সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের পদোন্নতির বিষয়ে এতদিন সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা না থাকায় দশকের পর দশক একই পদে চাকরি করে অবসরে যেতে হচ্ছিলো তাদের। এমনকি একজন শিক্ষক ৩৫ থেকে ৪০ বছর পর্যন্ত একই পদে চাকরি করেছেন।

ফলে হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করলেও নিজেরা থেকে যাচ্ছেন বঞ্চিত। তবে সে অবস্থার অবসান হতে যাচ্ছে বলে সরকারের সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে। এবার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের শতভাগ পদোন্নতির বিষয়টি নিয়ে ভাবছে সরকার।

জানা গেছে, সারাদেশে হাজার হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পদোন্নতি না পেয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে অনেকে অবসরে যেতে বাধ্য হয়ে আসছেন। কারণ এতদিন সহকারী শিক্ষক থেকে প্রধান শিক্ষক হিসেবে পদোন্নতি পাওয়ার সুযোগ কম ছিলো। সহকারী শিক্ষকের ৬৫ শতাংশ পদোন্নতির মাধ্যমে এবং বাকি ৩৫ শতাংশ সরাসরি পিএসসির মাধ্যমে এখন নিয়োগ হচ্ছে। তবে এটিও বাস্তবায়ন হচ্ছে সামান্যই।

এছাড়া প্রধান শিক্ষক হিসেবে পদোন্নতি পেলেও অপেক্ষাকৃত কম বয়সি উপজেলা ও জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তারা তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করে আসছেন। এসব ‘বৈষম্য’ উল্লেখ করে সমস্যার সমাধানে দীর্ঘদিন ধরেই আন্দোলন করে আসছেন সহকারী শিক্ষকরা। তাই পদোন্নতির সুযোগের ঘোষণায় খুব বেশি নন শিক্ষকরা। তারা বলছেন, অন্যান্য সব দাবি মেনে পদোন্নতি দিক তাতে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু সবার আগে ‘বেতনবৈষম্য’ নিরসনের দীর্ঘদিনের যে দাবি শিক্ষকদের তা আগে মানতে হবে।

বাংলাদেশ প্রাথমিক বিদ্যালয় সহকারী শিক্ষক সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ শামছুদ্দীন মাসুদ বলেন, পদোন্নতির যে ব্যাপারগুলো বলা হচ্ছে সেগুলো আসলে চলমান প্রক্রিয়া। ১৯৮৫ সালের পর থেকে সেগুলো বন্ধ আছে। এখন আবার শতভাগ পদোন্নতির কথা বলা হচ্ছে, সেটি অবশ্যই ভালো খবর। তবে তাদের মূল দাবি ১১তম গ্রেডে বেতন দেয়া জানিয়ে তিনি বলেন, সব দাবি মানা হলেও বেতন বৈষম্য দূর না হলে কাজের কাজ কিছুই হবে না।

সবার মূল দাবি ১১তম গ্রেডে বেতন প্রদান। অবশ্য পদোন্নতির ব্যাপারগুলো মন্ত্রী, সচিবদের এখতিয়ারে থাকলেও বেতনের ব্যাপারটি প্রধানমন্ত্রীর হাতে। এজন্য প্রধানমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে ব্যাপারটি নিয়ে আলোচনা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন সচিব।প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, সহকারী শিক্ষকদের এসব দাবির অধিকাংশই পূরণ করতে যাচ্ছে সরকার।

সহকারী শিক্ষকদের এখন থেকে প্রধান শিক্ষক হিসেবে শতভাগ পদোন্নতি দেয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এ নিয়ে তাদেরকে প্রতিশ্রুতিও দেয়া হয়েছে। এছাড়া এখন থেকে উপজেলা সহকারী শিক্ষা অফিসার (এটিও), উপজেলা ক্ষা অফিসার (টিও), জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার (ডিপিও), বিভাগীয় উপপরিচালক, এমনকি প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক পদ পর্যন্ত পদোন্নতি পেতে পারেন তারা।

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএফএম মনজুর কাদির গণমাধ্যমকে বলেছেন, বর্তমান নিয়োগবিধির আলোকে প্রাথমিক শিক্ষকদের প্রত্যাশা পূরণ করা সম্ভব নয়। শতভাগ পদোন্নতি ও কর্মকর্তা পদে তাদের পদায়ন করতে নিয়োগবিধির সংশোধন করতে হবে। এজন্য নিয়োগবিধি সংশোধন করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

জানা গেছে, ১৯৮৫ সালের আগ পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষকরা কর্মকর্তা পদে পদোন্নতি পেতেন। তবে ১৯৯৮ সালে নতুন শিক্ষক নিয়োগ বিধিমালা জারি করা হলে এ সুযোগ অনেকটা বন্ধ হয়ে যায়। সীমিত সংখ্যক শিক্ষক পদোন্নতি পেয়ে আসছিলেন। তবে এখন নিয়োগবিধি সংশোধন হলে আবারো তাদের পদোন্নতির সুযোগ সৃষ্টি হবে।

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে সারাদেশে প্রায় সাড়ে ৬৫ হাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এতে শিক্ষক রয়েছেন তিন লাখ ২২ হাজারের অধিক। প্রাথমিকে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় দুই কোটি সাড়ে ১৯ লাখ। এই বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীর বিপরীতে শিক্ষক সংকটও প্রকট হয়ে উঠেছে।

পাশাপাশি বেতন ও পদোন্নতি জটিলতার কারণেও পাঠদানের স্বাভাবিক পরিবেশ ব্যাহত হচ্ছে। এসব কারণে এবং দীর্ঘদিন ধরে জানিয়ে আসা দাবির প্রেক্ষিতে চলতি সে মাসের ২০ তারিখে বৃহৎ আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা।

তবে এর আগেই ১৩ মে শিক্ষক নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে এক বছরের মধ্যে সব দাবি মেনে দেয়ার আশ্বাস দেয় সরকার। ২০২০ সালের ১৭ মার্চের মধ্যে এসব দাবি মেনে নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন সচিব আকরাম-আল-হোসেন। এ সময়ের মধ্যে কোনো প্রধান শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হবে না।

তবে ১১তম গ্রেড নিয়ে ধোঁয়াশা থেকেই যাচ্ছে বলে মনে করছেন প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষকরা। বর্তমানে প্রশিক্ষণবিহীন প্রধান শিক্ষক বেতন পান ১২তম গ্রেডে (১১৩০০ টাকা বেতন স্কেল) এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ১১তম গ্রেডে (১২৫০০ টাকা বেতন স্কেল)।

আর প্রশিক্ষণবিহীন সহকারী শিক্ষক ১৫তম গ্রেডে (৯৭০০ টাকা বেতন স্কেল) এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সহকারী শিক্ষক ১৪তম গ্রেডে (১০২০০ টাকা বেতন স্কেল) বেতন পান। জানা গেছে, প্রাথমিকে প্রধান শিক্ষক পদে ৬৫ ভাগ সহকারী শিক্ষকের পদোন্নতির বিধান থাকলেও ২০০৯ সাল থেকে আদালতে মামলার কারণে বন্ধ রয়েছে।

এতে ২০ হাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক শূন্য হয়ে পড়েছে। পরে আন্দোলনের মুখে ২০১৭ সালে পদোন্নতিযোগ্য শিক্ষকদের প্রধান শিক্ষক পদে চলতি দায়িত্ব দেয়া শুরু করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়।

তবে গত ১৩ মে ১৯ জন শিক্ষক নেতার সঙ্গে বৈঠকে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব আকরাম-আল-হোসেন বলেছেন, শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের দুটি নিয়োগবিধিকে সমন্বয় করে একটি নিয়োগবিধি তৈরি করা হবে। এতে সহকারী শিক্ষক পদকে এন্ট্রি পদ ধরে নিয়োগ দেয়া হবে। এছাড়া সব পদে শতভাগ বিভাগীয় পদোন্নতি দেয়া হবে বলেও প্রতিশ্রুতি দেন তিনি।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।