বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের ঈদে বোনাস হিসেবে মূল বেতনের ২৫ শতাংশ প্রদান করা হয়। আর কর্মচারীদের ৫০ শতাংশ দেয়া হয়। দুই ঈদে শিক্ষক-কর্মচারীরা এ বোনাস পেয়ে থাকেন। আর মাত্র ৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা ও বাড়ি ভাড়া ১৫০০ টাকা দেয়া হয়। এ অবস্থায় সরকারি স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের ন্যায় সব ভাতা দেয়ার দাবি করছেন বেসরকারি শিক্ষকরা।

এ দাবি নিয়ে বেসরকারি শিক্ষকদের সব অংশ ও মতের শিক্ষক সংগঠনগুলো একাট্টা। দাবি আদায়ের জন্য এ পর্যন্ত শিক্ষক সংগঠনগুলো নিজ নিজ অবস্থান থেকে নানা কর্মসূচি পালন করলেও কখনোই এক মঞ্চে এসে দাবি তুলে ধরতে পারেননি। এ সব ভাতা ও বোনাসের জন্য সরকারের কত টাকার প্রয়োজন পড়বে, তার কোনো পরিসংখ্যান-হিসাব শিক্ষক সংগঠনগুলোর বেশির ভাগ নেতারও জানা নেই। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সরকার সমর্থক এক শিক্ষক নেতা নয়া দিগন্তকে বলেন, শিক্ষক নেতারা নিজ সংগঠন ও পদ পদবি নিয়েই ব্যস্ত। তারা শিক্ষকদের স্বার্থের দিকটিকে আগের মতো এতটা গুরুত্ব দেন না। সরকারের আমলারা যে সব তথ্য দিয়ে সরকারের নীতি-নির্ধারকদের বিভ্রান্ত করেন, তার বিপরীতে সঠিক তথ্য-উপাত্ত শিক্ষক নেতারা দিতে পারেন না। তাই শিক্ষকদের ন্যায্য দাবিও এখন আর নীতি-নির্ধারকরা স্বপ্রণোদিত না হলে, আদায় বা মেনে নেন না। শিক্ষক নেতাদের কাছে এখন কোনো আপডেট তথ্য-উপাত্ত থাকে না। শিক্ষক নেতারাও এখন এ সব বিষয় নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামান না। তিনি বলেন, এ সব কারণেই শিক্ষকদের আন্দোলন এখন শিক্ষকদের স্বার্থের চাইতে নেতাদের পদ-পদবি ও সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তির এবং দলীয় মনোনয়ন নিশ্চিত করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

দেশে মাধ্যমিক শিক্ষার ৯৭ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালিত হয়ে থাকে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায়। মাত্র ৩-৪ শতাংশ মাধ্যমিক শিক্ষা পরিচালনা করে সরকার বা সরকারি নিয়ন্ত্রণে। সরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা সরকারি বেতন স্কেল অনুসারে বেতনসহ অন্যান্য সব ভাতা সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকেন। বিপরীতে বেসরকারি শিক্ষদের একটি অংশ মাত্র সরকারি বেতন-ভাতা পেয়ে থাকেন। সারা দেশে এ সংখ্যা হচ্ছে প্রায় পৌনে ৫ লাখ। অথচ সারা দেশে বেসরকারি শিক্ষকদের সংখ্যা হচ্ছে ১০ লক্ষাধিক। এ পরিসংখ্যানটি বেনবেইজ-এর।

এত বিপুল পরিমাণ শিক্ষকরা নামমাত্র বেতন-ভাতা পেয়ে থাকেন নিজ নিজ প্রতিষ্ঠান থেকে। তাও আবার রাজধানীকেন্দ্রিক বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের এবং অনেক জেলা শহরের বেসরকারি শিক্ষকরা নিয়মিত ও চাহিদা-যোগ্যতার নিরিখে বেতন-ভাতা পান না। অথচ বেসরকারি শিক্ষকরাই দেশের মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাকে টিকিয়ে রেখেছেন।

মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার মান বিচারের সব কয়টি সূচকের বিবেচনায় বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিই শীর্ষে সব সময়। পাবলিক পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ, শিক্ষার্থীদের জিপিএ-৫ এবং এর মান, পাসের হার সব কয়টি দিকেই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা এগিয়ে। বেসরকারি শিক্ষার্থীদের ছাপিয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা কখনোই শীর্ষে যেতে পারেনি। সরকার ও নীতিনির্ধারকরা সব সময়ই মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করার কথা বলে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের মধ্যে আকাশ-পাতাল বেতন-ভাতার বৈষম্য রেখে মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব নয় বলে মনে করেন সব কয়টি শিক্ষক সংগঠনের নেতারা। তারা বলেন, সরকারকেই এ বৈষম্যের অবসান করতে প্রধানতম উদ্যোগী ভূমিকা নিতে হবে।

প্রবীণ শিক্ষক নেতা, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ট্রেজারার এবং বাংলাদেশ অধ্যক্ষ পরিষদের সভাপতি অধ্যক্ষ মাজহারুল হান্নান  বলেন, বৈষম্য বিভাজন করে কখনোই মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত হবে না। আর বিলম্ব না করে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের পূর্ণাঙ্গ উৎসবভাতা চালু করা সরকারের নৈতিক দায়িত্ব। তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, এ সরকারের কাছে নীতি-নৈতিকতার প্রশ্ন তো সব সময়ই গৌণ।

বেসরকারি শিক্ষকদের অন্যতম বৃহৎ সংগঠন শিক্ষক কর্মচারী ঐক্যজোট চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ মো: সেলিম ভূঁইয়া এ ব্যাপারে  বলেন, শিক্ষায় এখন যে নৈরাজ্য চলছে, তা দিয়ে মানসম্পন্ন শিক্ষা তো দূরের কথা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনাই দুরূহ হয়ে পড়ছে। বৈষম্য সৃষ্টি এবং বিমাতাসূলভ আচরণ করছে সরকার। সমাজে বিভাজন সৃষ্টি করা হচ্ছে। শিক্ষকদের বঞ্চিত করে কখনোই মানসম্পন্ন শিক্ষা আশা করাটাই দুরূহ। তিনি অবিলম্বে মাধ্যমিক স্তরে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের দাবি করেন। বিচ্ছিন্নভাবে সরকারিকরণের ফলে বৈষম্য আরো প্রকট হচ্ছে, যোগ্য প্রতিষ্ঠানকে বাদ দিয়ে, রাজনৈতিক বিবেচনায় এখন জাতীয়করণ করার ফলে সরকারের বিরুদ্ধে শুধু শিক্ষকরাই নয়, সংশ্লিষ্ট এলকার জনগণও ক্ষুব্ধ হচ্ছে।

বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্ট্রের সদস্য সচিব ও সরকার সমর্থক শিক্ষক সংগঠনের শীর্ষ নেতা অধ্যক্ষ মো: শাহজাহান আলম সাজু  বলেন, বেসরকারি শিক্ষকদের পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতার দাবি দীর্ঘ দিনের। পবিত্র ঈদ উৎসব সবার। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদেরও ঈদ উৎসব থাকে। তাতে তারা যদি আনন্দ উপভোগ থেকে বঞ্চিত হন, তাতে সমাজে বৈষম্য সৃষ্টি হয়। শতভাগ বোনাস ও ভাতা দিতে সরকারের কত টাকার সংশ্লেষ হতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ মুহূর্তে সঠিক পরিসংখ্যানটি বলতে পারছি না, তবে, ২৫ শতাংশ ও ৫০ শতাংশে ১৮৬ কোটি হলে, সম্ভাব্য ৫০০ কোটির মতো প্রয়োজন হতে পারে। অধ্যক্ষ শাহজাহান সাজু বলেন, বর্তমান সরকার শিক্ষা ও শিক্ষকবান্ধব সরকার। এ দাবিগুলো সরকার প্রধান অবশ্যই বিবেচনায় নেবেন।

বেসরকারি শিক্ষক সমিতির একাংশের সভাপতি নজরুল ইসলাম রনি বলেন, শতভাগ উৎসব ভাতা না দিয়ে সরকার বেসরকারি শিক্ষকদের সাথে বৈষম্যমূলক আচরণ করছে। শিক্ষকদের দীর্ঘ দিনের এ দাবি সরকারকে বিবেচনায় নিতে হবে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।