নাটোরের মাহাতাব পাগলা মেসওয়াক সরবরাহের মাধ্যমে রোজাদারদের খুশি করে মানবসেবার এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন । তিনি প্রতি বছর গড়ে ৩০ হাজারের বেশি মেসওয়াক তৈরি করে রমজান মাসসহ অন্যান্য বিশেষ সময়ে বিতরণ করে চলেছেন। স্থানীয় বিভিন্ন মসজিদ আর বাজারে প্রতিদিন শত শত মানুষ বিকাল হলেই অপেক্ষা করতে থাকেন তার মেসওয়াকের জন্য। মাহাতাব পাগলার দাবি, গত ৩০ বছরে তিনি নয় লাখের বেশি মেসওয়াক বিলি করেছেন। বিনিময়ে কারও কাছ থেকে কোনও টাকা বা সুবিধা নেননি। মানুষ তার মেসওয়াক পেয়ে খুশি হন, এতেই তিনি সন্তুষ্ট।

মাহাতাব পাগলার এই ব্যতিক্রমী কাজ এখন নাটোর পেরিয়ে পৌঁছে গেছে অন্যান্য জেলায়। নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলার চকমহাপুর গ্রামের বাসিন্দা মাহাতাব আলী (৫৫)। স্থানীয় মানুষ তাকে আদর করে ‘মাহাতাব পাগলা’ বলে ডাকে। পার্শ্ববর্তী নর্থবেঙ্গল সুগার মিলের আওতায় স্থানীয় কৃষ্ণা কৃষি খামারে তিনি ওয়াচম্যান হিসেবে দিনমজুরির ভিত্তিতে কাজ করেন।

মাহাতাব পাগলা জানান, ছোটবেলায় রমজান মাসে তিনি বাবার সঙ্গে স্থানীয় বাজারে যেতেন। আছরের নামাজের পরে লোকজনের মেসওয়াকের প্রয়োজন হতো। ছোট হিসেবে সবাই মাহাতাবকে পাশের বাগান থেকে মেসওয়াক আনতে বলতেন। মেসওয়াক সরবরাহ করার পর তারা খুব খুশি হতেন। সেই খুশি দেখে তার খুব ভালো লাগত। পরে নিয়মিতভাবেই তিনি রমজান মাসে নিজ উদ্যোগে বিভিন্ন গাছের ডাল দিয়ে মেসওয়াক বানিয়ে রমজান মাসে স্থানীয় মসজিদ ও বাজারের মানুষদের সরবরাহ করতেন। এভাবেই তার মেসওয়াক বিলি করার অভ্যাস গড়ে উঠেছে। বর্তমানে তিনি নিম ও আপাংসহ চার ধরনের গাছের ডাল থেকে মেসওয়াক বানিয়ে তা সরবরাহ করেন। রমজান মাসে প্রতিদিন তিনি ৫শ’ থেকে ৭শ’ মেসওয়াক বিলি করেন।

মাহাতাব দিনমজুরির ভিত্তিতে কাজ করলেও বছরের ছুটি নেন না। সারাবছরের ছুটি জমা রেখে রমজান মাসে নেন। রমজান মাস ছাড়াও ঢাকার টঙ্গিতে বিশ্ব ইজতেমায় ১০ দিন তিনি মেসওয়াক বিলি করেন। রমজান মাসের প্রতিদিন সেহরি খাওয়ার পর থেকে সকাল পর্যন্ত তিনি পরিবারের সদস্যদের নিয়ে মেসওয়াক তৈরি করেন। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিলি করেন। আর ইজতেমার সময় তিনি দশ দিন আগে থেকে মেসওয়াক তৈরি করে প্রায় ৪-৫ বস্তা মেসওয়াক নিয়ে রওনা হন। মেসওয়াকগুলো বিলি করার পরই তিনি বাড়ি ফেরেন।

মাহাতাব পাগলা মনে করেন, মেসওয়াক বিলির মাধ্যমে তিনি মানুষকে খুশি করার মাধ্যমে মানবসেবা করেন। এভাবে মানবসেবার মাধ্যমে তিনি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে চান। মেসওয়াক বিলি ছাড়াও তিনি তার বাড়ির পাশের রাস্তায় নিজ খরচে প্রায় দেড়শ’ তালগাছ লাগিয়েছেন। এছাড়া স্থানীয় বিভিন্ন মসজিদে তিনি ওজু করার জন্য বদনা কিনে দেন। এর বাইরে তিনি মানুষের মাথাব্যথার ওষুধ ফ্রি দেন।এভাবে সারাজীবনই তিনি মানবসেবা করতে চান।

বিষয়টি সম্পর্কে যোগাযোগ করা হলে কৃষ্ণা খামারের প্রধান খায়রুজ্জামান জানান, দিনমজুরির ভিত্তিতে মাহাতাব পাগলা প্রতিদিন ২শ’ ৬০ টাকা করে পান। খামারের আওতায় ৪২টি প্লট রয়েছে যার ব্যাপ্তি ৭০-৯০ বিঘা। এসব জমিতে আখ চাষ করে নর্থবেঙ্গল সুগার মিলে সরবরাহ করা হয়। মাহাতাব পাগলা অন্যান্য ওয়াচম্যানের মতো প্রতিদিন একটি করে প্লট দেখাশোনা করেন।

সদর উপজেলার ভাটোদাঁড়া জামে মসজিদের ইমাম আইয়ুব আলী বলেন, ‘মাহাতাব পাগলা যে কাজটি করে চলেছেন, ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে তার গুরুত্ব অপরিসীম। কেননা, মানুষের সন্তুষ্টিতেই আল্লাহ সন্তুষ্টি– এমন বিধান স্পষ্ট করে বলা রয়েছে কোরআন ও হাদিসে। পাশাপাশি সামাজিকভাবেও এর গুরুত্ব অস্বীকার করার উপায় নেই। প্রতিদিনই একশ্রেণির মানুষ যেখানে ধর্মীয়, রাষ্ট্রীয় বা সামাজিক বিধিনিষেধ অমান্য করে অপরাধ বিস্তারের মাধ্যমে মানুষের অশান্তি সৃষ্টি করে চলেছেন,উৎকণ্ঠায় রাখছেন। সেই সময়ে মাহাতাব পাগলার মেসওয়াক বিলির মাধ্যমে মানুষের সন্তুষ্টি অর্জনের এমন কাজ অত্যন্ত প্রশংসাযোগ্য।’

তিন সন্তানের বাবা মাহাতাব পাগলা লেখাপড়া করতে পারেননি। তার স্ত্রীও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরোতে পারেননি। তারা তাদের মেয়ে মুক্তার বিয়ে দিয়েছেন। বড় ছেলে মধু একাদশ শ্রেণি পাস করে আনসার বাহিনীতে চাকরি করছে। আর ছোট ছেলে স্থানীয় বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণিতে পড়ে। সৌজন্যে বাংলা ট্রিবিউন

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।