ডেস্ক রিপোর্ট, ঢাকা; লোহাগড়া উপজেলার কলাউজান ইউনিয়নের সুকুমার বড়ুয়ার মা রুম্পা বড়ুয়া ২৫ জুন চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে যে নমুনা পরীক্ষার জন্য দিয়েছিলেন গত ৫ জুলাই তার রিপোর্ট এসেছিল নেগেটিভ; কিন্তু পরদিন ২৬ জুন শেভরন ক্লিনিকে নেয়া নমুনার ফলাফলে এলো রোগীর করোনা পজিটিভ। অবশেষে করোনা নেগেটিভ নাকি পজিটিভ সে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার মধ্যেই ৭ জুলাই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন রুম্পা বড়ুয়া। সম্প্রতি করোনা টেস্ট জালিয়াতির অভিযোগে নগরীর শেভরন ক্লিনিককে সিলগালা করে দেয়া হয়। একই অভিযোগে সিলগালা করে দেয়া হয়েছে পাবনার আরেকটি বেসরকারি ক্লিনিক। এ ছাড়া দাতব্য প্রতিষ্ঠান জেকেজি এবং রাজধানীর রিজেন্ট হাসপাতালের করোনার ভুয়া টেস্ট ও সার্টিফিকেট জালিয়াতির খবর দেশ ছাপিয়ে স্থান পেয়েছে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমেও। বিষয়টি নিয়ে দেশ-বিদেশে চরম ইমেজ সঙ্কটে পড়েছে সরকার। ফলে করোনা পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকারকে আরো সতর্ক ও কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

তাদের মতে, করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষায় এমনিতেই বহুমাত্রিক ভোগান্তির মুখোমুখি হচ্ছেন ভুক্তভোগীরা। একজন রোগীর করোনা পরীক্ষার ফলাফল দুই ল্যাবে দু’রকম আসার মতো ঘটনায় ল্যাবগুলো ও করোনা পরীক্ষায় আস্থা হারাচ্ছিল সাধারণ মানুষ। শুরুর দিকে বিনামূল্যে এই সেবা দেয়া হলেও পরবর্তী সময়ে একটি নির্ধারিত মূল্যের বিনিময়ে করোনা পরীক্ষার সিদ্ধান্ত দেয়া হয়। ফলে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর একটি বিরাট অংশ পরীক্ষাবিমুখ হয়ে পড়ে। এমন প্রেক্ষাপটে সম্প্রতি করোনা পরীক্ষার নামে সরকার নির্ধারিত দু’টি প্রতিষ্ঠান রাজধানীর রিজেন্ট হাসাপাতাল এবং জেকেজির প্রতারণা ধরা পড়ে। প্রতারণার অভিযোগে ইতোমধ্যে রিজেন্ট হাসাপাতাল সিলগালা এবং জেকেজির চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহীসহ আরো একাধিক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়। তারা করোনা পরীক্ষার নামে দীর্ঘ দিন ধরে ভুয়া রিপোর্ট দিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। এতে করোনা পরীক্ষার প্রতি ভুক্তভোগী মানুষের আস্থায় চিড় ধরে। পাশাপাশি বাংলাদেশ থেকে করোনা নেগেটিভ সার্টিফিকেট নিয়ে জাপান এবং ইতালি যাওয়া একাধিক ব্যক্তির করোনা পজিটিভ হিসেবে চিহ্নিত হয়। এরপর ১৪৯ জন বাংলাদেশী যাত্রীকে ইতালি বিমানবন্দর থেকে ফিরিয়ে দেয়ার ঘটনা বেশ ফলাও করে বিশ্বগণমাধ্যমে প্রচার হয়। এতে দেশের সাধারণ মানুষসহ বহির্বিশ্বেও বেশ ইমেজ সঙ্কটে পড়ে সরকার। সে জন্য করোনা পরিস্থিতি সামাল দেয়া এবং হারানো ইমেজ পুনরুদ্ধারে সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।

ভুক্তভোগীরা বলছেন, দীর্ঘ ভোগান্তি আর অপেক্ষার পর করোনার স্যাম্পল নেয়া হলেও অনেকসময় সেই পরীক্ষার রিপোর্ট তারা পান না। পজেটিভ নাকি নেগেটিভ সেই এসএমএসও আসে না তাদের। সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দফতরে খোঁজ নেয়া হলেও তার সদুত্তরও দিতে পারে না কর্তৃপক্ষ। আবার কোথাও কোথাও বেশ তড়িঘড়ি করে রিপোর্ট দেয়া হয়। সম্প্রতি করোনা পরীক্ষার নামে প্রতারণার খবরে তড়িঘড়ি করে রিপোর্ট পাওয়াদের সংশয় বাড়ছে।

আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সূত্র মতে, জেকেজি নামক দাতব্য প্রতিষ্ঠান ১৫ হাজার এবং রিজেন্ট হাসপাতাল ১১ হাজারেরও বেশি নমুনা পরীক্ষা করে। এর প্রায় সবই ভুয়া বলে প্রমাণিত হয়েছে। সেই ভুয়া পরীক্ষার মাধ্যমে করোনা সনদ বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় ওই দুই প্রতারক প্রতিষ্ঠান। তাদের বিরুদ্ধে ভুক্তভোগেীদের অভিযোগের শেষ নেই। এরই মধ্যে জেকেজির চেয়ারম্যান ডা: সাবরিনা আরিফ চৌধুরী এবং প্রধান নির্বাহী তার স্বামী আরিফ চৌধুরীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। রিজেন্ট হাসপাতাল সিলগালা করে দিয়ে গ্রেফতার করা হয়েছে ওই হাসপাতালের মালিক এবং আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় আন্তর্জাতিক উপকমিটির সদস্য সাহেদ করিমকেও। দেশ-বিদেশের গণমাধ্যমে এসব খবর ফলাও করে প্রচার হওয়ায় করোনা পরীক্ষার প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলছেন দেশের সাধারণ মানুষ। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও বেশ ইমজে সঙ্কটে পড়েছে সরকার। বৃহস্পতিবার (১৬ জুলাই) এ বিষয়ে প্রতিবেদন করেছে প্রভাবশালী মার্কিন সংবাদমাধ্যম ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’। ‘বাংলাদেশে জাল করোনা সনদ বেচার রমরমা ব্যবসা’ শিরোনামে নিউ ইয়র্ক টাইমস ওই প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে ভুয়া করোনা সার্টিফিকেট দেয়া রিজেন্ট হাসপাতাল, এর মালিক সাহেদ করিম, জেকেজি ও ডা: সাবরিনা-আরিফুল দম্পতির প্রতারণাসহ বাংলাদেশে করোনার বিভিন্ন অব্যবস্থাপনার চিত্র তুলে ধরা হয়।

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একটি অংশের মতে, করোনা টেস্ট জালিয়াতির খবর খানিকটা বিব্রতকর হলেও সেই অপরাধী চক্রকে সরকারই ধরেছে। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। এতে দেশ-বিদেশে বরং সরকারের ইমেজ আরো বেড়েছে।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ এ ব্যাপারে বলেন, করোনা পরীক্ষা নিয়ে প্রতারণা এবং ভুয়া রিপোর্টের খবর বেশ উদ্বেগজনক। এর জন্য দোষীদের কঠোর শাস্তি দিতে হবে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কেও সরকারের ভুলত্রুটি নিরসনের কথা বোঝাতে হবে।

এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘নমুনা পরীক্ষার ভুয়া সনদ এক দিকে আমাদের উদ্বেগ বাড়িয়েছে, অন্য দিকে বিদেশে দেশের ইমেজ নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা তৈরি করেছে। মানুষের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে এ ধরনের অপকর্ম নিন্দনীয় ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আর কোনো প্রতিষ্ঠান যেন এ ধরনের অপরাধ করতে না পারে সে জন্য সংশ্লিষ্টদের নজরদারি বাড়াতে হবে। তবে স্বাস্থ্য খাতে শুদ্ধ অভিযান শুরু হয়ে গেছে। পর্যায়ক্রমে তা গ্রামপর্যায়ে বিস্তৃত হবে। কেউ পার পাবে না।

সূত্র; নয়াদিগন্ত

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।