জন্মলগ্ন থেকেই জ্ঞানের অনুসন্ধান ও তার সংরক্ষণের প্রচেষ্টা মানুষকে প্রকৃতির শ্রেষ্ঠ সৃষ্টিতে পরিণত করেছে। পাথর, গাছের বাকল, পাতা আর পাহাড়ের গুহায় নানাবিধ চিহ্ন বা ছবি এঁকে মানুষ তার জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা সংরক্ষণের যাত্রা শুরু করেছিল। পরবর্তীতে মাটির ফলক, বিভিন্ন উপকরণের মধ্য দিয়ে লিখুন সামগ্রিক উন্নয়ন শুরু হয়। আরো পরে মুদ্রণযন্ত্রের আবিষ্কারের ধারাবাহিকতায় বর্তমানে তা ডিজিটাল প্রযুক্তি ভিত্তিক সংরক্ষণ ধারায় এসে উপনীত হয়েছে। তবে জ্ঞানের বিচ্ছিন্ন সংরক্ষণ সাধারণ মানুষের জন্য ততদিন অর্থবহ পর্যায়ে উপনীত হতে পারেনি যতদিন না তা নিয়মতান্ত্রিকভাবে কোন নির্দিষ্ট স্থানে সংরক্ষণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এ ভাবনা থেকেই উদ্ভব হয় গ্রন্থাগারের ধারণা। যদিও শুরুর দিকে গ্রন্থাগার ছিল শুধুমাত্র প্রার্থনাগৃহ, রাজসভার নিয়ন্ত্রণাধীন। পরবর্তীতে গ্রন্থাগারের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কল্যাণে ব্যবহৃত হতে শুরু করে। জ্ঞান ও সভ্যতার ধারক ও বাহক হিসেবে গ্রন্থাগার এভাবেই জ্ঞান ও সমাজ গঠনে তার ভূমিকা পালন করে এসেছে বা যাচ্ছে।
গ্রিক শব্দ ‘Libre’ থেকে  ‘Library’ শব্দের উৎপত্তি। যার বাংলা অর্থ ‘গ্রন্থাগার’ গন্থাগার হচ্ছে বই-পুস্তক পত্র-পত্রিকা সাময়িকীসহ অডিও ভিজ্যুয়াল সমগ্রীর ভান্ডার, সংগ্রহশালা, সংরক্ষণাগার। পাঠক পাঠাগারে বই পড়তে পারে শর্তসাপেক্ষে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য পড়ার সামগ্রী বাড়িতে নিয়ে গিয়ে পড়তে পারে।
মনীষী ‘কারলাইল’ বলেছেন, গন্থাগার হলো ‘জনগণের বিশ্ববিদ্যালয়’।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সাধারণ অধিশাখা ২০১৭ সালের ৭ নভেম্বর একটি পরিপত্র জারি করে। তাতে বলা হয়, সরকার ৫ ফেব্রুয়ারিকে জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস ঘোষণা করেছে এবং ওই তারিখে জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস হিসেবে উদযাপনের নিমিত্ত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দিবস পালনসংক্রান্ত পরিপত্রের ‘খ’ শ্রেনীভুক্ত দিবস হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে এবং ২০১৮ সাল থেকে প্রথম বাংলাদেশে জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস উদযাপন করা শুরু হয়। অত্যন্ত প্রশংসনীয় একটি উদ্যোগ যা আমরা সাধুবাদ জানাই এবং আমরা সভ্যজাতি হিসাবেও আজ অভিভূত ও গর্বিত।
২৩ এপ্রিল বিশ্ব বই দিবস। জাতিসংঘের ইউনেস্কোর উদ্যোগে ১৯৯৫ সাল থেকে প্রতিবছর এ-দিবসটি পালন করা হয়ে থাকে। বই পড়া, বই ছাপানো, বইয়ের কপিরাইট সংরক্ষণ করা ইত্যাদি বিষয়ে জনসচেতনতা বাড়ানোই বই দিবসের মূল উদ্দেশ্য। স্পেনের লেখক ভিসেন্ত ক্লাভেল আন্দ্রেসের কাছ থেকে আসে বিশ্ব বই দিবসের মূল ধারণাটি। স্পেনের আরেক বিখ্যাত লেখক মিগেল দে থের্ভান্তেস মারা যান ১৬১৬ সালের ২৩ এপ্রিল। আন্দ্রেস ছিলেন তাঁর ভাবশিষ্য। প্রিয় লেখকের সৃষ্টি ও লেখককে স্মরণীয় করে রাখার জন্যেই ১৯২৩ সালের ২৩ এপ্রিল থেকে আন্দ্রেস তাঁর নিজ দেশ স্পেনে বিশ্ব বই দিবস পালন করা শুরু করেন। অবশেষে ১৯৯৫ সালে ইউনেসকো দিনটিকে বিশ্ব বই দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এরপর থেকে বিশ্বের জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলো  প্রতিবছরের ২৩ এপ্রিল বিশ্ব বই দিবস হিসেবে পালন করে আসছে।
লেখক-লেখিকা, পাঠক-পাঠিকাসহ সাহিত্য-সংস্কৃতি অনুরাগী প্রিয় মানুষদের জন্য এটি একটি আনন্দের সংবাদ এবং এটি অনেক বড় পাওয়া!
বই দিবসের প্রতিপাদ্যকে বাস্তবায়ন করতে হলে, আমাদের প্রত্যেকের বাড়ি একটি করে ছোট লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং এটি খুব সহজেই করা যায় এবং সম্ভব। সেটা হলো, আমাদের রাষ্ট্রিয়  বা পারিবারিক যেকোনো অনুষ্ঠান বা উৎসবে কোন কিছু উপহার দিতে হলে সেটা হবে বই। বইয়ের বিকল্প কোন উপহার হতে পারে না। তাহলে প্রতিটা বাড়িতে অনেকগুলো বইয়ের একটা সংগ্রহ থেকে যাবে এবং সেই বাড়িতে একটি শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর থেকেই বইয়ের মধ্য দিয়ে বড় হবে। শিশুর যখন বোল ফুটবে তখন সে বোলে আসবে ‘বই’। সে মাকে জিজ্ঞাসা করবে মা বই কি? তখন মা বইয়ের সঙ্গে তার পরিচিতি করে দেবে এবং বন্ধুত্ব করিয়ে দেবে। এভাবেই একটি শিশু বইয়ের তথা জ্ঞানের  সুগন্ধির মধ্য দিয়েই বড় হতে থাকবে। কিন্তু অদ্ভুত মানুষের অভিরুচি, অদ্ভুত আমাদের বাবা-মা। পিস্তলসহ  বিভিন্ন ভয়ংকর মডেলের খেলনা মারণাস্ত্র শিশু সন্তানদের হাতে তুলে দিচ্ছেন! কেন কোনো আদর্শ খেলনা কি নেই? একটি প্রবাদ আছে, ‘সৎ সঙ্গে স্বর্গেবাস অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ’।
তো মারণাস্ত্র নিয়ে খেলা করলে কি সন্তান শান্তিকামী হবে, নাকি উগ্রপন্থী সন্ত্রাসী হবে? নিশ্চয়ই আদর্শবান হবে না। যার পরিণতি আজ বিশ্ব অশান্তি! সন্তানের হাতে পিতা-মাতাও খুন! এখানে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসতে পারে যে, তাহলে কি যারা উগ্রপন্থী সন্ত্রাসী বা খুন-খারাবি করছে তারা কি সবাই শিশু বয়সে মারণাস্ত্র নিয়ে খেলা করতো? শিক্ষা গবেষক ‘মাসুম বিল্লাহ’ তাঁর “শিক্ষা এবং শিক্ষক প্রাসঙ্গিক ভাবনা” বইয়ের ২৬ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, “আমরা ৪০ শতাংশ যোগাযোগ শ্রবণের  মাধ্যমে করি। ৩৫ শতাংশ বলার মাধ্যমে করি। ১৬ শতাংশ পড়ার মাধ্যমে এবং ৯ শতাংশ লেখার মাধ্যমে করে থাকি”। তো এভাবেই মানুষ শেখে এবং আজকের শিশু যেটা দেখছে শুনছে এগুলোই তার সারা জীবনের উপর প্রভাব ফেলে। এজন্যই বলা হয় আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। অতএব, পিস্তলের খেলায় কখনো শান্তি আসতে পারে না। সময় থাকতে শিশুবান্ধব একটি আদর্শ খেলনাসহ বই তুলে দিতে হবে।
গ্রামে কিংবা শহরে, ধনী-গরীব সকলেরই পারিবারিক অনুষ্ঠানে বন্ধুবান্ধব আত্মীয়স্বজনদের নিমন্ত্রিত করা হয়। সেখানে ভুঁড়িভোজ খেয়ে নগদ অর্থ, স্বর্ণালংকার, টিভি, ফ্রিজ, মোবাইল সেট ইত্যাদি উপহার দেয়া হয়, শুধু দেয়া হয় না একটি বই! প্রেজেন্টেশন বা উপহারসামগ্রী গ্রহণ করার জন্য হোটেলের ম্যানেজারের নেয় চেয়ার- টেবিল খাতা-কলম নিয়ে বসে আছেন কে কি দিচ্ছেন সেটা লিখে রাখার জন্য। যেন রেস্টুরেন্টে খাবার খেয়েছি বিল পরিশোধ করলাম। এই সংস্কৃতি থেকে আমাদেরকে বেরিয়ে আসতেই হবে, হবে বইয়ের সংস্কৃতিতে প্রবেশ করতে। বই থাকবে প্রতিটা ঘরে প্রতিটা রুমে এবং যে জায়গায় সচরাচর বেশি যাওয়া-আসা বসা পড়ে সেই সোফার পাশে টি টেবিলের উপরও বই থাকবে। বই থাকবে হাতের কাছে। হাতের কাছে বই না পেলে অনেক সময় পড়ার এনার্জি বা আগ্রহ নষ্ট হয়ে যায়। দূরে বই থাকার কারণে আলসি করে উঠে গিয়ে বই আনতে মনে চায় না, ফলে পড়াও হয় না।আর হাতের কাছে পেলে দু’পিষ্ঠা হলেও পড়া যায়। ফরাসি ঔপন্যাসিক জ্যঁ-মারি গুস্তাভ ল্য ক্লেজিও বলেছিলেন, “বই হচ্ছে সেই মহামূল্যবান ধন, যা যেকোনো স্থাবর সম্পত্তি কিংবা টাকা-পয়সার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ” গণিত শাস্ত্রের ইতিহাসে যিঁনি আদিপুরুষ বিজ্ঞানী পিথাগোরাস, তিনি বলেছেন, “অর্থের মধ্যে জীবনের প্রকৃত সুখ নেই, জ্ঞানলাভের জন্য জীবনকে উৎসর্গ করবার মধ্যেই প্রকৃত সুখ”। বই পড়ুয়ার কল্পনার জগৎ প্রখর হয়। তিনি কল্পনার জাল বোনেন, তার সে জালে অসংখ্য সৃষ্টিশীল কর্ম এসে আটকে যায়; যা দিয়ে বিশ্ববাসীর জন্য কল্যাণ সাধিত হয়। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী আইনস্টাইল বেলেছেন,’জ্ঞানের চেয়েও কল্পনাশক্তির গুরুত্ব বেশি’। এজন্য বই পড়লে মানুষের কল্পনাশক্তি বাড়িয়ে জ্ঞানের জানালা খুলে দেয়।
লেখক আনিসুল হক সাহেব তাঁর ফেসবুকে লিখেছেন, “আমার ঘোষণা: আমাকে কোনো অনুষ্ঠানে যদি নিয়ে যান, বক্তা হিসেবে, অতিথি হিসেবে, পার্টিসিপান্ট হিসেবে, দয়া করে ক্রেস্ট দেবেন না। ক্রেস্টের বদলে বই দিতে পারেন। আমার বাসা ছোট। ক্রেস্ট রাখব কই? বই দিলে যদি বাসায় না রাখতে পারি, কাউকে দিলেও তো কাজে লাগবে। ক্রেস্ট কোনো কাজে লাগে না। ভালোবাসাই আসল। ক্রেস্ট না। স্কুল কলেজ সংগঠনকে বলি, ক্রেস্ট বানিয়ে টাকা অপচয় করবেন না”। ভাগ্যক্রমে আমিও ক্রেস্ট পেয়েছি, আর দুর্ভাগ্যক্রমে ক্রেস্টের মর্ম এখনো পর্যন্ত  উদ্ধার করতে পারিনি। বই হলে অন্তত পড়তে পারতাম এবং লাইব্রেরীতে রেখে মানুষকে পড়াতে পারতাম। হুমায়ুন আজাদ বলেছেন,”পুরুস্কার অনেকটা প্রেমের মতো, দু’একবার পাওয়া খুবই দরকার, এর বেশি পাওয়া লাম্পট্য।
আজকের বর্তমান বিশ্বে যে সব সম্মাননা দেয়া হচ্ছে, এটি একটি শিশুদের পুতুল খেলায় পরিণত হয়েছ। শুনি এক ব্যক্তি অন্য ব্যক্তিকে সম্মাননা দেয়, এক প্রতিষ্ঠান অন্য প্রতিষ্ঠানকে সম্মাননা দেয় বিনিময়ে তারাও এদেরকে আবার ডেকে নিয়ে সম্মাননা দেয় এবং যিঁনি বা যাঁরা সম্মাননা পান তাঁরা নাকি ওই অনুষ্ঠানের সমস্ত খরচ বহণ করেন। ফলে দেশি-বিদেশি যত সম্মাননা আছে সবগুলোই আজ বিতর্কিত হয়ে গেছে বিতর্কিতর ঊর্ধ্বে নয় সেই ‘নোবেল’ও।
প্রকারভেদে সাধারণত চার প্রকার গ্রন্থাগার আছে আমাদের দেশে।  ১/ গণগ্রন্থাগার। ২/ জাতীয় গ্রন্থাগার। ৩/ শিক্ষায়তন গ্রন্থাগার। ৪/ বিশেষ গ্রন্থাগার। বাংলাদেশ এই এই চার প্রকার গন্থাগারই  বিদ্যমান রয়েছে। ‘গণগ্রন্থাগার’ হলো, সকল প্রকার জ্ঞান অন্বেষণের ভুবন ।এই গ্রন্থাগারে বই পড়তে এবং তথ্য জানতে জাতি-ধর্ম-বর্ণ ধনী-গরীব ছোট-বড় নির্বিশেষে সকলেরই অবারিত প্রবেশের অধিকার রয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশের উপজেলা পর্যায়ে দুটি গণগ্রন্থাগারসহ সব মিলিয়ে মোট ৭১টি সরকারি গণগ্রন্থাগার রয়েছে। ‘জাতীয় গ্রন্থাগার’ দেশের ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতি ইতিহাস ও ঐতিহ্য সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মূল্যবান উপাদান সংরক্ষণ করে। একদিকে এই প্রতিষ্ঠান দেশের সামগ্রিক প্রকাশনার নমুনা সংরক্ষণ করে এবং অন্যদিকে বিদেশে প্রকাশিত নিজ দেশ সম্পর্কিত প্রকাশনাসমূহ সংরক্ষণ করে। একটি জাতির বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মৌলিক মুদ্রিত সম্পদ রাষ্ট্রের আইন বলে সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করে।
‘শিক্ষায়তন গ্রন্থাগার’ শিক্ষাদানের ছাত্র- শিক্ষক গবেষক কর্মকর্তা-কর্মচারীগণ তাদের তথ্য ও জ্ঞান চাহিদা পূরণ করে থাকেন । এ গ্রন্থাগার সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে গড়ে ওঠে।  ‘বিশেষ গ্রন্থাগার’ তিনটি বিষয়ের দিকে লক্ষ্য রেখে গড়ে ওঠে, তা হলো। বিশেষ উদ্দেশ্য, বিশেষ সংগ্রহ ও বিশেষ পাঠ। বিশেষ গন্থাগার বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও গবেষকদের তথ্য পূরণ করে থাকে। যেমন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, জাতীয় সংসদ, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটসহ প্রকার ভেদে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব গ্রন্থাগারের অস্তিত্ব আছে।
সরকারি তথ্যমতে, বিভিন্ন জেলায় লাইব্রেরির নিজস্ব ভবনসহ ৩৩৬ টি নতুন পদ চূড়ান্তভাবে সৃষ্টি হয়েছে। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরের বেসরকারি গ্রন্থাগার সমূহের অবকাঠামো উন্নয়নের লক্ষ্যে ৭৫২ বেসরকারি গ্রন্থাগারের মধ্যে ২ কোটি টাকা অনুদান হিসেবে প্রদান করা হয়। বরাদ্দকৃত অর্থের মধ্যে ৫০% মূল্যমানের বই এবং ৫০% অনুদানের অর্থ চেক সংশ্লিষ্ট বেসরকারি গন্থাগারের নামে  প্রদান করা হয়। গ্রন্থাগার একটি দেশের সভ্যতা, কৃষ্টি ও জ্ঞানমনস্কতার ধারক ও বাহক। দেশের মানুষ গ্রন্থাগারে নিয়মিত পড়াশোনার মধ্য দিয়ে নিজেদেরকে সমৃদ্ধ মানবসম্পদে পরিণত করেন এবং সমস্ত নেতিবাচক চিন্তা চেতনা বিসর্জন দিয়ে ইতিবাচক ধ্যান ধারণায় সমাজের বিদ্যমান সমস্যাসমূহ থেকে সমাজকে উত্তোলন করেন। যেমন, জঙ্গিবাদ, মাদক, বেকারত্ব এবং সমস্ত সৃষ্টিশীল কাজে লাইব্রেরীর ভূমিকা অনন্য। যে দেশ বা সমাজে যত বেশি লাইব্রেরি থাকবে সে দেশের মানুষ বা সে সমাজের মানুষ তত বেশি জ্ঞান-বিজ্ঞানে এগিয়ে যাবে নিঃসন্দেহে। এজন্য প্রতিটি গ্রামে একটি করে লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠার কোন বিকল্প নেই।
আলোকিত, নিরহংকার, সাদা মনের পর উপকারী, সমাজসেবী, বিখ্যাত মানুষদের ব্যক্তি উদ্যোগে আমাদের দেশেও বেশকিছু পাঠাগার নির্মিত হয়েছে এবং তাঁরা ইতিহাসের পাতায় আপন কর্মে জায়গা করে নিয়েছেন এবং আপন আলোয় আলোকিত হয়ে আছেন। নিয়েছেন জ্ঞানীদের হৃদয়ের গভীরে শ্রদ্ধার আসন। যেমন, ১৯৭৮ সালে আলোকিত মানুষ তৈরীর লক্ষ্যে ‘বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র’ নামে একটি গ্রন্থাগার নির্মাণ করেন, অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার।।বর্তমানে দেশের সবচেয়ে বড় বেসরকারি পাঠাগার। যার ৭০ হাজার বাংলা বইয়ের সংগ্রহ রয়েছে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের। বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের ভ্রাম্যমাণ পাঠাগার ৫৮ টি জেলায় ২৫০টি উপজেলায় পাঠকের দোরগোড়ায় পৌঁছে যাচ্ছে বই নিয়ে। ৪৭ টি গাড়ি আড়াই। কথায় বলা যায় বাংলাদেশের সব স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরির মাধ্যমে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র বই পড়িয়ে থাকে।
বইপ্রেমী পলান সরকার। রাজশাহীর বাঘা উপজেলার বাউসা ইউনিয়নের বাউসা পূর্বপাড়া গ্রামে তার বাড়ি। ১৯৯২ সালে তার ডায়াবেটিকস ধরা পড়লে ডাক্তার তাকে নিয়মিত হাঁটার পরামর্শ দিলে তিনি তার হাঁটাকে কাজে লাগালেন মানুষের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে বই পড়িয়ে। ২০ টি গ্রাম ঘুরে তিনি মানুষের কাছে বই পৌঁছে দিয়েছেন। নিজের টাকায় বই কিনে পাঠকের বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিতেন তিনি। এ কাজের স্বীকৃতি স্বরুপ ২০১১ সালে তাকে একুশে পদকে ভূষিত করা হয়।
বরিশাল জেলার চরবাড়িয়া ইউনিয়নের লামচরি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন দার্শনিক আরজ আলী মাতুব্বর। আরজ আলী মাতুব্বর তাঁর ৮৬ বছরের জীবনের প্রায় ৭০ বছরই লাইব্রেরিতে কাটিয়েছেন পড়াশোনা করে। এভাবেই সাধারণ একজন কৃষক থেকে হয়ে উঠেন দেশবরেণ্য বিখ্যাত দার্শনিক। শুধু নিজে নয়, নিজের জ্ঞানার্জনের পাশাপাশি জ্ঞানদানেও অনেক অবদান রেখে গেছেন। আরজ আলী জ্ঞান বিতরণের জন্য নিজের টাকায় গড়ে তুলেছিলেন ‘আরজ মঞ্জিল পাবলিক লাইব্রেরি’। এছাড়াও গরীব ও মেধাবী ছাত্রদের জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা করেছেন। স্বশিক্ষায় শিক্ষিত এই মানুষটি বেশ কিছু সাহিত্য রচনা করেছেন যা বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। পাশাপাশি সাধারণ মানুষের জ্ঞানের জ্যোতি বাড়িয়ে দিয়ে জানার সীমানাকে করেছে অসীম। তার জ্ঞানচর্চা তথা লাইব্রেরী গড়ায় তাঁকে কম জ্বালা-যন্ত্রণা বা প্রতিবন্ধকতার শিকার হতে হয়নি! তিনি ছিলেন এলাকার অগ্রসর মানুষ। অনেকে তাকে না বুঝে নাস্তিক বলেও আখ্যায়িত করে। যার প্রভাব তার লাইব্রেরির উপর গিয়ে পড়ে, আগুনে পুড়িয়ে ভষ্য করে দেয়া হয় তাঁরই জীবনদশায়! আমাদের বাংলাদেশের সবচেয়ে বড়, ‘সুফিয়া কামাল জাতীয় গণগ্রন্থাগার’ বা কেন্দ্রীয় গণগ্রন্থাগার। এই গ্রন্থাগারটি ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকার শাহবাগে। এই গ্রন্থাগারটির প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে সরকারি ও বেসরকারি গ্রন্থাগার পরিচালিত হয়ে আসছে। ২০১৭ সালের তথ্য অনুযায়ী তাদের সংগ্রহে প্রায় ২,০৪,৯৭৪ বই আছে। বইগুলোর বেশিরভাগের ভাষা বাংলা কিংবা ইংরেজি, তবে হিন্দি, উর্দু, আরবি ও ফারসি ভাষারও কিছু বই রয়েছে।
‘লাইব্রেরি অফ কংগ্রেস’ পৃথিবীর সবচেয়ে বড় লাইব্রেরী। গবেষণা গ্রন্থাগার যা অফিসিয়ালি তোলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেস, যা যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় গ্রন্থাগার হয় এবং যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে পুরনো ফেডারেল সভ্য প্রতিষ্ঠান। প্রেসিডেন্ট জন অ্যাডামস যখন সরকারী কার্যাবলী ফিলাডেলফিয়া থেকে ওয়াশিংটন এ স্থানান্তর করেন তখন থেকে এর যাত্রা শুরু । কংগ্রেস তাদের লাইব্রেরিটি বিশ্বের বৃহত্তম লাইব্রেরি বলে দাবি করে। এজন্য যে, তাদের “সংগ্রহ সর্বজনীন, বিষয়, বিন্যাস, বা জাতীয় সীমা দ্বারা সীমিত নয় এবং বিশ্বের সব অংশ থেকে এবং ৪৫০ টিরও বেশি ভাষায় গবেষণা সামগ্রী অন্তর্ভুক্ত।”
১৮১২ সালের যুদ্ধে এবং ১৮১৪ সালে ব্রিটিশদের দ্বারা মূল সংগ্রহের অধিকাংশই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল এবং ১৮১৫ সালে সংগ্রহ করার জন্য লাইব্রেরির সন্ধান করা হয়েছিল। তারা থমাস জেফারসনের ৬,৪৮৭টি বইয়ের সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত সংগ্রহ কিনেছিলেন। ১৮৫১ সালে লাইব্রেরিতে আরেকটি অগ্নিকাণ্ড ঘটে, আবার জেরেফারসনের অনেক বইসহ আরও অনেকগুলি সংগ্রহকে ধ্বংস হয়ে যায়। আমেরিকার গৃহযুদ্ধের পর, কংগ্রেসের লাইব্রেরি দ্রুত আকার ও গুরুত্ব উভয় ক্ষেত্রেই বৃদ্ধি পায়। এটা মূলত মার্কিন কংগ্রেসের একটি লাইব্রেরী হলেও  এটা জাতীয় গ্রন্থাগারের ভূমিকা রয়েছে। ১৮০০ সালে ওয়াশিংটনের ক্যাপিটোলের মুখোমুখি হয়, প্রায় ৭৩.৫ মিলিয়নের বই (১৯৭৮) বিশ্বের নেতৃস্থানীয় গ্রন্থাগার বলে বিবেচিত হয়। এটি এখন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় লাইব্রেরী । সুবিশাল এই লাইব্রেরীর সংগ্রহে আছে সর্বাধিক সংখ্যক বই, রেকর্ডিংস ,মানচিত্র ও পাণ্ডুলিপি । এগুলো সংখ্যায় ৩৩,০১২,৭৫০ টি । লাইব্রেরীটি বর্তমানে ওয়াশিংটন ডিসিতে অবস্থিত।  লাইব্রেরীর স্থপতি হলেন পেয়ারসন ও ইউলসন। লাইব্রেরী পরিচালনার খরচের টাকা জোগাড় করতে ট্রাস্টি ফান্ড গঠন করা হয়। এরপর আমেরিকার অনেকে স্বপ্রণোদিত হয়ে ওই ফান্ডে টাকা জমা দেয়া শুরু করেন। অনেক  বিভিন্ন বই পত্রপত্রিকা দেন।
এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে  বৃহৎ ও বিখ্যাত লাইব্রেরী এবং পৃথিবীতে দ্বিতীয় ‘ন্যাশনাল লাইব্রেরী আব চায়না’। এই লাইব্রেরীটির সংগ্রহে আছে ২৮,৯৮০,৭৭৭ বই । প্রায় ১২,০০০,০০ সাময়িকী এর অন্তর্ভুক্ত । চীনা সাহিত্যের সব থেকে বড় সংগ্রহ আছে এখানে । চীনের বেইজিংয়ে লাইব্রেরীটি স্থাপিত হয় ১৯০৯ সালে । চীনের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাথে সম্পর্কিত সব ধরনের বই আছে এতে । প্রতি বছর ৬ থেকে ৭ লাখ করে নতুন বই যুক্ত হচ্ছে তাদের সংগ্রহে। ন্যাশনাল লাইব্রেরী অব কানাডা’  লাইব্রেরীটি কানাডার কেন্দ্রীয় সরকারের একটি বিভাগ । এই বিভাগে কানাডার ইতিহাস ও সংস্কৃতির সাথে সম্পৃক্ত সব লেখা , ছবি ও দলিলপত্র সংগ্রহ ও সংরক্ষণের দায়িত্বে নিয়োজিত । তাদের এই লাইব্রেরীটির সংগ্রহে রয়েছে ২৬,০০৬,০৫৪ টি বই । এটি বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম লাইব্রেরী । কানাডার সব থেকে সুন্দর এই লাইব্রেরীটি কানাডার সরকারী সম্পত্তি । জার্মানির জাতীয় গ্রন্থাগার, ‘ডিউচে বিবলিওথেক’। তাদের এই লাইব্রেরীটি স্থাপিত হয়েছিল ১৯১২ সালে । এই লাইব্রেরীর কাজ মূলত জার্মান ভাষার প্রকাশনা সংগ্রহ করা । তবে জার্মানিতে প্রকাশিত অন্য ভাষার প্রকাশনাও এখানে সংগ্রহ করা হয় । এটি পৃথিবীর বড়-বড় লাইব্রেরীগুলোর মধ্যে অন্যতম । এই বিখ্যাত লাইব্রেরীর সংগ্রহে আছে ২৪,৪৮৭,০১০ টি বই এবং অন্যান্য প্রকাশনা ।
যুক্তরাজ্যের জাতীয় গ্রন্থাগার,’ব্রিটিশ লাইব্রেরী’ স্থাপিত ১৭৫৩ সালে। লন্ডনে অবস্থিত লাইব্রেরীটি পৃথিবীর বিখ্যাত গবেষণা গ্রন্থাগারগুলোর মধ্যে একটি । তাদের আছে প্রায় সকল ভাষার বিভিন্ন প্রকারের ১৫,৫০০,০০০ এর বেশি সংগ্রহ । সংগৃহীত বইয়ের সংখ্যা ২৩,৫০০,০০০ টি । প্রতি বছর প্রায় ব্রিটিশ লাইব্রেরীর সংগ্রহশালায় যুক্ত হয় প্রায় ৩০,০০০,০০ নতুন বই । ‘হারভার্ড বিশ্ব্ববিদ্যালয় লাইব্রেরী’ এটি একটি লাইব্রেরী সিস্টেম । প্রায় ৯০ টি শাখা সমন্বিত । তাদের সংগ্রহে সর্বমোট বইয়ের সংখ্যা ১৫,০০০,০০০ টি । এটি আমেরিকার সব থেকে পুরোনো লাইব্রেরী সিস্টেম এবং পৃথিবীর প্রাচীন একাডেমিক লাইব্রেরী সিস্টেমগুলোর মধ্যে অন্যতম । এটি পৃথিবীর ষষ্ঠ বৃহত্তম লাইব্রেরী হিসাবে বিবেচিত । স্থাপিত হয় ১৬৩৮ সালে । ‘রাশিয়ান স্টেট লাইব্রেরী’  রাশিয়ার মস্কো শহরে অবস্থিত। এটি রাশিয়ার জাতীয় গ্রন্থাগার । লাইব্রেরীটির কার্যক্রম শুরু করে ১৭৯৫ সালে । এটি রাশিয়ার সব থেকে প্রাচীন বৃহত্তম ও জনপ্রিয় লাইব্রেরী । তাদের সংগ্রহে রয়েছে ১৪,৭৫০,০০০ এর বেশি বই ।
‘নিউইয়র্ক পাবলিক লাইব্রেরী’ পৃথিবীর অন্যতম প্রধান গ্রন্থাগার এবং আমেরিকার বিখ্যাত গবেষণা গ্রন্থাগার । এই লাইব্রেরীটি ১৮৯৫ সালে স্থাপিত হয়। এই লাইব্রেরী ৮৭ টি শাখা রয়েছে। লাইব্রেরীর সংগ্রহের সংখ্যা ১৪,৬৮৫,১৯২ ।
‘ন্যাশনাল ডায়েট লাইব্রেরী’ পৃথিবীর বড় ও বিখ্যাত লাইব্রেরীগুলোর মধ্যে একটি । জাপানের টোকিওতে লাইব্রেরীটি অবস্থিত।   জন নীতি সংক্রান্ত গবেষণার জন্য ১৯৪৮ সালে লাইব্রেরীটি স্থাপিত হয় । এখানে আছে ১৪,৩০৪,১৩৯ টি বই । জাপান জুড়ে এর ২৭ টি শাখা আছে । বিজ্ঞান ,ধর্ম,রাজনীতি ,আইন ,মানচিত্র ,সংগীতসহ সব ধরনের বই এতে আছে ।
টলেমির শাসনামলে মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরীটি প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রচীন কালের জ্ঞান-বিজ্ঞানের তীর্থভূমি হিসেবে পরিচত ছিলো এই আলেকজান্দ্রিয়া নগরী ও লাইব্রেরী। বিভিন্ন দেশের অসংখ্য পন্ডিতদের পদচারণায় মুখরিত থাকত এই লাইব্রেরী।
 টলেমীর পৃষ্ঠপোষকতায় লাইব্রেরীটি প্রতিষ্ঠা পেলেও  যার অবদান সবচেয়ে বেশি ছিলো তিনি হলেন দিমিত্রাস ফেলিরোন । ফেলিরোন ছিলেন অ্যারিস্টেটলের ছাত্র। লাইব্রেরীটা কিছুটা হলেও অ্যারিস্টেটলের লাইসিয়ামের আদলে গড়ে তোলা হয়েছিল।
পৃথিবীর বহু রাষ্ট্রের বিভন্ন ভাষার বই অনুবাদ করে সংরক্ষণ করা হতো।  বই সংগ্রহের অভিনব পদ্ধতিও ছিলো তাদের, যেমন, আলেকজান্দ্রিয়া বন্দরে যদি কোন জাহাজে নোঙ্গর করে আর যদি কোন পান্ডুলিপি পাওয়া যায় তবে তা জোর করে হলেও লাইব্রেরীতে নিয়ে এসে তারার পান্ডুলিপিটির একটি কপি তৈরি করে পান্ডুলিপিটি মূল কপি লাইব্রেরীতে রেখে অন্য কপি  মালিককে ফিরিয়ে দেয়া দিতো। এছাড়াও লাইব্রেরীতে অনেক পন্ডিত ব্যক্তি আসতেন বিদেশ থেকে। তাদের হাত ধরে  এবং অনেক সময় দেশী-বিদেশী পন্ডিতগণ এখানে গবেষণা করতে এসে তারা যে বইগুলো লিখেছেন সেগুলোও এখানে সংরক্ষণ করা হতো।
আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরী ধ্বংসের কাহিনী সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য পাওয়া না গেলেও যে তথ্য পাওয়া যায়। তার মধ্যেও বির্তক রয়েছে। এই বির্তকের মধ্যেও আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরী ধ্বংসের পিছনে তিনজন ব্যক্তিকে দায়ী করা হয়- এরা হলেন জুলিয়াস সিজার, বিশপ থিওফিলাস ও খলিফা ওমর (রা)। ধর্মীয় আধিপত্য, ক্ষমতার দাপট, পেশিশক্তি ও বিভিন্ন কারণে গৃহযুদ্ধ বেঁধে যায়। ফলে সব প্রভাব গিয়ে পড়ে লাইব্রেরির উপর। তক্ষশীলা, পৃথিবীর সর্বপ্রথম বিদ্যাপিঠ বলে পরিচিত। এটি ৪১৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১টি লাইব্রেরিও ছিল, যেখানে অসংখ্য তাল পাতার লিখা ছিল। ঐ সংগ্রহশালায় মেডিসিন, হিন্দুইজম, রাজনীতি, সাহিত্য, আর দর্শনের অনেক উপাদান ছিল। ভারত বর্ষের জ্ঞানচর্চার অন্যতম সবচেয়ে  গুরুত্বপূর্ণ ছিল ওই তক্ষশীলা। হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রও ছিল।
 লাইব্রেরি ও শিক্ষাকেন্দ্রটি  ৫ম শতকের মাঝামাঝি হানাদের দ্বারা ধ্বংস হয়ে যায়।
কোন বর্বর ব্যক্তি বা গোষ্ঠী কতৃক এ উপমহাদেশের মহামুল্যবান জ্ঞান ভিত্তিক সভ্যতা ধংসের এটা প্রথম নিদর্শন।  সম্ভবত তক্ষশীলার দৃষ্টান্ত অনুসরণ করেই ১১৯৩ সালে তথাকথিত ইসলামের মুখোশ পরা টার্কিশ বখতিয়ার খিলজি নালান্দা আক্রমন করে সমৃদ্ধ আরেক জ্ঞান ভিত্তিক সভ্যতার প্রায় সমস্ত শিক্ষক ছাত্রকে হত্যা করে, সব পাঠাগারে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় যা পুড়তে কয়েকমাস সময় লাগে। এরই সাথে শেষ হয় এই উপমহাদেশের সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী আরেক জ্ঞান ভান্ডার। এ ক্ষতিতে আমাদের উপমহাদের ইতিহাস সভ্যতার অনেক তথ্য ধ্বংস হয়ে যায়। গুণীসহ জ্ঞানীদের তীর্থস্থান তথা লাইব্রেরীতে সারা জনমই আগুন লেগে আসছে, থাকেও অরক্ষিত! আর মূর্খের ভূমি সারাজনম সংরক্ষিত থাকে, অথচ সমাজ বদলে  অবদান জ্ঞানীর মূর্খের নয়!
যুদ্ধবাজ আমেরিকা আফগানিস্তানে হামলা করে রাষ্ট্রটি ধ্বংস করে দিয়েছে। সেখানে একটি যুদ্ধ-বিধ্বস্ত রাষ্ট্রে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি একটি লাইব্রেরী স্থাপন করে দিয়েছেন। যা জ্ঞান পিপাসু মানুষদের জন্য আনন্দের সংবাদ!
অথচ, সেখানে যুদ্ধবাজ আমেরিকার  বর্ণবাদী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ব্যঙ্গ করে বলেছেন, সেই লাইব্রেরি আফগান মুলুকে কোনও কাজে লাগবে না।   তিনি বলেন, ‘ওই ভারতীয় নেতা আমাকে সমানে বলে গিয়েছেন যে আফগানিস্তানে তিনি একটা লাইব্রেরি তৈরি করেছেন। আর তাতে কত ব্যয় হয়েছে? যেটা আমরা পাঁচ ঘণ্টায় খরচ করি। আর তার জন্য নাকি আমাদের ওকে ধন্যবাদ বলতে হবে। আমি জানি না আফগানিস্তানে কে ওই লাইব্রেরি ব্যবহার করছে!’ নিজে তো জ্ঞানচর্চা করবে না, অন্যকেও করতে দেবে না। যদিও এটি শাসকগোষ্ঠীর একটা পুরানা বৈশিষ্ট্য।
বঙ্গবন্ধু তাঁর, ‘কারাগারের রোজনামচা’য় ১৯৬৬ সালের ১৫ই জুন বুধবার তিনি লিখেছেন,”সময় কাটছে না, খবরের কাগজ পাঠাতে দেরি করছে। বসে আছি গেটের দিকে চেয়ে, কখন আসে, ১২ট, ১টা, ২টা বেজে গেল-কাগজ এল না। তখন বাধ্য হয়ে ডিউটি জমাদার সাহেবকে বললাম, কি অন্যায়, ২টা বেজে গেল, আর এখনও খবরের কাগজ জেল অফিস থেকে আসছে না। মেহেরবানী করে খবর নিন কাগজ দিবে কি দিবে না? যদি একেবারেই না দেয় সে অন্য কথা। আমরা বুঝতে পারি রাজা বাদশার আমলের বন্দিখানায় আছি। সকাল ৮টা থেকে ৯টার মধ্যে হকাররা কাগজ দিয়ে যায়, আর একটা দস্তখত করে ভিতরে পাঠাতে সময় লাগে ৫ ঘণ্টা, ৬ঘণ্টা। এর কোন অর্থ বুঝতে আমার সত্যিই কষ্ট হয়। ইচ্ছা করলেই ১০টার মধ্যে কাগজ আমাদের দিতে পারে। বন্দির তো কোনো মতামত নাই। আর এদের ইচ্ছা বলেও কোন পদার্থ নাই”।
২০শে জুন সোমবার তিনি লিখেছেন,’ লাইব্রেরীতে বই আনতে পাঠালাম, আজ আর বই পাওয়া যাবে না; আমার নিজের কিছু বই আছে কয়েকদিন চালাতে পারব’। তার মানে এই দিনে তাঁকে লাইব্রেরী থেকে কোনো বই দেয়া হয়নি। ৩০শে জুন বৃহস্পতিবার তিনি লিখেছে,’ শরীরটা ভালো যেতেছে না। ভালো বইপত্র দিবে না, Reader’s Digest পর্যন্ত দেয় না। মনমতো কোন বই পড়তে দিবে না’। ১৭ই জুলাই রবিবার তিনি লিখেছেন,” আমার কতগুলি বইপত্র আই বি Withheld করেছে। আমাকে খবর দিয়েছে Reader’s Digest, টাইমস, নিউজইউক এবং ‘রাশিয়ার চিঠি’, কোনো বইই পড়তে দিবে না। পূর্বের দেয় নাই। নভেল পরতে দেয়। প্রেমের গল্প যত পারো পড়ো। একজন রাজনীতিক এগুলি পড়ে সময় নষ্ট করে কি করে! কত অধঃপতন হয়েছে আমাদের কিছুসংখ্যক সরকারি কর্মচারীর। রাজনীতির গন্ধ যে বইতে আছে তার কোনো বই-ই জেলে আসতে দিবে না। জ্ঞান অর্জন করতে পারব না, কারণ আমাদের যারা শাসন করে তারা সকলেই মহাজ্ঞানী ও গুণী!”
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক, কলামিস্ট জনাব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বিটু সাহেব দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় তাঁর একটি উপসম্পাদকীয়তে লিখেছেন।
“আজকাল কাউকে এমন একটি লাইব্রেরি গড়ার জন্য এগিয়ে আসতে দেখি না। এখন ভোট প্রার্থীরা মাদ্রাসা, মক্তব, মসজিদে দেদার দান করছেন; এই ভোট প্রার্থীদের কেউ লাইব্রেরি গড়ে তুলেছে- এমন সংবাদ শুনিনি। অবশ্য পড়া-লিখা, বই-পুস্তক এদের শত্রু; মানুষ শিক্ষিত হয়ে গেলে এদের বিপদ”। ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে অবস্থিত ক্যাথলিক খ্রস্টানদের হ্নদয়খ্যাত বিখ্যাত নটর ডেম গির্জাটি ভয়াবহ আগুনে পুড়ে ধ্বংস হয়ে গেলে, সেখানে ফ্রান্সের ধনকুবের ব্যবসায়ীরা শতকোটি ডলারের সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে! তাঁদের মধ্যে আছেন, ফ্রান্সের বিখ্যাত গুচি ব্র্যান্ড ও ইয়াভেস সেন্ট লরেন্ট ফ্যাশনের স্বত্বাধিকারী কেরিং গ্রুপের চেয়ারম্যান ও সিইও  ১০ কোটি ইউরো, বিজনেস সম্রাট এলভিএমএইচ কোম্পানি ও এর মালিক বার্নার্ড  আরনলন্ট পরিবার ২০ কোটি ইউরো,  ফরাসি গ্যাস কোম্পানি টোটাল ১০ কোটি ইউরো দেবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন এবং ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁও এর পুনর্নিমাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ও ফ্রান্স চ্যারিটি  ফাউন্ডেশন বিশ্বজুড়ে তহবিল সংগ্রহের ডাক দিয়েছে, আরো অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এগিয়ে এসেছে তাদের সাহায্যের হাত বারিয়ে। এর মধ্যে ফ্রান্সের দুইজন বিজনেস ম্যাগনেটও আছে।  ইউরোপীয় কাউন্সিল প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড টাস্ক ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য দেশগুলোকে  এর পুননির্মাণে একত্রিত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
শত কোটি ডলারের প্রতিশ্রুতি নিয়ে ধনকুবরা আজ এগিয়ে এসেছেন  উপাসনালয় পুননির্মাণে! হ্যাঁ, উপসনালয়ও নির্মিত হবে, কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় অধিক ব্যয়ে অপচয় করা যাবে না, সে অর্থ নিঃস্ব মানুষের পেছনে ব্যয় করলে বৈষম্য যেমন কমবে, তেমনি পৃথিবীটাই স্বাবলম্বী হবে। অথচ (ব্যতিক্রম ছাড়া) এই ধনকুবরা কখনো বন্যার্তদের পাশে যাবে না, শীতার্তদের পাশে যাবে না, মহামারী দেখা দিলে সেখানেও তারা যাবে না। তাঁরা পৃথিবীতে মানুষের জন্য কিছু করবে না। যদি কোনো কারণ বিশেষে কিছু করে তো নাম-মাত্র দায় সেরে চলে আসবে। তবুও কোনো না কোনো স্বার্থ লুকিয়ে থাকে। তারা সমস্ত বৈষম্য তৈরীর জনক! বৈষম্য নিরসন করবে না, তবে বৈষম্য জিইয়ে রাখতে তাদের অবদান আছে যথেষ্ট। কোনো স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়- লাইব্রেরি তারা স্থাপন করবে না। উপাসনা পৃথিবীতে মানুষের জন্য, মানুষই যদি না থাকে তো উপাসনালয়ে কে যাবে, কে উপাসনা করবে?  মানবতাবাদী মানব ধর্মের প্রবর্তক, ফকির লালন সাঁইয়ের  একটি গানে লিখেছেন,”কিসে আর বুঝাই মন তোরে /দিলমক্কার ভেদ না জানলে /তার হজ হয় কি করে/ দিলমক্কা কুদরতি কাম/খোদ  খোদা দেয় তাতে বারাম/ সে জন্য হয় দিল মক্কা নাম/ সর্ব সংসারে / একদিন যার জিয়ারত হয়/ হাজার হাজী তার তুল্য নয়/ কিতাবেতে সাফ লিখা যায় / তাইত বলিরে/এ মানুষে মক্কা গঠন/ তাই মানুষ মানুষকে করে ভজন /লালন কয় আদি মক্কা কেমন/ চিনবি কবে রে”। তিনি অন্য আর একটি গানে লিখেছেন, “পঞ্চওয়াক্ত নামাজ শরায়/ কোথায় খোদা  সিজদা কোথায়/ কারে দেখে ডাইনে বায়/ সালাম ফিরায়/ মাটির ঘরকে মক্কা বলে/ হাজী হয় সেখানে গেলে /আল্লাহ কি এসে মিলে /হাজীদের সভায়”।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর ‘মানুষ’ কবিতায় লিখেছেন, “গাহি সাম্যের গান, মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই নহে কিছু মহীয়ান। নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ অভেদ ধর্মজাতি। সব দেশে সব কালে ঘরে-ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি। মানুষের ঘৃনা করি, ও’ কারা কোরান, বেদ, বাইবেল চুম্বিছে মরি’ মরি’ ও’ মুখ হইতে কেতাব গ্রন্থ নাও জোর ক’রে কেড়ে। যাহারা আনিল গ্রন্থ-কেতাব সেই মানুষেরে মেরে। পূজিছে গ্রন্থ ভন্ডের দল! মূর্খরা সব শোনো, মানুষ এনেছে গ্রন্থ; – গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো”। লেখক গোপালকৃষ্ণ বাগচী, তিনি তাঁর একটি প্রবন্ধে লিখেছেন,”ধর্ম মানুষের কল্যাণের জন্য। কিন্তু বাস্তবে ‘ধর্ম’ কখনো কখনো ‘মানুষ’এর চেয়েও মুখ্য হয়ে ওঠে। মানুষ হয়ে পড়ে অবহেলিত এবং মানুষের হাত ধরেই তা ঘটে থাকে। মানুষের সেবা অপেক্ষিত থেকে ঈশ্বরের প্রার্থনা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ধর্মের জন্য মানুষ যতটুকু ত্যাগ স্বীকার করে, অর্থ খরচ করে; মানুষের জন্য, সমাজের জন্য শিক্ষার জন্য কখনো ততটুকুন করে না। তাদের ধারণা, আনন্দোৎসবে, ধর্মীয় কাজে অঢেল খরচ করলে প্রচুর সুনাম হবে, পূর্ণ হবে। অন্যদিকে মানুষের কল্যাণ? সে তো মহামনীষীদের কাজ, যেন তা তার মতো সাধারণের কাজ নয়”।
ডা. লুৎফর রহমান বলেছেন,”মানবসেবার মতো ধর্ম আর নেই”। নিরাপত্তা বিশ্লেষক, অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আলী শিকদার; একটি প্রবন্ধে লিখেছেন, “প্রত্যেক রাজাই নিজ নিজ দেশের একচ্ছত্র কর্তৃত্ব চালাতেন এই বলে যে, তিনি সরাসরি গড (সৃষ্টিকর্তা) কর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়ে সাম্রাজ্য চালাচ্ছেন। পোপের একান্ত ভক্ত সমর্থক ইংল্যান্ডের রাজা চার্লস পঞ্চম ভিন্ন মতাবলম্বীদের যৌক্তিক দাবি প্রত্যাখানের মধ্য দিয়ে ১৫২৯ সালে প্রোটেস্ট্যাণ্ট গ্রুপের জন্ম ও উত্থান ঘটে। শুরু হয় খ্রিস্টান ধর্মের সেক্টারিয়ান দ্বন্দ্ব সংঘর্ষ। ১৬১৮ থেকে ১৬৪৮, ৩০ বছর ধরে ভয়ানক সশস্ত্র যুদ্ধ হয় ইউরোপব্যাপী ক্যাথলিক প্রোটেস্ট্যান্টদের  মধ্যে। ইতিহাসবিদরা বলেছেন, সেই যুদ্ধে ভয়ংকরতায় ইউরোপ ধ্বংস্তূপে পরিণত হয়। যুদ্ধের এক পর্যায়ে খাদ্যের তীব্র অভাবে মানুষ একে অন্যের মাংস পর্যন্ত ভক্ষণ করেছে। ১৬৪৮ সালে দুই পক্ষের চুক্তির মধ্য দিয়ে অবসান ঘটে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের। ইতিহাসে যেটি ওয়েস্টফালিয়া শান্তি চুক্তি নামে পরিচিত”।
ধর্ম শুধু পরকালের জন্য নয়, ইহকালে শান্তির জন্য হওয়া উচিত। ১৯৯১ সালে রাশিয়ার সোভিয়েত ইউনিয়ন বিলুপ্তির পিছনে প্রধান ইস্যু কাজ করেছে ধর্ম! ধনবাদীরা ধর্মপ্রাণদের উস্কে দিয়েছিল ধর্ম ‘গেল’ বলে। ধর্মকে একটা ‘মারণাস্ত্র’, রুপে ব্যবহার করে বিভিন্ন স্বার্থবাদীগোষ্ঠী, খুব সহজে কাজ হয়। ধর্মের সংকীর্ণ কায়েমি স্বার্থ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মানুষের মধ্যে বিভেদ ও বৈষম্য তৈরিতে ভূমিকা রাখছে। একটি নিবন্ধে পড়লাম, “পৃথিবীতে মাত্র এক বছর শান্তির পরিবর্তে যুদ্ধবিগ্রহ ঘটেছে তেরো বৎসর কাল; অতীতে ওইসব যুদ্ধ ও হানাহানির পেছনে বড় একটি কারণ ছিল ধর্ম”। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বৃটেনের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পশ্চিমা বিশ্বকে সাবধান করে বলেছিলেন যে, “কমিউনিজমের পতনে আমাদের আনন্দিত হওয়ার কিছু নেই”। পৃথিবীর যেকোনো অশান্তির মূলে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আমেরিকার হাতে আছে । ইরাক যুদ্ধের সময় জঙ্গিদের ভুয়া ভিডিও তৈরি করে বিশ্বকে ধোঁকা দিয়েছিল পেন্টাগন এবং এই কুর্মের জন্য ৫৪০ মিলিয়ন ডলার খরচ করেছিলেন আমেরিকা! (পাঠক একটু চিন্তা করে দেখুন ৫৪০বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে তারা মুনাফা করেছেন কত?) ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ‘ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম’ ফাঁস করে দিয়েছে এই গোপন তথ্য, সম্প্রতি যমুনা টেলিভিশনের একটি প্রতিবেদনে দেখলাম চাঞ্চল্যকর এই ভিডিও। তারা ব্যক্তি স্বার্থে ধর্মকে ব্যবহার করে লাদেনের জন্ম দিয়েছিল। বিনিময়ে লাদেনও  তাদের দংশন করেছিল। বুশ পরিবারেরই বন্ধু লাদেন। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছিলেন যে, “খ্রিস্ট ধর্ম আজ বিপন্ন, যারা তাকে ধ্বংস করতে চায়, তাদের নিধন করা ও প্রতিরোধ করার সাহস আমাদের আছে কি?” উস্কানিটা নিশ্চয় আজ কাজে লেগেছে। গবেষকদের তথ্য মতে, গত চার মাসে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ২৬৪টি সন্ত্রাসবাদী ঘটনা ঘটেছে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়ে গেছে এবং তাদের অস্ত্রের ব্যবসাও হবে রমরমা!
আসলে এরা জ্ঞানের পেছনে মানুষের কল্যাণের পেছনে কিছু করবে না। কেননা,  মানুষ যদি জ্ঞানী হয় মানুষের যদি কল্যাণ হয় তাহলে তো এই পুঁজিবাদী সম্রাজ্যবাদীদের পেছনে আর আমজনতা থাকবে না, অতএব তাদেরকে মূর্খ করে রাখা ধনীদের জন্য শ্রেয়। যেন সারা জনম তাদেরকে দাসী রূপে ব্যবহার করতে পারে। এই ধনকুবরা অসংখ্য উপাসনালয়,  মাদ্রাসা নির্মাণ করেছেন। আমাদের দেশেও প্রাইমারি স্কুল কলেজের চেয়ে মাদ্রাসার সংখ্যা বেশি, কি পড়াচ্ছেন, কে পড়াচ্ছেন, এর সঠিক কোনো পরিসংখ্যান সরকারের কাছেও নেই। ব্যাঙের ছাতার মতো যেখানে-সেখানে যত্রতত্র মাদ্রাসা গজিয়ে উঠেছে। শিক্ষকতা সবাই করতে পারেন না, শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতাও সবার মধ্যে নেই। আলবার্ট আইনস্টাইন বলেছেন, “জ্ঞানের মধ্যে আনন্দ সৃষ্টি করাই শিক্ষকের সবচেয়ে বড় গুণ”। এ-জন্য উন্নত বিশ্বে শিক্ষকতা করার আগে প্রশিক্ষণ নিতে হয়। আমাদের দেশেও এতদিন ছিল না, কিন্তু এখন আমাদের সরকার প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন বা শিক্ষকরাও প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। এ-জন্য মাদ্রাসার শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেয়া উচিত বা দিতে হবে, তাদের ও প্রশিক্ষণ নিতে হবে। ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে শিক্ষকের আচরণ কি হবে, কিভাবে শেখাতে হবে এটা জানা অত্যন্ত জরুরি বিষয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই মাদ্রাসায় ধনকুদের সন্তানের কখনো পড়ায় না। তারা পড়াতে দেয় তাদের ছেলেমেয়েদের ইংলিশ মিডিয়ামের দেশসেরা বিশ্বসেরা বিদ্যাপীঠে; এমনকি বাংলা মিডিয়ামেও পড়াতে দেয় না অনেক সময়। আর এই গ্রামের সাধারণ মানুষদেরকে ধর্মের দোহাই দিয়ে মাদরাসায় ঢুকিয়ে রেখেছে পরকাল উজ্জ্বল হবে বলে, বলে তোমারা ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ কর, এই শিক্ষায় তোমাদের সঙ্গে যাবে। এজন্য আধুনিক শিক্ষার সঙ্গে মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থার কতটুকু সামঞ্জস্য আছে তা দেখে সংস্কার করা জরুরি যদিও এখানে হাত দেয়া সহজ নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম স্যারের মতেও ‘প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থার কোনো প্রয়োজন নেই, ধর্মীয় শিক্ষাব্যবস্থা থাকবে বাসা-বাড়ি বা তার ব্যক্তিগতভাবে’। ইংলিশ মিডিয়াম, বাংলা মিডিয়াম, এবং আরবি মিডিয়াম, এই তিন মিডিয়াম মিলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাটিই গুলিয়ে ফেলেছে। গত ৮/০৫/২০১৯ বুধবার দৈনিক ‘কালের কন্ঠ’ পত্রিকার প্রধান শিরোনাম ছিল, ‘ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষা শুধু বাণিজ্যিক স্বার্থে’। বাণিজ্য করেন কারা?
জাতীয় অধ্যাপক, আনিসুজ্জামান স্যার,’নতুন যুগের ভোরে’ শিরোনামে একটি লিখার মধ্যে লিখেছেন, “দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে শিক্ষা ব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর কথা চলছে। এরই মধ্যে মাদ্রাসা-শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আকস্মিকভাবেই যেন হইচই পড়ে গেল। মুদাররেসিনের এক প্রতিনিধিদল প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে মাদ্রাসা শিক্ষার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তাদের উদ্বেগের কথা জানালেন। বঙ্গবন্ধু তাঁদের এই বলে আশ্বস্ত করলেন যে, মাদরাসা শিক্ষা বিলোপ করা হবে না। প্রয়োজনীয় কারিগরি বিদ্যাশিক্ষার ব্যবস্থা যোগ করে মাদরাসার পাঠ্যসূচিতে কিছু রদবদল করা হবে মাত্র। পরে মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ মাদরাসা শিক্ষকদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকের ব্যবস্থা করেন এবং তিনি বঙ্গবন্ধুকে বোঝান যে মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থা বহাল রাখতে হবে নইলে দেশের গ্রামাঞ্চলে এমন প্রতিক্রিয়া হবে যে সরকার সামাল দিতে পারবেন না।
কিছুদিন পরে মাওলানা ভাসানী একটি বক্তৃতায় সরকারকে সম্বোধন করে বললেন যে, ‘চারমাস হয় দেশ স্বাধীন হয়েছে; সরকার, তুমি মাদরাসা শিক্ষার কিছু করো নাই।  ব্রিটিশ সরকার এদেশের মানুষের জন্য ধর্মীয় শিক্ষার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলে। আর বাংলাদেশ সরকার সে ব্যবস্থা চালু রাখতে পারবে না?  আমাদের ধর্মীয় শিক্ষার ভার আমাদের সরকারকেই বহণ করতে হবে”। কাজেই, ইচ্ছা করলেই কোন গণতান্ত্রিক সরকার হুট করে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন না। কেননা, তাদের গদি থাকবে না। অতএব মৌমাছির চাকে ঢেলা মারার কোন প্রশ্নই উঠে না।
অবশ্য ওই গোঁড়ামী থেকেই কিন্তু ভারতবর্ষ ২০০শ’ বছর পিছিয়ে রয়েছে ব্রিটিশদের সেই ইংলিশ শিক্ষা গ্রহণ করা  বিরত থেকে। যেটা আমাদের দেশের বর্তমান জেনারেল শিক্ষা ব্যবস্থা। মানুষের গোঁড়ামি বা ধর্মান্ধতা মনভাব পরিহার করে সহজ-সরল, খোলা-মুক্তমনের ও বিজ্ঞানমনস্ক হতে হবে। সাইরাস বলেছেন,’রক্ষণশীল চিন্তা-চেতনার ব্যক্তিরা বিশ্বের বিঘ্নস্বরুপ’।
আজকাল প্রায়ই মুক্ত আলোচনার কথা শুনি এবং আমি নিজেও একটি মুক্ত আলোচনা শুনতে গিয়েছিলাম। তো যা দেখলাম ও শুনলাম, তাতে মুক্ত আর মনে হলো না, মনে হলো বন্দি। সাম্প্রদায়িকতায় বন্দি! তবুও মুক্ত আলোচক! কিন্তু মুক্ত আলোচনায় বসতে হলে, মুক্ত আলোচক হতে হলে নিজেকে আগে মুক্ত হতে হয়। সাম্প্রদায়িকতার বেড়াজালে নিজেকে আটকে রেখে মুক্ত আলোচনা করা গেলেও, সমাজকে মুক্ত করা সম্ভব নয়। লিও টলস্টয় বলেছেন,”সবাই দুনিয়া বদলানোর কথা বলে, কিন্তু কেউই নিজেকে বদলানোর কথা বলে না”।
বিজ্ঞানী আইনস্টাইন বলেছেন, “অভিজ্ঞতা থেকে জ্ঞানের বাস্তবতা শুরু এবং এর মাধ্যমে জ্ঞানের সমাপ্তি। বৈজ্ঞানিক জ্ঞান বিশুদ্ধ চিন্তার ফল এবং তা অভিজ্ঞতালব্ধ। তা বাস্তব জগতের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পর্কযুক্ত”
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর, ‘কারাগারের রোজনামচা’র ১১০ পৃষ্টায় লিখেছেন, “এই দেশের হতভাগা লোকগুলি খোদাকে দোষ দিয়ে চুপ করে থাকে। ফসল নষ্ট হয়েছে, বলে আল্লাহ দেয় নাই, না খেয়ে আছে, বলে কিসমতে নাই। ছেলেমেয়ে বিনা চিকিৎসায় মারা যায়, বলে সময় হয়ে গেছে বাঁচবে কেমন করে! আল্লাহ মানুষকে এত দিয়েও বদনাম নিয়ে চলেছে। বন্যা তো বন্ধ করা যায়, দুনিয়ায় বহু দেশে করেছে। চীন দেশে বৎসরে বৎসরে বন্যায় লক্ষ লক্ষ একর জমি নষ্ট হতো। সে বন্যা তারা বন্ধ করে দিয়েছে। হাজার কোটি টাকা খরচ করে ক্রুগ মিশনের মহা পরিকল্পনা কার্যকর করলে, বন্যা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। এমনকি বন্যা হলোও, ফসল নষ্ট করতে পারবে না। এ কথা কি করে এদের বোঝাব! ডাক্তারের অভাবে, ওষুধের অভাবে, মানুষ অকালে মরে যায়-তবুও বলবে সময় হয়ে গেছে। আল্লাহ তো অল্প বয়সে মরার জন্য জন্ম দেয় নাই। শোষক শ্রেণী এদের সমস্ত সম্পদ শোষণ করে নিয়ে এদের পথের ভিখারী করে, না খাওয়াইয়া মারিতেছে। না খেতে খেতে শুকায়ে মরছে। শেষ পর্যন্ত না খাওয়ার ফলে বা অখাদ্য খাওয়ার ফলে কোন একটি ব্যারাম হয়ে মরছে।  বলে কিনা আল্লাহ ডাক দিয়েছে আর রাখবে কে? কই গ্রেট বৃটেনে তো কেউ না খেয়ে মরতে পারে না। রাশিয়ায় তো বেকার নাই, সেখানে তো কেহ না খেয়ে থাকে না। বা জার্মানি, আমেরিকা, জাপান এই সকল দেশে তো কেহ শুনে নাই কলেরা হয়ে কেউ মারা গেছে? কলেরা তো এসব দেশে হয় না। আমার দেশে কলেরায় এত লোক মারা যায় কেন? ওসব দেশে তো মুসলমান নাই বললেই চলে। সেখানে আল্লাহর নাম লইবার লোক নাই একজনও;  সেখানে আল্লাহর গজব পড়ে না। কলেরা, বসন্ত, কালা জ্বর হয় না। আর আমরা রোজ আল্লাহর পথে আযান দিই, নামাজ পড়ি, আমাদের উপর আসে কেন?” আল্লাহ মানুষের বুদ্ধি-জ্ঞান-বিবেক দিয়ে সৃষ্টি করেছেন, এগুলোকে কাজে লাগাতে হবে।
 আগেও হয়েছে এখনো হচ্ছে, আগে হয়েছে বর্বরতার যুগে, আদিম যুগে। কিন্তু আধুনিক সভ্যযুগেও যদি দেখি মাদ্রাসার শিক্ষক, মসজিদের ইমাম শিশুকে বলাৎকার করছে, ছাত্রীকে ধর্ষণ করছে, মসজিদের মধ্যে শিশুকে গলা কেটে হত্যা করছে মুক্তিপণ চেয়ে! শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শারীরিক নির্যাতন রাষ্ট্রীয়ভাবে নিষিদ্ধ হলেও, অনেক মাদ্রাসায় সেই আদিম বর্বরতার যুগের নেয় এখনো অসংখ্য ছাত্র ছাত্রীকে নির্যাতন করে যাচ্ছে। যেটা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে বিভন্ন সময়। দেখে মনে হয় না এই শিক্ষকেরা কোন মানুষের ঘরে জন্ম নিয়েছেন, মনে হয় না তারা কোন বাবা, তাদের আছে কোন হৃদয়! সবচেয়ে বেশি আশ্চর্য হই এবং আঁতকে উঠার মতো খবর, তা হলো, ‘নিজের সন্তানের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করা’ জাতি এমন খবরের আশায় ছিলো না। বেশ কিছুদিন হলো এ-সব নেতিবাচক সংবাদে পত্রিকার পাতাগুলো ভার হয়ে গেছে! এজন্যই কি
চর্যাপদের রচয়িতা ‘সরহপাদ’ বলেছেন, “দুষ্টু গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল অনেক ভালো” (চর্যাপদ হচ্ছে বাংলা সাহিত্যের প্রথম গ্রন্থ ৯৫০) তাহলে এরা ধর্মের দোহাই দিয়ে যে বলে ইবাদত-বন্দেগী করলে ঈমান ঠিক হয়, মন ঠিক হয়, নামাজ-কালাম পড়লে ঈমান মজবুত হয়ে যাবে। বিভিন্ন ধর্মের বিভিন্ন মত আছে, আবার একই ধর্মের অনেক মতাদর্শী মানুষ আছে, তরিকা আছে সিলসিলা আছে। মাঝে-মাঝে তাদের তর্ক করতে শুনি। এক পক্ষ বলে আগে নামাজ পড়ো তোমার ঈমান ঠিক হয়ে যাবে, তুমি ভালো হয়ে যাবে। অন্য পক্ষ বলে, আমি আগে যদি ভালো না হই, মানুষ না হই, তাহলে নামাজ পড়ে কি হবে? পৃথিবীতে প্রায় চার হাজার দুইশ’র মতো ধর্ম আছে, এক ধর্ম অন্য ধর্মের পরস্পর বিরোধী মতবাদ। কিন্তু প্রতিটা ধর্মেরই একটি করে মৌলিক বাণী আছে এবং ধর্মের একই বাণী, সেটা হলো ‘সত্য’। আর সত্য হলো সর্বজনীন ধর্ম।
শেখ সাদী বলেছেন, “ভদ্রলোক সে-ই, বড় সে-ই, যে সত্যের উপাসক; যে মনুষ্যত্বকে সমাদর করে”। ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরআনের সূরা মা-উনে উল্লেখ রয়েছে,”আপনি কি দেখেছেন তাকে, যে বিচারদিবসকে মিথ্যা বলে? সে তো সেই ব্যক্তি, যে এতীমকে গলা ধাক্কা দেয় এবং মিসকীনকে অন্ন দিতে উৎসাহিত করে না। অতএব দুর্ভোগ সেসব নামাযীর, যারা তাদের নামায সম্বন্ধে বে-খবর; যারা তা লোক-দেখানোর জন্য করে এবং নিত্য ব্যবহার্য্য বস্তু অন্যকে দেয় না”।
‘আনোয়ারা সৈয়দ হক’ তাঁর “নারীর কোন কথা নাই” গ্রন্থে লিখেছেন, “মা ও বোনেরা, এই কুষ্ঠরোগ পীড়িত পুরুষ দেশটির কাছে আপনারা কোন বিচার চাইবেন না। কুষ্ঠ রোগের দেশটির নাক গলে গেছে। এ নাকে পচা মাংসের গন্ধ আসে না। চোখের কোটর থেকে মণি গলে গেছে। এ চোখে আর এসিড দগ্ধ মেয়েগুলোর চেহারা চোখে ভাসে না। গালের মাংস ঝড়ে গেছে আর বিবেকের চপেটাঘাত লাগে না। এখন চোখের জায়গায় গর্ত নাকের জায়গায় গর্ত গালের জায়গায় শূকরের মত বড় বড় দাঁত। সে দাঁতে লালসার হাসি! এ দেশে এখন নারী জীবনের একটি অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে-ধর্ষণ! এ-সমাজে দুষ্টু, স্বভাব-নষ্ট লুচ্চা পুরুষের হাতে নারীকে ধর্ষিত হতেই হয়। বাড়িতেও যেমন নারী ধর্ষিত হয়, বাইরেও হয়”।
তো এখানে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসতে পারে যে, একজন ইমাম বা মাদ্রাসার শিক্ষক কি  নামাজ-কালাম কম পড়েন, ইবাদত-বন্দেগী কি কম করেন? তিনি তো যথেষ্ট করেন এবং মানুষকেও করান। তাহলে তাদের দাঁড়ায় কেন সমাজের এত অধঃপতন, কেন এত তলানিতে গিয়ে ঠেকল তাদের কর্ম! আসলে তারা ধার্মীক নন, ছদ্দবেশী। লালনের একটি গানে লিখেছেন, “নাপাক পাক হয় কেমনে /জন্মবীজ যার নাপাক/ কয় মৌলভীগণে/ মৌলবির মুখে জানা যায় /নাপাক জলে জান পয়দা হয়/ ধুয়ে কি তা পাক করা যায় /আসল নাপাক যেখানে /মানুষের বীজে হয় না ঘোড়া /ঘোড়ার বীজে হয় না ভেড়া /যার বীজে সেই জগৎজোড়া /দেখতে পায় নয়নে /ভিতরে লালসার থলি/ উপরে জল ঢালাঢালী /লালন বলে মন মুসল্লী / তোর দিশে হয় কোনদিনে”।
এজন্য বিবেক যদি জাগ্রত না থাকে, বিবেক যদি ন্যায় পরায়ণ না হয় তাহলে কোন কিছুই সম্ভব নয়। আসলে ধর্মের তো কোন দোষ নয়। স্বার্থন্বেষী মহল তাদের ব্যক্তি স্বার্থে ধর্মকে ব্যবহার করে থাকেন, এমআইটি’র ভাষাবিজ্ঞান ও দর্শন বিভাগের অধ্যাপক, ‘নোম চমস্কি’ তাঁর একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “ধর্ম যতদিন ধোনীর পক্ষে থাকে ততদিন তা ঠিক আছে, কিন্তু যখন গরিবের পক্ষে যায় তখন তা হয়ে ওঠে বিপজ্জনক, তাই তখন যুদ্ধে যেতে হয়”। এজন্য পৃথিবীতে যতগুলো যুদ্ধ হয়েছে সব যুদ্ধ ধর্মকেন্দ্রিক! কিন্তু এর শেকড়ে গিয়ে যদি অনুসন্ধান চালানো যায়, তাহলে দেখা যাবে ধর্ম নয়, ব্যক্তিস্বার্থে যুদ্ধ বাঁধিয়েছে স্বার্থন্বেষী মহল। স্বার্থবাদীরা তাদের দলকে ভারী করার জন্য ধর্মকে ব্যবহার করে থাকে এবং খুব সহজে কাজও হয়।
মূলত ধর্ম হলো ঈশ্বর প্রদত্ত  সুশৃংখল নিয়ম-কাননের মধ্যে জীবনযাপন করার মাধ্যম। যিনি এই নিয়মের মধ্যে তিনি ধার্মীক, যিনি এর বাইরে তিনি অধার্মীক। পৃথিবীতে ধর্ম মানে না এমন মানুষ খুব কম আছে। কিন্তু মানুষের ক্ষোভ অভিযোগ তখনই জাগে যখন ধর্মের প্রতিনিধিত্বকারী বা ধর্মীয় পণ্ডিত-বিশেষজ্ঞ যখন অধর্মের কাজ করে বসে। তখন সমস্ত দায়ভার ধর্মের ওপর গিয়ে বর্তায়। আমি কোনো ধর্মীয় বিশেষজ্ঞ বা পন্ডিত নই, ধর্ম সম্পর্কে লেখার যোগ্যতাও আমি রাখি না। ধর্ম একটি সংবেদনশীল বিষয়, এ-বিষয়ে লিখার ক্ষেত্রে অতিরিক্ত সর্তকতা অবলম্বন করতে হয়। এজন্য এদিকে আর আলোচনা না বাড়িয়ে আমাদের আলোচনার মূলে ফিরে আসি।
কাগজে-কলমে যাই থাকুক না কেন, বাস্তব চিত্রটা ভিন্ন। সারা বাংলাদেশব্যাপী লাইব্রেরীর করুন অবস্থা। কোথাও-কোথাও ঘর নেই, জমি নেই, র‍্যাক নেই, বই নেই, আবার কোথাও পাঠকও নেই।
দৈনিক ‘কালের কন্ঠ’ পত্রিকায় ফেব্রুয়ারি মাস জুরে লাইব্রেরী নিয়ে প্রকাশিত হয় ধারাবাহিক কিছু প্রতিবেদন, যার ১৫ তারিখে শিরোনাম ছিল এমন, ‘বই আছে, পাঠক নেই’। পাঠক সংকটে পড়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ঐতিহ্যবাহী সাধারণ পাঠাগার। বছরপাঁচেক আগেও পাঠকের উপস্থিতি জমজমাট থাকতো। কিন্তু এখন অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, বই নিতে দুই-তিন দিনেও কেউ পাঠাগারে আসে না। বর্তমান অবস্থায় পাঠাগারটির প্রায় ২৫ হাজার বই নষ্ট হতে বসেছে। ১৯৫৮ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জের প্রথম পাঠাগার হিসেবে জেলা শহরে প্রেসক্লাব রোডে স্থাপিত হয় এই সাধারন পাঠাগার, ৬০ বছরের পুরোনো।  পঞ্চগড়ের সদর উপজেলার সীমান্ত এলাকা মীরগড়ে ১৯৭২ সালে গড়ে ওঠে ‘মীরগড় আদর্শ পাঠাগার’। বর্তমানে এটি পাঠক শূন্যতায় ভুগছে। প্রতিদিন সন্ধ্যার পর কয়েকজন প্রবীণরা এখানে বই পড়ে তাদের অবসর সময় পার করছেন। কিন্তু নতুন প্রজন্মের তরুণ-তরুণীদের এখানে দেখা মেলে না। ফলে তাকে সাজানো বইগুলো নষ্ট হতে চলেছে।
 গাইবান্ধা গণগ্রন্থাগারে দুই হাজারের মতো দুষ্প্রাপ্য বই রয়েছে, কিন্তু এসব বই এখন পোকার দখলে। পাঠকদের তেমন যাতায়াত না থাকায় নির্বিঘ্নে বই খাচ্ছে পোকায়।  আর বইয়ের পাতা গুঁড়ো হয়ে পড়ছে গ্রন্থাগারের মেঝেতে। গ্রন্থাগারের ভবনের অবস্থা ভালো নয়, দেয়ালের পলেস্তারা খসে পড়ছে। আলমারির কাচ ভাঙ্গা। মেঝেতে স্থানাভাবে মাটিতে রাখা হয়েছে অনেক বই।  ১৯০৭ সালে তৎকালীন মহকুমা শহরের কিছু জ্ঞান পিপাসু মানুষের প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠে গাইবান্ধা পাবলিক লাইব্রেরী এন্ড ক্লাব পৌর পার্ক ও পাবলিক লাইব্রেরীর জন্য জমি দান করেন রংপুরের তাজহাট জমিদার গোবিন্দ লাল রায়। ১৭ টি আলমারিতে ১০ হাজার বই রয়েছে। এখানে এমন কিছু বই রয়েছে যেগুলো অন্য কোথাও পাওয়া যাবে না।
 মানিকগঞ্জ গ্রন্থাগারের প্রবেশমুখের উল্টোদিকে মুক্তিযোদ্ধা শিশু পার্ক  আর গ্রন্থাগার এর মাঝখানে আঙ্গিনা। গ্রন্থাগারের এই আঙিনায় বসানো হয়েছে দলিল লেখকদের অবৈধ স্থাপনা। গ্রন্থাগারে বসানো হয়েছে দলিল লেখকদের। অথচ এই গণগ্রন্থাগারে মাসিক সাড়ে তিন হাজার টাকা বেতনের প্রিয় ইসমাইল হোসেন গত ২৬শে জানুয়ারি যখন মারা গেলেন তখন তার ১০ মাসের বেতন বাকি। মাসিক সাড়ে তিন হাজার টাকা বেতনের গ্রন্থাগারিক শাহ আলম রবিনও একই সময় ধরে বেতন পাচ্ছেন না। প্রায় এক বছর ধরে বিদ্যুৎ বিল এবং পত্রিকার বিল পরিশোধ করা হচ্ছে না। ৬০ বছর আগের প্রতিষ্ঠানটি ধ্বংস হওয়ার পথে। একসময় ছিল মানিকগঞ্জ জেলার অন্যতম স্থান সাহিত্য সংস্কৃতির ইতিহাস রাজনীতি নিয়ে জমজমাট আড্ডা বসতো ১৯৬০ সালের দিকে গ্রন্থাগারটি প্রতিষ্ঠিত হয় জেলা শহরের পাশে। পাঠাগারের ১০ হাজারের মতো বই ছিল।
পটুয়াখালীর বাউফল পাঠাগারটি এখন পরিত্যক্ত গুদামঘরে পরিণত হয়েছে। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা এখানে লেপ-তোশক ফার্নিচারসহ নানা জিনিসপত্র সংরক্ষণ করে রাখছেন। ভবনটি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। ভবনের তিনটি দরজাই ভাঙ্গা জানালাগুলোও ভাঙ্গাচোরা ৩০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ২০ প্রস্থের এই ভবনের ছাদে শেওলার আস্তরণ  পড়েছে। আশির দশকের মাঝামাঝি সময় তৎকালীন ইউএনও নিয়াজ উদ্দিন পাঠাগারটি প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠার পর নব্বয়ের দশকের শেষ সময় পর্যন্ত বিকেল হলেই নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ পাঠাগারে হুমরি খেয়ে পড়ত। প্রতিষ্ঠার পর 90 এর দশকের শেষ সময় পর্যন্ত বিকেল হলে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ পাঠাগারের হুমড়ি খেয়ে পড়ত। এরপর ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়লে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা পাঠাগারের খোঁজখবর নেয়া বন্ধ করে দেন। ধীরে ধীরে এটি এখন বন্ধ হয়ে যায়।  পাঠাগারের উদ্যোগে প্রতিবছর প্রতিযোগিতামূলক বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো সেসব এখন অতীত।
 জরাজীর্ণ ভবন সামনে গেলে বুঝতেই পারবেন না এটি বরগুনার বেতাগী গণগ্রন্থাগার। বই পড়া তো দূরের কথা ছাদ ধসে পড়ার আশঙ্কায় কেউ ভেতরে যাবেই না। এই আশংকায় এক যুগ ধরে এই গ্রন্থাগার বন্ধ করা রাখা হয়েছে। ১৯৭৯ সালের গোড়ার দিকে বেতাগী সরকারি কলেজ সংলগ্ন মিলনায়তন কাম গণগ্রন্থাগার নির্মাণ করা হয়। হাজার ১৯৯২ সালের দিকে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি শিক্ষক ও সাংবাদিকদের সমন্বয় একটি পরিচালনা কমিটি গঠন করা হয়। ২০০৮ সালে তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ হোসেন আলী খন্দকার বদলি হওয়ার পর আবার কার্যক্রম ঝিমিয়ে পড়ে। ফলে উপজেলাবাসী জ্ঞানবিজ্ঞানের প্রসারে পিছিয়ে পড়ছে। পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা অন্যান্য বই না পাওয়ায় অনেক জ্ঞান থেকে পিছিয়ে পড়ছে।
পাশ দিয়ে কেউ হেঁটে যেতে থাকলে থমকে দাঁড়াতে হতো। কেউ কেউ জিজ্ঞেস করতো, ভাই এখানে এত ভিড় কেন? প্রত্যুত্তরে লোকজন বলতো বই পড়তে এসেছে। সেই ভিড় লাগার স্থান রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলা গণগ্রন্থাগার বন্ধ হয়ে আছে ১৪ বছর ধরে। বেলঘরিয়া গ্রামের বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া ছাত্র মাহাবুবের একান্ত প্রচেষ্টায় ১৯৯৮ সালে ব্যক্তি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় গন্থাগার।
প্রশাসন, সাহিত্যিক, শিক্ষক, যুবকদের সহযোগিতাও ছিলো। সিলেটের ‘দ্য জাকিগঞ্জ পাবলিক লাইব্রেরী’টি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৫৮ সালে। মাত্র দুই বছরের মাথায় ১৯৬০ সাল থেকে এর ভেতরে জাকিগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয় স্থাপিত হয়। লাইব্রেরীর ভেতরে ইউনিয়ন পরিষদ কার্যক্রম চালানোর কারণে দিনে-দিনে লাইব্রেরীটি  তার বৈশিষ্ট্য হারায়। বর্তমানে  অর্থের অভাবে লাইব্রেরীটি কার্যক্রম প্রায় বন্ধ বলা চলে। জাকিগঞ্জ পৌরসভার কেছরী গ্রামের লাইব্রেরীপ্রেমী প্রয়াত আশিকুর রহমান পাবলিক লাইব্রেরীর নামে ২৮ শতক জায়গা দান করে লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠা করেন। লাইব্রেরীতে এক সময়  প্রায় ১০ হাজার বই ছিল, শুধু পাঠাগারে নয় নিয়মিত বাড়িতে নিয়েও বই পড়তো। দুঃখের বিষয়, এখন এগুলো থেকে মানুষ বঞ্চিত।
 ফুলবাড়িয়া গণগ্রন্থাগার মিলনায়তনে দ্বিতীয় তলায় ১৯৯৭ সালে উদ্বোধন করা হয়। এতে আড়াইহাজার বই ছিল, শুরুর পাঁচ বছর জ্ঞানপিপাসুদের আনাগোনা ছিল রীতিমতো বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বই পড়া ও আড্ডায় জমে উঠত গণগ্রন্থাগারটি। এখন সেখানে আর কোন পাঠক যায় না। ২০০১ সালে ফুলবাড়িয়া পৌরসভা স্থাপিত হয়। ২০১৮ সাল পর্যন্ত গণগ্রন্থাগারে চলে পৌরসভার কার্যক্রম। পৌরসভার নিজস্ব কোন জায়গা না থাকায় গ্রন্থাগারটি ভাড়া দেওয়া হয়। গ্রন্থাগারের ২০০০ বইসহ আসবাবপত্র রাখা হয়েছিল অফিসার্স ক্লাবে,  আসবাবপত্র চুরি হয়ে যায় উইপোকায় নষ্ট করে ফেলে বাকি সব বই। কুড়িগ্রাম সরকারি গণগ্রন্থাগারে উপন্যাস গল্প নাটক প্রবন্ধ শিশুতোষ বই ভ্রমণ কাহিনী ধর্মগ্রন্থ মিলিয়ে ৩০ হাজারের মতো বই আছে। কিন্তু এসব বই পড়ার জন্য আগ্রহী পাঠকের অভাব বর্তমানে নিবন্ধিত পাঠক মাত্র ১৯৮ জন থাকলেও কর্তৃপক্ষ ও অডিটরিয়াম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে এভাবে নানা সমস্যা নিয়ে শহরের সরকারি গণগ্রন্থাগার চলছে।  ১৯৮৭ সালের কুড়িগ্রাম পৌরসভার ভাড়া নেওয়া একটি কক্ষে গ্রন্থাগারটির যাত্রা শুরু হয়। নিম্নমানের কাজ হওয়ায় ভবনটির প্রবেশ পথ দিয়ে ঢোকা যায় না। গ্রন্থাগারে ঢোকার মুখে গর্ত দেয়ালে ফাটল বরাদ্দের অভাবে ভবনটি সংস্কার করা যাচ্ছে না। গ্রন্থাগারের দেয়াল ঘেঁষে অবৈধ দোকানপাট এতে বিঘ্নিত হচ্ছে পরিবেশ।
 কুড়িগ্রামের উলিপুরে কর্তৃপক্ষের অযত্ন-অবহেলায় পাবলিক লাইব্রেরী ও মুক্তিযুদ্ধে শহীদ স্মৃতি পাঠাগার প্রায় এক যুগ ধরে বন্ধ রয়েছে। গ্রন্থাগারটির কার্যক্রম সচল না থাকায় স্থানীয় লোকজন বই সংগ্রহ ও পড়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এ কারণে উপজেলার সাহিত্য ও সংস্কৃতি অঙ্গনে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এদিকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসসহ কয়েক লাখ টাকার মূল্যবান বই উইপোকায় খেয়ে ফেলেছে। ১৯৯৬ সালে উলিপুর কোর্ট বিল্ডিং এর একটি কক্ষে মুক্তিযুদ্ধের শহীদ স্মৃতি পাঠাগার প্রতিষ্ঠা হয়। পাঠাগারে সাংস্কৃতিমনা মানুষের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় অর্থ ও আসবাবপত্র দেয়া হয়। শুরুতে পাঠকের ব্যাপক উপস্থিতি ছিল, বইয়ের পাশাপাশি বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক সাপ্তাহিক পত্রিকা তাছাড়াও পাঠাগারের উদ্যোগে আয়োজন করা হতো মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নানা অনুষ্ঠান। ২০০৭ সালের দিকে পাঠাগারটি বন্ধ হয়ে যায়।
পরিচালনা কমিটির নিষ্ক্রিয়তা ও উদাসীনতার কারণে জামালপুর গণগ্রন্থাগার ১৫ বছর ধরে অচল রয়েছে। তাকে থাকা ১৮ হাজার বই পোকায় খাচ্ছে এবং ঢেকে যাচ্ছে ধুলাবালিতে। অথচ একসময় এই গ্রন্থাগার ছিল স্থানিয় শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির সূতিকাগার।
১৯৫৯ সালে পৌরসভার পাবলিক হলের একটি কক্ষে গণগন্থাগার প্রতিষ্ঠিত হয়।
 ১৯৭৬ সালের শহরের বকুলতলায় ২৯ শতাংশ জমিতে পাকা ভবনে এর কার্যক্রম শুরু হয়। শুরু থেকে জামালপুরের শিল্প সাহিত্য ও সংস্কৃতির কেন্দ্র ছিল এটি। পাঠকদের বই লেনদেন,  বই মেলা আয়োজন, সারা বছর বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। সর্বশেষ তথ্য অনুসারে এই পাঠাগারে ২৪৫ জন ছাত্র পাঠক সদস্য, ২৪৯ জন সাধারণ সদস্য এবং ১৭৫ জন আজীবন সদস্য রয়েছে। কিন্তু কার্যক্রম বন্ধ থাকায় দিনে একজন পাঠক ও এখানে উঁকি দেয় না।
এতেই স্পষ্ট বোঝা যায় যে, দেশের লাইব্রেরীগুলো এখন কোন অবস্থায় আছে। সারা পৃথিবী জুড়েই মানুষ বই পড়া কমিয়ে দিয়েছে। এজন্য লাইব্রেরীর প্রতি এতটা গুরুত্ব এখন আর কারো লক্ষ্য করা যায় না। যার কারণে বর্তমান বিশ্বকে চরম একটা অবক্ষয়ের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করতে হচ্ছে। শুধু বই না, জ্ঞানচর্চা কাজকর্ম চাকরি-বাকরি কোন কিছুই মানুষ করতে চায় না স্বইচ্ছায়। সবারই মনের মধ্যে একটি গোপন বাসনা থাকে তা হলো, আলাদিনের চেরাগ বা অলৌকিক দৈত্ত তার মনের বাসনাপূর্ণ করে দিবেন। চাওয়া মাত্র বান্ডিল-বান্ডিল টাকা তার হাতের কাছে চলে আসবে, বাড়ি-গাড়ি সোনা-দানা হিরা-অলংকার কোন কিছুরই কমতি থাকবে না। কিন্তু যখনই দৈত্তের আর দেখা মেলে না তখনই তাকে বাস্তবতা মেনে নিয়ে কাজকর্ম করতে হয়। শিক্ষাদীক্ষা জ্ঞানচর্চা করতে হয়। অতএব বই না পড়া বা লাইব্রেরীতে যে মানুষ যেতে চায় না। কেন যেতে চায় না সেটা অনুসন্ধান করে, গবেষণা চালিয়ে দেখতে হবে। তাকে লাইব্রেরীতে নিয়ে যেতে হবে এবং এ নেয়ার গুরু দায়িত্বভার রাষ্ট্রসহ সমাজের অগ্রসর ব্যক্তিদেরকেই নিতে হবে।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর বিখ্যাত প্রবন্ধ ‘লাইব্রেরী’তে লাইব্রেরীর গুরুত্ব তুলে ধরেছেন। “মহাসমুদ্রের শত বৎসরের কল্লোল কেহ যদি এমন করিয়া বাঁধিয়া রাখিতে পারিত যে, সে ঘুমাইয়া পড়া শিশুটির মতো চুপ করিয়া থাকিত, তবে সেই নীরব মহাশব্দের সহিত এই লাইব্রেরির তুলনা হইত। এখানে ভাষা চুপ করিয়া আছে, প্রবাহ স্থির হইয়া আছে, মানবাত্মার অমর আলোক কালো অক্ষরের শৃঙ্খলে কাগজের কারাগারে বাঁধা পড়িয়া আছে। ইহারা সহসা যদি বিদ্রোহী হইয়া উঠে, নিস্তব্ধতা ভাঙিয়া ফেলে, অক্ষরের বেড়া দগ্ধ করিয়া একবারে বাহির হইয়া আসে! হিমালয়ের মাথার উপরে কঠিন বরফের মধ্যে যেমন কত কত বন্যা বাঁধা আছে, তেমনি এই লাইব্রেরির মধ্যে মানবহৃদয়ের বন্যা কে বাঁধিয়া রাখিয়াছে! বিদ্যুৎকে মানুষ লোহার তার দিয়া বাঁধিয়াছে, কিন্তু কে জানিত মানুষ শব্দকে নিঃশব্দের মধ্যে বাঁধিতে পারিবে। কে জানিত সংগীতকে, হৃদয়ের আশাকে, জাগ্রত আত্মার আনন্দধ্বনিকে, আকাশের দৈববাণীকে সে কাগজে মুড়িয়া রাখিবে! কে জানিত মানুষ অতীতকে বর্তমানে বন্দী করিবে! অতলস্পর্শ কালসমুদ্রের উপর কেবল এক-একখানি বই দিয়া সাঁকো বাঁধিয়া দিবে!
লাইব্রেরির মধ্যে আমরা সহস্র পথের চৌমাথার উপরে দাঁড়াইয়া আছি। কোনো পথ অনন্ত সমুদ্রে গিয়াছে, কোনো পথ অনন্ত শিখরে উঠিয়াছে, কোনো পথ মানবহৃদয়ের অতলস্পর্শে নামিয়াছে। যে যে-দিকে ধাবমান হও, কোথাও বাধা পাইবে না। মানুষ আপনার পরিত্রাণকে এতটুকু জাগয়ার মধ্যে বাঁধাইয়া রাখিয়াছে। শঙ্খের মধ্যে যেমন সমুদ্রের শব্দ শুনা যায়, তেমনি এই লাইব্রেরির মধ্যে কি হৃদয়ের উত্থানপতনের শব্দ শুনিতেছ। এখানে জীবিত ও মৃত ব্যক্তির হৃদয় পাশাপাশি এক পাড়ায় বাস করিতেছে। বাদ ও প্রতিবাদ এখানে দুই ভাইয়ের মতো একসঙ্গে থাকে; সংশয় ও বিশ্বাস, সন্ধান ও আবিষ্কার এখানে দেহে দেহে লয় হইয়া বাস করে। এখানে দীর্ঘপ্রাণ স্বল্পপ্রাণ পরম ধৈর্য ও শান্তির সহিত জীবনযাত্রা নির্বাহ করিতেছে, কেহ কাহাকেও উপেক্ষা করিতেছে না।”
কে কবে নিজের টাকায় বই কিনে মানুষকে বিনামূল্যে পড়াবে বা লাইব্রেরী গড়বে সেই আশায় বসে না থেকে। তাকে বিভিন্ন সম্মাননা বা পদকে ভূষিত  না করে, লাইব্রেরী গড়া যদি ভালোই হয়, তাহলে বর্তমান আধুনিক বিশ্বের সাথে তালেতাল মিলিয়ে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধি স্থলের নেয়,  প্রতিটি ইউনিয়নে একটি করে আধুনিক লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠা করতে হবে। প্রতিটা জেলা-উপজেলায় একটি করে পার্ক খেলার মাঠ স্টেডিয়াম বিমানবন্দর যেমন প্রয়োজন তেমনি আধুনিক লাইব্রেরীও প্রয়োজন। বর্তমান বিশ্বকে যে চরম একটা অবক্ষয়ের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করতে হচ্ছে তার অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে, লাইব্রেরী থেকে বিমুখতা। আর এই নম্বর মুখী অন্ধ প্রজন্ম দিয়ে আমাদের কোন কাজে আসছে না বা আসবেও না। আমাদেরকে জ্ঞান মুখী সৃষ্টিশীল মুখী প্রজন্ম গড়তে প্রচুর প্রচুর লাইব্রেরীর প্রয়োজন এবং লাইব্রেরীতে পাঠক বৃদ্ধির জন্য সবাইকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর, ‘নির্বাচিত প্রবন্ধ’ বইয়ের, ‘বৃহৎ জনগোষ্ঠীর জন্য উন্নয়ন’ প্রবন্ধে লিখেছেন,
“উন্নয়ন অবশ্যই হতে হবে বৃহৎ জনগোষ্ঠীর জন্য। সমাজের অধিকাংশ মানুষ যারা বঞ্চিত, জীবনের ন্যূনতম চাহিদা মেটাতে পারে না। শিক্ষা, স্বাস্থ্য সেবার সুযোগ থেকে বঞ্চিত। বঞ্চিত একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই থেকে বঞ্চিত কর্মসংস্থানের সুযোগ থেকে”। তাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীসহ রাষ্ট্র পরিচালনাকারীদেকে বলব, বৃহৎ জনগোষ্ঠীর জীবনমানের উন্নয়নে শিক্ষা- জ্ঞানচর্চায় লাইব্রেরীর কোন বিকল্প নেই। আমাদের লাইব্রেরী থেকে বঞ্চিত করবেন না। এদিকে আপনারা একটু লক্ষ্য করবেন। বিজ্ঞানের ভাষায়, ‘পানি ছাড়া যেমন প্রাণের সৃষ্টি অসম্ভব, যেখানে পানি নেই, সেখানে প্রাণের অস্তিত্ব নেই; যেখানে পানির আবাস রয়েছে, সেখানে প্রাণসৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে’। ঠিক তেমনি লাইব্রেরী ছাড়াও কোন সভ্য সমাজে চলতে পারে না, ভাবাও যায় না। লাইব্রেরী হলো জ্ঞানপিপাসুদের পানি। চাতক পাখির নেয় তাঁরা অধীর আগ্রহে বসে থাকে, কোথায় কবে কখন একটি লাইব্রেরী নির্মিত হবে এবং সেখানে সমাজের সকল মানুষ সমবেত হবে নিজেকে শুদ্ধ করার জন্য।
 সমাজে একটি কথা প্রচলিত আছে যে, ফেসবুক ,গুগলপ্লাস ,টুইটার ইন্টারনেটে অতিরিক্ত আসক্ত হয়ে পড়ায় মানুষ এখন আর কাগজের বই পড়ে না, পড়ে ফেসবুক। একটা জিনিস মাথায় রাখতে হবে সেটা হলো, প্রিন্ট করা কাগজের বইয়ের বিকল্প ফেসবুক হতে পারে না। বিষয়টি উন্নত কয়েকটি রাষ্ট্র অনুধাবন করে গবেষণা চালিয়ে তারা স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মার্ট ফোন নেয়া নিষিদ্ধ করেছে। ফেসবুক ও ইন্টারনেটের পেছনে অপ্রয়োজনে অতিরিক্ত সময় দেয়া স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালো নয়। গবেষকদের গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে যে  দীর্ঘক্ষণ ইন্টারনেটে কাটালে তার শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। কেননা, একটি বই কত ইঞ্চি বাই কত ইঞ্চি, আর তার অক্ষর কত বড় বড়। আর একটি স্মার্ট ফোন কত ইঞ্চি বাই কত ইঞ্চি আর তার অক্ষরইবা কত বড়? এজন্য বইয়ের কাছেই মানুষকে ফিরে আসতে হবে এবং বইকেই সঙ্গী করতে হবে। বিষয়টা আমাদেরকেউ ভেবে দেখা দরকার, আমরা যেন সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে পিছিয়ে না পড়ি। আমরা যেমন আজ উন্নয়নের একটা রোল মডেল বা উদাহরণ হয়ে আছি বিশ্ব দরবারে। যেমনি আমরা জ্ঞানে-বিজ্ঞানে এগিয়েছি। রবীন্দ্রনাথ বলে গেছেন, ‘মনুষ্যত্বের শিক্ষাটাই চরম শিক্ষা আর সবই তার অধীন’। এজন্য মানুষের মৌলিক গুণাবলীতেও যেন রোল মডেল হতে পারি, হতে পারি প্রকৃত ‘মানুষ’।
লেখক: লাইব্রেরীয়ান, কমিউনিটি লাইব্রেরী, কুষ্টিয়া, বাংলাদেশ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।