বুক ভরা আশা নিয়ে, হৃদয়ের সব উৎসাহ নিয়ে, দুচোখের কল্পনা দিয়ে প্রতিটা মানুষই চায় সে যেন বেকার না থাকে।একটা সময় আমি যখন ছোট ছিলাম ইংরেজিতে কম্পজিশন লিখতাম, বেকারত্ব একটি দেশ ও জাতীর উন্নতি অগ্রগতির পুরোপুরি অন্তরায় উন্নয়নের সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক। আর এই বেকারেরা জাতির জন্য অভিশাপ ও বোঝা স্বরূপ। বেকারত্ব একটি জাতির উন্নতির অন্তরায় হিসেবে ধরা হলেও বাংলাদেশে এর কোন ভ্রূক্ষেপ নাই সরকারের তথাকথিত উন্নয়ন যেমনটা দ্রুতগতিতে এগোচ্ছে ঠিক বেকারত্বের ট্রেন চলছে তার চেয়ে কয়েক শত গুণ দ্রুত। অথচ উন্নত বিশ্বগুলোর মতে, বেকারত্ব বোঝা নিয়ে কোন দেশের উন্নয়ন হয় না উন্নয়ন হওয়া সম্বব না।

একদিকে অর্থনৈতিক উন্নতি। মেগা প্রজেক্ট। বাড়ছে শিক্ষিতের হার। অন্যদিকে, বাড়ছে শিক্ষিত তরুণদের হাহাকার। প্রত্যাশিত চাকরি পাওয়া যেন রীতিমতো যুদ্ধ। বাংলাদেশের কর্মক্ষম ও শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা কত তা নিয়ে অবশ্য বেশ গরমিল লক্ষ্য করা গেছে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সরকারি হিসাব এক রকম, অন্যদিকে আইএলও, জাতিসংঘ ও বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের হিসাব আরেক রকম। এর মধ্যে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সম্প্রতি প্রকাশিত শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী  সারা দেশে বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ ৮০ হাজার। এরমধ্যে ১০ লাখ ৪৩ হাজার শিক্ষিত তরুণ-তরুণী যারা উচ্চ মাধ্যমিক, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস। অর্থাৎ শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা প্রায় ৪০ শতাংশ (পরিসংখ্যান যদিও ২০১৬-১৭ অর্থবছরের) ।

তবে বিবিএস বলেছে, বেকার জনগোষ্ঠীর প্রায় ৮০ শতাংশের বয়স ১৫ থেকে ২৯ বছর।  বিবিএসের হিসাব অনুযায়ী, দেশে ১৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সী কর্মক্ষম মানুষ আছেন ৬ কোটি ৩৫ লাখ। তাঁরা কাজের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত থাকেন। তবে এই হিসাবে, পড়াশোনা করেন কিংবা অসুস্থ কিংবা অন্য কোনো কারণে কাজের জন্য প্রস্তুত নন; তাঁরা এই শ্রমশক্তিতে অন্তর্ভুক্ত হন না। তবে তাঁদের মধ্যে মজুরির বিনিময়ে কাজ করেন ৬ কোটি ৮ লাখ লোক। যদি দেশের মোট জনসংখ্যা ১৮ কোটি ধরা যায় তাহলে মজুরির বিনিময়ে কাজ করা ৬ কোটি ৮ লাখ লোক বাদ দিলে থাকে ১১ কোটি ৯২ লাখ। যদি এখান থেকে শিশু বৃদ্ধ অসুস্থ, কর্মের অযোগ্য প্রাথমিক থেকে স্নাতক পর্যন্ত অধ্যয়রতদের বাদও দেওয়া যায় তাহলে প্রকৃত বেকার সংখ্যা দাড়ায় কত?

বিবিএস এর তথ্য মতেই, দেশে মোট কর্মোপযোগী মানুষের সংখ্যা ১০ কোটি ৯১ লাখ। এর মধ্যে কর্মে নিয়োজিত ৬ কোটি ৮ লাখ মানুষ। বাকি ৪ কোটি ৮২ লাখ ৮০ হাজার মানুষ কর্মক্ষম তবে শ্রমশক্তির বাইরে। এর মধ্যে শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত ও অশিক্ষিত নারী-পুরুষ আছে।

এবার আপনার কথায় আসা যাক, আপনি বছর দুয়েক কিংবা তিনেক আগে মাস্টার্স শেষ করেছেন হন্যে হয়ে চাকরি খুঁজছেন ভাইভার পর ভাইভা দিচ্ছেন আর রিজেক্ট হচ্ছেন তাহলে আপনি কি বেকার? বেকার না ! বাস্তবিক অর্থেই আপনি বেকার কিন্তু দেশের বেকারত্বের সজ্ঞায় আপনি বেকার না শ্রমশক্তির বাইরের লোক।  আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সংজ্ঞা অনুযায়ী আপনাদের মত লক্ষ মাস্টার্স পাশ করা যুবককে  বেকার বলা হচ্ছে না। একটু ঘুরিয়ে বলা হচ্ছে, এরা কর্মের সঙ্গে যুক্ত নয়, এরা শ্রমশক্তির বাইরে। বেকার বলা হচ্ছে ২৬ লাখ ৮০ হাজারকে।

এবার আসা যাক আসন্ন অর্থবছরের বাজেট প্রসঙ্গে।এবারের বাজেটে সম্ভাব্য আকার থাকবে ৫ লাখ ২৪ হাজার কোটি টাকার আশপাশে। প্রতিবছরই এই বাজেট এর আকার বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রতি বাজেটের আগেই বেকারদের নিয়ে এক প্রকার তামাশা করা হয় আশার বাণী শুনিয়ে এই বুঝি তাদের কপাল খুললো বেকারত্ব ঘুচে। বাজেট বাড়ে বেকারদের কপাল আর খোলে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, তিন মাস আগে অর্থাৎ গত ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ৯৩ হাজার ৯১১ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ ১০ হাজার ৮৭৩ কোটি টাকা। এই হিসাবে গত তিন মাসে খেলাপি বেড়েছে ১৬ হাজার ৯৬২ কোটি টাকা। একটা দেশের বাজেটের তিনভাগের এক ভাগ প্রতিবছর খেলাপী ঋণ পরিশোধেই ব্যয় হয় তাহলে বেকারদের কথা ভাববার সময় কোথায়। এই খেলাপী ঋণের চারভাগের একভাগও যদি বেকারত্ব দূরীকরণে ব্যবহৃত হত তাহলে বাংলাদেশের বেকারত্ব ৮০ শতাংশে নামিয়ে আনা সম্ভব ছিল।

বেকারত্বের হাহাকারে যুবকরা চাকরির প্রবেশের বয়স ৩৫ এর দাবিতে আন্দোলন করছে। আন্দোলন করেছে কোটা সংস্কারের। বছরের পর বছর বেতন না পেয়ে শিক্ষকরা থালা হাতে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অনশন করেছে অনশনেও তাদের উপর পুলিশি প্রহার চলেছে, চলেছে জলকামান, কাঁদানো গ্যাসের ঝাঁঝালো ধোঁয়া। ফলাফল শুন্য । এদেশের তরুণদের মনে বেকারত্ব এখন একটা মিশ্র শব্দ। এক আকাশ হতাশা আর এক পৃথিবী টেনশান মিশ্রিত শব্দ এটা। বেকারত্ব একটি নিঃশব্দ হাহাকার। না যায় বলা; না যায় বোঝানো!

এর প্রতিকার কি? কিভাবে বেকারত্ব দূরীকরণ সম্ভব? মনে আছে আরব বসন্তের কথা। বেকারত্বের আগুনে কিভাবে জ্বলেছিল পুরো আরব বিশ্ব। ২০১০ সালের ১৭ ডিসেম্বর নিজের গায়ে আগুন জ্বেলে বিপ্লবের মশাল জ্বেলে দেন তিউনিসিয়ার ফেরিওয়ালা বাওয়াজিজি। ঘুষ, দুর্নীতি, বেকারত্ব, রাজনৈতিক নিপীড়ন ও স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে তা ছিল এক জ্বলন্ত বিদ্রোহ। এই বিদ্রোহের আগুন আরব বিশ্বের তিউনিসিয়া, মিসর, লিবিয়া, ইয়েমেন, বাহরাইন ও সিরিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। বিদ্রোহের সে আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায় স্বৈরশাসক জয়নাল আবেদিন বেন আলীর ক্ষমতার আসন।

এদেশে রাজনৈতিক সেমিনার, টেবিল শো টক শো, রাজনৈতিক দোষারোপ সবই হয় বেকারদের নিয়ে মশকরা করতে প্রকৃত পক্ষে কিছুই হয়না। উন্নয়ন হয় সেতুতে রাস্তায় কালভাটে, লক্ষ কোটি টাকা কালোবাজারে, বছরের পর বছর বাজেট বাড়ে যুবকদের পিষে যায় বেকারত্বের হাহাকারে।

লেখক, সম্পাদক (অনলাইন নিউজ পোর্টাল ‘আমাদের বাণী ডট কম) 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।