আশুক আহমদ;  পৃথিবী নামক এ গ্রহটিকে মহান আল্লাহ তাঁর শ্রেষ্ঠ জীবের বসবাসের উপযোগী করে গড়েছেন। মানুষ এ গ্রহের বাসিন্দা। পৃথিবী ছাড়া বুধ, মঙ্গল বা অন্য কোনো গ্রহে মানুষ বসবাসের বা বাঁচার মতো অনুকূল পরিবেশ নেই।
আমাদের চারপাশের মানুষ, পশু-পক্ষী অর্থাৎ সব ধরনের প্রাণি, মাটি, পানি, বায়ু, গাছপালা, বনজঙ্গল, চন্দ্র, সূর্য, মেঘমালা, পাহাড়, খাল-বিল, নদী, সাগর ইত্যাদি আল্লাহর এসব সৃষ্টিই হলো প্রাকৃতিক পরিবেশ। আর মানুষ বেঁচে থাকার তাগিদে যে ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, যানবাহন, পুল-সাঁকো, কল-কারখানা, দিঘি, পুকুর, কুয়া, খেলার মাঠ, স্কুল-কলেজ, নগর-বন্দর প্রভৃতি তৈরী করছে তা হলো আমাদের সামাজিক পরিবেশ।

উইকিপিডিয়ায় বলা হয়েছে, পরিবেশ বলতে কোনো ব্যবস্থার ওপর কার্যকর বাহ্যিক প্রভাবকসমূহের সমষ্টিকে বোঝায়। যেমন: চারপাশের ভৌত অবস্থা, জলবায়ু ও প্রভাব বিস্তারকারী অন্যান্য জীব ও জৈব উপাদান ইত্যাদির সামষ্টিক রূপই হলো পরিবেশ। পরিবেশের প্রতিটি উপাদানের দ্বারাই একজন ব্যক্তি বা প্রাণী এমনকি উদ্ভিদ প্রভাবিত হয়ে থাকে। এই প্রভাবকসমূহের মধ্যে থাকে প্রাকৃতিক এবং অপ্রাকৃতিক বা কৃত্রিম পারিপার্শ্বিক উপাদানসমূহ। অর্থাৎ বুয়া যায়, জৈব ও অজৈব সকল বস্তুর সমন্বয়ে আমাদের পরিবেশ গঠিত।

পরিবেশের প্রতিটা উপাদানের সুসমন্বিত রূপই হলো সুস্থ পরিবেশ। এই সুসমন্বিত রূপের ব্যত্যয়ই পরিবেশের দূষণ ঘটায় এবং পরিবেশের স্বাভাবিক মাত্রার অবক্ষয় দেখা দেয়। পরিবেশ বিভিন্ন কারণে দূষিত হতে পারে। প্রাকৃতিক কারণের পাশাপাশি মানবসৃষ্ট কারণও এর সাথে দায়ী। পরিবেশ দূষণের জন্য বিশেষভাবে দায়ী ১২টি মারাত্মক রাসায়নিক দ্রব্যকে একত্রে ডার্টি ডজন বা নোংরা ডজন হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এই ১২টি রাসায়নিক দ্রব্যের মধ্যে ৮টি কীটনাশক অলড্রিন (aldrin), ডায়েলড্রিন (dieldrin), ক্লোরডেন (chlordane), এনড্রিন (endrin), হেপ্টাক্লোর (heptachlor), ডিডিটি (DDT), মিরেক্স (mirex), এবং টক্সাফেন (toxaphene); দুটি শিল্পজাত রাসায়নিক দ্রব্য পিসিবি (PCBs) এবং হেক্সাক্লোরোবেনজিন (hexachlorobenzene); এবং অন্য দুটো হলো কারখানায় উৎপন্ন অনাকাঙ্ক্ষিত উপজাত: ডাইওক্সিন (dioxin) এবং ফিউরান (furan)। খাদ্যচক্রে প্রবেশ করে পৃথিবীব্যাপী সব পরিবেশের সব ধরনের জীবজন্তুর উপর তীব্র প্রতিক্রিয়া ঘটায় এই বিষাক্ত পদার্থগুলো। ত্রুটিপূর্ণ শিশুর জন্ম, ক্যান্সার উৎপাদন, ভ্রুণ বিকাশের নানাবিধ সমস্যার মূলেই দায়ী থাকে এই ডার্টি ডজন। (তথ্যসূত্রঃ উইকিপিডিয়া)

বিশুদ্ধ নির্মল পরিবেশ মানুষের জন্মগত অধিকার। এ পৃথিবীতে আমাদের বসবাসের উপযোগী পরিবেশ রয়েছে, সুস্থভাবে বাঁচার জন্য পরিবেশের উপাদান প্রাকৃতিক সম্পদ অর্থাৎ বায়ু, পানি, মাটি, উদ্ভিদ ও প্রাণী প্রভৃতি দূষণের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। মানুষের বসবাসের জন্য স্রষ্টা পৃথিবীর প্রাকৃতিক পরিবেশের সব উপাদানের মধ্যে অপূর্ব সমন্বয় ও ছন্দ এবং চমৎকার ভারসাম্য রেখেছেন যা সৃষ্টির রহস্য বলা যায়। সৃষ্টিকর্তা প্রতিটি জিনিসকে এমনভাবে তৈরি করেছেন যা একটি অন্যেটির সম্পূরক ও পরিপূরক। গাছপালা আমাদের অক্সিজেন সরবরাহ করে কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করে আর মানুষ অক্সিজেন গ্রহণ করে কার্বন-ডাই-অক্সাইড ত্যাগ করে ফলে অক্সিজেন ও কার্বন-ডাই-অক্সাইডের ভারসাম্য বজায় থাকে।

কিন্তু আমারা অতি লোভে অনেক সময় নির্বিচারে গাছ-পালা নিধন করছি, রসনা বিলাসের জন্য পশু-পাখি হত্যা করছি, যত্রতত্র রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করছি যা পরিবেশ বিপর্যয়ের জন্য যথেষ্ট। আমরা কি ভেবে দেখেছি গাছ-পালা কাটতে গিয়ে কুড়াল দিয়ে যে আঘাত দেই তা প্রকারান্তরে গাছের গোড়ায় নয় আমাদের নিজের পায়ে কুঠারাঘাত করছি, ফসলে নির্বিচারে যে বিষ দিচ্ছি তা পরোক্ষভাবে আমাদেরই পেটে যাচ্ছে।

পরিবেশ দুষনের কারণে এখন বসন্তে কোকিল ডাকে না। ছোটবেলা পড়েছিলাম আমাদের দেশ ষড় ঋতুর দেশ, প্রতি দু মাস পর পর ঋতু বদল হয়। প্রত্যেক ঋতুর আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে। অথচ এখন শীত আর বর্ষা ছাড়া অন্য কোন ঋতু আছে বলে মনেই হয়না। এখন অতিবৃষ্টি বা অনাবৃষ্টি দেখা যায় খুব একটা পরিমিত বৃষ্টিপাত হয় না।

পরিবেশ বিপর্যয়ের ফলে আজ জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে। এখন মানুষ বাজার থেকে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের সাথে পরিবারের প্রায় প্রত্যেক সদস্যদের জন্য ঔষধ কিনে নিয়ে যায়। নানান রোগ নিয়ে বাচ্চা ভূমিষ্ট হচ্ছে। নিত্য নতুন রোগ জন্ম নিয়ে মহামারী রূপ ধারণ করছে।

যতই দিন যাচ্ছে আমাদের এ বসুন্ধরা উত্তপ্ত হচ্ছে, বাড়ছে বৈশ্বিক উষ্ণতা। মানুষ আর তার পরিবেশের মধ্যে যতদিন সমন্বয় বিদ্যমান ছিল ততদিন মানুষ ছিল নির্ভাবনায়। কিন্তু সভ্যতার বিকাশ, জনসংখ্যা বৃদ্ধি,অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও কল-কারখানা প্রতিষ্ঠা, যানবাহনের কালো ধোঁয়া, ত্রুটিপূর্ণ বায়ু নিষ্কাশন, কীটনাশকের ব্যবহার, রাসায়নিক তেজস্ক্রিয়তা, বনভূমি কেটে ফেলা, অবাধে ইটের ভাটা পোড়ানো, কয়লা ও গ্যাস পোড়ানোসহ নানাবিধ মনুষ্যসৃষ্ট কারণে পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট হচ্ছে। ফলস্বরূপ বায়ুমণ্ডলের ওজোন স্তর ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে সূর্যের ক্ষতিকারক তেজস্ক্রিয় রশ্মিগুলো পৃথিবীতে এসে পড়ছে। এসব গ্যাস সূর্য থেকে আসা স্বল্প দৈর্ঘ্য বিকিরণের জন্য স্বল্প কিছু লম্বা দৈর্ঘ্য বিকিরণ ধরে রেখে ভূপৃষ্ঠ এবং নিম্ন বায়ুমণ্ডল উত্তপ্ত করে তোলে। বায়ুমণ্ডলে পরিবেশ দূষণের ফলে যেসব গ্যাস জমছে তার অবর্তমানে লম্বা দৈর্ঘ্যের বিকিরণ মহাশূন্যে হারিয়ে যেত। বায়ুমণ্ডলের গ্রীন হাউজ গ্যাস হল কার্বন-ডাই-অক্সাইড, কার্বন মনো-অক্সাইড, মিথেন, নাইট্রাস অক্সাইড, নাইট্রিক অক্সাইড, ক্লোরোফ্লোরো কার্বন ইত্যাদি। এসব গ্যাসগুলোর মাত্রা পরিবর্তনের ফলে

পরিবেশগত এবং প্রকৃতিগত বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় যা গ্রীন হাউজ প্রতিক্রিয়া নামে পরিচিত

পরিবেশকে বিশুদ্ধ করার জন্যে আমাদেরকে সংকল্প নিতে হবে। প্রাকৃতিক সম্পদের যথাযথ ব্যবহার, পরিকল্পিত পরিবার গঠনের মাধ্যমে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, দূষণ নিয়ন্ত্রণ, পরিকল্পিত নগরায়ণ ও কল-কারখানা প্রতিষ্ঠা, কালো ধোঁয়া নির্গমন বন্ধকরণ, ত্রুটিমুক্ত বায়ু ও পয়ঃ নিষ্কাশন, কীটনাশকের সীমিত ব্যবহার, রাসায়নিক তেজস্ক্রিয়তার অপব্যবহার বন্ধ, বনভূমি গড়ে তোলা, অবাধে কয়লা ও গ্যাস না পোড়ানো অর্থাৎ পরিবেশ দূষণ ঘটায় বা পরিবেশের ক্ষতি হয় এমন সব কর্মকাণ্ড থেকে নিজে বিরত থাকা অন্যকে বিরত রাখার মাধ্যমে আমাদেরকে এ ধরিত্রী মানুষের বসবাসের উপযোগী হয়ে উঠবে, মানুষ নির্মল জীবন যাপন করতে পারবে।

লেখকঃ প্রধান শিক্ষক, দক্ষিণভাগ এনসিএম উচ্চ বিদ্যালয়, বড়লেখা, মৌলভীবাজার।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।