টস মালিকদের পর সরকার কি ব্যবসায়ীদের চাপের কাছেও নতি স্বীকার করল- ইতিমধ্যে এই প্রশ্ন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। আবহাওয়া ও বারবার মিউটেশনের মধ্য দিয়ে এদেশে দুর্বল হয়ে আসা করোনা ভাইরাস ও প্রতিকুল পরিবেশে টিকে থাকতে অভ্যন্ত আমাদের মানুষের স্বাভাবিক প্রতিরোধ ক্ষমতা ইত্যকার কথিত বিষয়সমূহ যদি আমাদেরকে পরোক্ষভাবে কোন সহযোগিতা জুগিয়ে না থাকে তাহলে সামাজিক সংক্রমনের ব্যাপক বিস্তারের মধ্য দিয়ে মহামারী যে ভয়ংকর চেহারা নেবে তা সামাল দেবার কোন ক্ষমতাই যে আমাদের নেই গত দু’মাসে তা প্রকটভাবেই ধরা পড়েছে।

৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা রোগি শনাক্ত হবার পর এখনও সংক্রমন পরীক্ষা, পরীক্ষার কীট, ডাক্তার-নার্সসহ সংশ্লিষ্টদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা ব্যবস্থা, অক্সিজেন, ভেন্টিলেশনসহ সমগ্র করোনা চিকিৎসা ব্যবস্থা বেহাল, বিশৃঙ্খল, অকার্যকরি ও গুরুতরভাবে সমন্বয়হীন। ঢাকার দুটো করোনা চিকিৎসার বিশেষায়িত হাসপাতালের পরিস্থিতিও উদ্বেগজনক। আইইডিসিআর, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে রয়েছে বড় ধরনের সমন্বয়হীনতা। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে গঠিত এ সংক্রান্ত জাতীয় কমিটি ও তারপর গঠিত পরামর্শক কমিটির কার্যকারীতাও প্রশ্নবিদ্ধ, তাদের তৎপরতাও দৃষ্টিগোচর নয়। ঢাকার বাইরে করোনা পরীক্ষা ও চিকিৎসার অবস্থা আরো শোচনীয়।

ডাক্তার, নার্সসহ চিকিৎসা কর্মীদের মধ্যে করোনা আতঙ্ক, সিলেটে ডা. মঈন উদ্দীনের মৃত্যুসহ আরো কিছু অনাকাংখিত ঘটনা ও অব্যবস্থাপনা এই আতঙ্ক আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। অধিকাংশ প্রাইভেট হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে এই স্বাস্থ্যগত দুর্যোগ সামাল দেবার কাজে এখনো যুক্ত করা যায়নি। সশস্ত্র বাহিনীর দক্ষতা কাজে লাগিয়ে ও সংশ্লিষ্ট সবাইকে সম্পৃক্ত করে ন্যূনতমভাবে জেলাসমূহে কার্যকরি করোনা হাসপাতালসহ ফিল্ড হাসপাতাল তৈরীর যে সুযোগ ছিল তাও হয়নি। ফলে এশিয়ার মধ্যে করোনা সংক্রমন পরীক্ষা ও সুস্থ্যতায় বাংলাদেশ সবচেয়ে পিছিয়ে। আর করোনা সংক্রমনের এই তিন-চার মাসে সাধারণ চিকিৎসা ব্যবস্থা যেভাবে ভেঙে পড়েছে তা নজিরবিহীন।

এটা অস্বীকার করবার কোন সুযোগ নেই যে, স্বাধীনতার প্রায় পঞ্চাশ বছর পরও আমরা এখনও দেশের মানুষের জন্য কার্যকরি ও টেকসই কোন গণস্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে পারিনি। বাজেটে খুবই অপ্রতুল বরাদ্দই তার নজির। মনুষ্যসৃষ্ট বা যেকোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও মহামারীতে সবচেয়ে অসহায় ও ভঙ্গুর অবস্থায় পড়েন ব্যাপক সাধারণ মানুষ। এই ব্যাপক জনগোষ্ঠির জন্য বা মহামারীজনীত পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য গোটা স্বাস্থ্য ব্যবস্থা যে ঢেলে সাজানো জরুরী- করোনা মহামারী এই ছবকও আমাদেরকে ভালভাবে দিয়েছে। আগামীতে মানবজাতিকে যে আরো নতুন নতুন প্রাণঘাতি ভাইরাসের সম্মুখীন হতে হবে এই আশঙ্কা বিবেচনায় রেখেই সমগ্র স্বাস্থ্যখাতসহ সামাজিক নিরাপত্তা খাতসমূহকে উন্নয়ন পরিকল্পনায় অগ্রাধিকারে নিয়ে আসা জরুরী হয়ে দাঁড়িয়েছে।

মহামারীজনীত পরিস্থিতির উদ্বেগজনক গভীরতা বিবেচনায় রেখে এই স্বাস্থ্যগত জাতীয় দুর্যোগে যে ধরনের সমন্বিত জাতীয় উদ্যোগ ও জাতীয় সংহতি দরকার ছিল তা হয়নি। প্রায় একটা যুদ্ধকালীন সময়ের মত সকল দল, মত ও জনগোষ্ঠিকে ঐক্যবদ্ধ করে যা কিছু সম্পদ ও শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করে দুর্যোগ পরিস্থিতি সামাল দেওয়া ও মানুষকে রক্ষা করার যে জাতীয় কর্তব্য ও সুযোগ তৈরী হয়েছিল সরকার তাকে কাজে লাগাতে পারেনি। এই ধরনের উদ্যোগ গ্রহণের জন্য বিরোধী দল, নাগরিক সমাজ ও জনগণের নানা অংশের পক্ষ থেকে বারবার আহ্বান জানানো হলেও বিস্ময়করভাবে সরকার তাতে সাড়া দিতে ব্যর্থ হয়েছে।

লেখক; সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি

আমাদের বাণী ডট কম/০৭ মে ২০২০/এবিএ 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।