এই কিছুদিন আগে হঠাৎ করেই যেন কৃষক ও কৃষি আলোচনা-সমালোচনার শীর্ষে অবস্থান নিল। এক কৃষক তার ক্ষেতের ধান কাটার খরচ উঠে আসবে না বলে ক্ষেতের ধান ক্ষেতেই পুড়িয়েছেন। মণপ্রতি উৎপাদন খরচ ৮০০-৯০০ টাকা আর বাজারে বিক্রি করতে হবে ৫০০ টাকায়। এ সংবাদে পুরো দেশে তোলপাড়, আলোচনা-সমালোচনার ঝড়।

প্রত্যেক মানুষের ভেতর যেমন একজন মানুষ থাকে, তেমনি প্রত্যেক মানুষের ভেতর একজন অর্থনীতিবিদ বাস করে। কথায় বলে, পাগলেও নিজের ভালোটা বোঝে। তাহলে লাভ-ক্ষতির হিসাবটা কৃষক, শ্রমিক কিংবা রিকশাওয়ালা কেন বুঝবে না, তা বোধগম্য নয়। সুতরাং, এটাই স্বাভাবিক যে খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি হবে বলে তিনি এ কাজখানা করেছেন। এ প্রসঙ্গে অর্থশাস্ত্রের প্রান্তিক নীতি বা মার্জিনাল প্রিন্সিপালের দীক্ষা স্মরণ করা যেতে পারে: অতীত ভুলে যাও; ছলকে পড়া দুধ নিয়ে কেঁদে লাভ নেই; গতকালের লোকসান নিয়ে চাপা আর্তনাদ অর্থহীন। মোট কথা, ওই নীতি অনুযায়ী তোমার একটা সিদ্ধান্তের অতিরিক্ত ব্যয় কী হবে এবং তার বিপরীতে অতিরিক্ত খরচ নিয়ে ভাবাবেগহীন সিদ্ধান্তে আসা উচিত। প্রান্তিক নীতি বলছে, যেকোনো সিদ্ধান্তে মানুষ যদি প্রান্তিক খরচ ও প্রান্তিক লাভ বিবেচনা করে, তা হলেই তার আয়, মুনাফা বা তৃপ্তি সবচেয়ে বেশি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

বলার অপেক্ষা রাখে না, প্রান্তিক খরচ আর প্রান্তিক সুবিধার ভিত্তিতে কৃষক ভাই ভেবেছিলেন ক্ষেতের ফসল ক্ষেতেই থাক। এজন্যই নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ থিওডর শুলটজ বলেছিলেন, ক্ষুদ্র চাষীরা দক্ষ ও যৌক্তিক। প্রসঙ্গত, স্মরণ করা দরকার যে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কৃষক ন্যায্যমূল্য না পেয়ে রাস্তায় ফসল ঢেলে দিয়ে প্রতীকী প্রতিবাদ জানান। এমনকি বাংলাদেশে অন্য ফসলের, যেমন আলুর বেলায় এমনটি ঘটেছে। ভারতে প্রতি বছর অনেক কৃষক আত্মহত্যা করে থাকেন, তবে তা ফসলহানি ও ঋণগ্রস্ততার জন্য; ন্যায্যমূল্য না পাওয়ার জন্য নয়।

দুই. ঘটনা ঘটেছে ঈদের ক’দিন আগে। প্রতি বছর একটা চ্যানেল ঘটা করে কৃষকের ঈদ উৎসব দেখায়। এবার দেখিয়েছে কিনা জানি না, নাকি বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়ে ভবিষ্যৎ বক্তা নিউজিল্যান্ডের সাবেক ক্রিকেটার ম্যাককালামের মতো গা ঢাকা দিয়েছে কে জানে। এবার গেলে শরীরে পাচনের গুঁতা পড়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। কৃষকের ঈদ, কৃষকের বাজেট ইত্যাদি ‘উদ্ভাবনী’ উৎস উপলক্ষ করে ক্যামেরা কাঁধে নিয়ে ক্ষমতাসীনদের কাছে যারা নিয়মিত যেতেন, তাদের মুখেও কুলুপ আঁটা। তবে প্রশংসনীয়ভাবে দু-একটা পত্রিকা তাদের বাস্তবসম্মত প্রতিবেদন দিয়ে কৃষকের দুর্দশায় দেশবাসী তথা সরকারকে নড়েচড়ে বসতে সহায়তা করেছে।

কৃষক তার পণ্যের ন্যায্যমূল্য পেলে যেমন লাভবান হন, তেমনি লাভবান হয় অর্থনীতি। স্বাভাবিকভাবেই তাদের বর্ধিত আয়ের একটা বড় অংশ যায় অকৃষিজাত পণ্য ক্রয়ে। এ দ্রব্য গোষ্ঠীর বড় অংশ আবার দেশীয় পণ্য, যার উৎপাদন, কর্মসংস্থান তথা লিংকেজ প্রভাব বাংলাদেশে পড়ে। সুতরাং প্রায় দুই কোটি কৃষক পরিবারের আর্থিক বঞ্চনা মানে দাঁড়ায় সংকুচিত মোট চাহিদা এবং আরো কয়েক কোটি পরিবারের আর্থিক ক্ষতি।

তিন. অতি সন্ন্যাসীতে যেমন গাজন নষ্ট হয়, অতি ফসলে তথা বাম্পার ফলনে তেমনি কৃষকের কষ্ট বাড়ে। এটাকে বলে প্যারাডক্স অব বাম্পার হারভেস্ট। মৌলিক খাদ্যদ্রব্যের চাহিদা—যেমন চাল, গম—অস্থিতিস্থাপক বিধায় দাম কমলে ভোগ তেমন বাড়ে না। তার অর্থ কৃষক শ্রেণী ভালো ফসলে কম আয় পায় আর ফসল খারাপ হলে আয় হয় বেশি। বাজারে চাল অনেক, দামও কম, কিন্তু এই কম দাম চাহিদা খুব একটা বৃদ্ধি করে না।

আমন, বোরো ধানের বাম্পার ফলন, আগের আমদানিকৃত মজুদ ও চালকল মালিকদের চালাকি বাজারে চাহিদার বিপরীতে বিপুল জোগান সৃষ্টি করে। অর্থনীতির সূত্রে এবং বাজারের নিয়মে ধানের দাম তির্যক পড়ে যাওয়া অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। তবে এ কথাও ঠিক, পৃথিবীর কোনো দেশেই প্রধান খাদ্যদ্রব্য সম্পূর্ণরূপে বাজারের হাতে ছেড়ে দেয়া হয় না; বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। বাংলাদেশে তিনভাবে ধান-চালের বাজারে সরকার সংশ্লিষ্ট হয়, যথা ফসল কাটার অব্যবহিতপর ঘোষিত সংগ্রহ মূল্যে ‘উৎপাদকের কাছ থেকে ধান সংগ্রহ করা। কারণ ওই সময় ধানের দাম নিম্নমুখী হয়; এ সংগৃহীত ধান-চাল গুদামে রেখে চড়া সময়ে বিক্রি করে বাজার স্থিতিশীল রাখা এবং আমদানি করের বৃদ্ধি বা হ্রাস ঘটিয়ে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করা।

‘কেন’র উত্তর খুব সোজা, অতিমাত্রায় দামের ওঠানামা যাতে ক্রেতা ও বিক্রেতাকে বিচলিত না করে। বিক্রেতা কৃষককে উৎসাহ দিতে হবে আর বিশেষত দরিদ্র ক্রেতাকে খাদ্যনিরাপত্তার খাতিরে সুরক্ষা দিতে হবে। ইংরেজিতে হর্নস অব এ ডিলেমা যাকে বলে, অবস্থা তেমনি দাঁড়ায়—না কুল রাখি, না শ্যাম রাখি।

চার. সরকার নড়েচড়ে বসেছে। আমার ব্যক্তিগত অভিমত, নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও সরকার কৃষিবান্ধব একটা সরকার। সুদূর অতীত থেকে বাংলাদেশে সংগ্রহ অভিযানের নামে সরকার যা করে তা হচ্ছে, চালকল মালিকের কাছ থেকে চাল কেনা, যারা কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি ধান কেনেন। সুতরাং কৃষকের লাভের গুড় মূলত খায় ইঁদুর। এখন কৃষকের কাছ থেকে ১০-১২ টাকা কেজি দরে ধান কিনে চালকল মালিকরা ধান ২৬ ও চাল ৩৬ টাকায় সরকারের কাছে বিক্রি করছেন। প্রতি টনে লাভ করেন ৪-৫ হাজার টাকা, যার অন্তত ৫০ শতাংশ কৃষকের জোটার কথা। এমনি করে কৃষকের ঘর পোড়ে আর আলু পোড়ায় মিল মালিক। দ্বিতীয়ত. বিশেষত চলতি বছর ঘোষিত সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রা সাগরে বিন্দুজল। এরই মধ্যে আরো দুই লাখ টন সংগ্রহ বৃদ্ধি সুবিবেচনার পরিচায়ক। তবে সার্বিকভাবে আন্তর্জাতিক খাদ্যনীতি গবেষণা সংস্থা বা ইফপ্রির বাংলাদেশপ্রধান আখতার ইউ আহমেদের সুপারিশ যথাযথ বলে মনে হয়। তিনি বলেছেন, সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান সংগ্রহ করা এবং প্রয়োজনে বিপুল পরিমাণ কেনার ব্যবস্থা করা। বাংলাদেশ এখন চাল রফতানির অবস্থায় নেই; ধান সংগ্রহে পশ্চিম বাংলাকে অনুসরণ করা যেতে পারে।

সরকার ত্বরিত আরো দুটো পদক্ষেপের কথা বলেছে—আমদানি শুল্ক বাড়িয়ে আমদানি নিরুৎসাহিত করা ও ১০-১৫ লাখ টন চাল রফতানির প্রচেষ্টা। দ্বিতীয় পদক্ষেপ আলোর মুখ দেখবে কিনা সন্দেহ আছে। প্রথমত. বাজারের উদ্বৃত্ত চাল নিয়ে উদ্ভট ‘পরিসংখ্যান’ উৎস নিয়ে মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন। দ্বিতীয়ত. আন্তর্জাতিক বাজারে সিদ্ধ চালের চাহিদা খুব ক্ষীণ। তবে বাংলাদেশের বাস্তবতা এই যে, আমদানি বা রফতানিতে চালকল মালিকের কপাল খোলে আর কৃষকের কপাল পোড়ে।

পাঁচ. জাতীয় বাজেট এল। সবার মতো আমিও চিল চোখ নিয়ে বসেছিলাম টিভি পর্দার সামনে কৃষিতে প্রণোদনার উন্মাদনা নিয়ে। আশা করেছিলাম, চলমান তিক্ত অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘকালীন পদক্ষেপ ঘোষণা করা হবে। প্রতি ইউনিয়নে একটা গুদাম করা যায় না, সৃষ্টি করা যায় না সেলফ হেলপ দল? আগামী দিন কেমন কৃষি হবে বাংলাদেশে এবং তার জন্য আমাদের প্রস্তুতি কী? কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি ধান কেনার উপায় কী?

বাজেটে যা দেয়া হলো, তা ইতিবাচক তবে গতানুগতিক। কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহারকল্পে আমদানি শুল্কে ছাড়, শস্য বীমার সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা, গুদামের ক্ষমতা বৃদ্ধি, উপকরণে ভর্তুকি, কৃষিঋণের ব্যবস্থা ইত্যাদি। মোট সরকারি খরচের খাতায় কৃষি খাতের অবস্থান অনেক নিচে। তাহলে জাতির মেরুদণ্ড যে সোজা করে দাঁড়াতে পারবে না তা বলাই বাহুল্য। কৃষক গাইবেন:

ও গো যা পেয়েছি সেইটুকুতেই খুশি আমার মন,

কেন একলা বসে হিসাব কষে

নিজেরে আর কাঁদাই অকারণ।

লেখক: অর্থনীতিবিদ; অধ্যাপক ও সাবেক উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।