বিগত এক দশকে বাংলাদেশ মানব উন্নয়নের প্রায় সকল সূচকেই অগ্রগতি বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী অর্থনীতি ও আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে অন্যতম ১২টি উন্নয়ন সূচকের মধ্যে ১০টিতেই বাংলাদেশ সফলতা দেখিয়েছে। সহস্রাব্দ উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রে শিক্ষাসহ অন্যান্য ক্ষেত্রগুলোতে অভুতপূর্ব সাফল্য অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। একটি জাতির সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নের মৌলিক পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে শিক্ষা। কিন্তু গুণগত মানের শিক্ষায় বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশ এখনো অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছে। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নে বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা ও পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেনি। আমাদের শিক্ষার প্রতি উদাসীনতা দীর্ঘদিনের। বাংলাদেশের শিক্ষা বাজেটের প্রতি লক্ষ্য করলেই তা সকলের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠবে। বিগত এক দশকে শিক্ষা বাজেটে গড় বরাদ্দ ছিল মোট বাজেটের ১৩.৫% এবং জিডিপি’র মাত্র ২ শতাংশ। অথচ ইউনেস্কোর সনদ অনুযায়ী শিক্ষায় জাতীয় বাজেটের নূন্যতম ২০ শতাংশ এবং মোট জিডিপি’র নূন্যতম ৬ শতাংশ বরাদ্দের শর্ত উল্লেখ রয়েছে। শিক্ষা খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দের দাবি দীর্ঘদিনের ও দেশের প্রতিটি মানুষের। অথচ শুভঙ্করের ফাঁকি হচ্ছে শিক্ষা বাজেটের সাথে প্রযুক্তি, খেলাধুলা, স্বাস্থ্য, ও সামরিক বাহিনী পরিচালিত প্রতিষ্ঠান এবং ধর্ম মন্ত্রণালয় সহ নানাবিধ খাতকে জুড়ে দেয়া হয়, ফলে শিক্ষাখাতের বরাদ্দকৃত অর্থ ভাগাভাগি হয়ে যাচ্ছে। প্রতিটি বাজেটে বরাদ্দের ক্ষেত্রে ক্রমাগত বৈষম্য সৃষ্টি, উপেক্ষা ও উদাসীনতা শিক্ষার মানোন্নয়নে নতুন নতুন প্রবিন্ধকতার সৃষ্টি করছে।

শিক্ষার মানোন্নয়নে বাংলাদেশ বেসরকারি শিক্ষক কর্মচারী ফোরামের পক্ষ থেকে কতিপয় সুপারিশ উপস্থাপন করা হলো-

** শিক্ষা ব্যয় প্রান্তিক হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর মানুষের সীমা অতিক্রম করেছে। তাই অবিলম্বে সকল এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করতে হবে।
** গ্রাম-শহর ও ধনী-দরিদ্রদের মধ্যে শিক্ষার সুযোগের যে বৈষম্য রয়েছে তা দূর করতে হবে।
** শ্রেণী বৈষম্য দূর করতে দেশের সকল মানুষের জন্য অভিন্ন ও মানসম্মত শিক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রকে নিতে হবে।
** শিক্ষা বাজেটের বরাদ্দ থেকে ধর্ম, সামরিক শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতকে আলাদা করতে হবে।
** শিক্ষা বাজেট বরাদ্দ সম্পূর্ণ আলাদাভাবে প্রণয়ন করতে হবে এবং শিক্ষকদের দক্ষতা বৃদ্ধি ও জীবন মানোন্নয়নে প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে।
** প্রান্তিক অনগ্রসর, দরিদ্র এলাকা ও শহরের বস্তির শিশুদের স্কুলে ভর্তি ও ঝরে পড়া রোধে (দ্বাদশ শ্রেণি) স্তর পর্যন্ত বিনামূল্যে শিক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রকে নিতে হবে।
** শিক্ষা প্রশাসনের জনবল বৃদ্ধি করে বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে।
** অবিলম্বে শিক্ষা ক্ষেত্রে বিরাজমান সকল অনিয়ম ও দূর্ণীতি দূর করতে হবে।
** ইউনেস্কোর সুপারিশ অনুযায়ী শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি এবং বিশ্বমানের শিক্ষা প্রদানের লক্ষ্যে জাতীয় বাজেটের ২০% বাঁ জিডিপি’র নূন্যতম ৬% বরাদ্দ দিতে হবে।
** শিক্ষকদের জীবন মানোন্নয়নে সরকারি-বেসরকারি বৈষম্য দূরীকরণে সরকারকে বিশ্বাসযোগ্য এবং বাস্তবায়নযোগ্য রূপরেখা প্রণয়ন করতে হবে।
** বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষা ব্যবস্থাকে আধুনিকায়ন করতে বাজেটে পর্যাপ্ত বরাদ্দ দিতে হবে।
** প্রতিটি জেলা উপজেলায় পাবলিক পরীক্ষা গ্রহণের জন্য একটি করে বহুতল ভবন নির্মাণ করতে হবে। এই ভবনে শিক্ষকদের ধারাবাহিক প্রশিক্ষণ প্রদান ও সরকারি বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষা গ্রহণ সহজতর হবে।
** এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের যাবতীয় আয় রাষ্ট্রীয় কোষাগারে নিয়ে জাতীয়করণ করতে হবে। এতে কোষাগার থেকে অতিরিক্ত তেমন কোন অর্থের প্রয়োজন হবে না।
** অবিলম্বে জাতীয় শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে দৃশ্যমান ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
** শিক্ষকদের চাকরির নিরাপত্তা ও সম্মান মর্যাদা সুরক্ষায় অবিলম্বে শিক্ষা আইন প্রণয়ন করতে হবে।
** শিক্ষার মানোন্নয়নে প্রতিভাবানদের শিক্ষকতায় আকৃষ্ট করতে শিক্ষকদের সতন্ত্র ও আকর্ষণীয় বেতন-ভাতা দিতে হবে।
** অবিলম্বে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের আদলে শিক্ষক নিয়োগে শিক্ষা কমিশন গঠন করতে হবে।
** সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী শিক্ষকদের বাধ্যতামূলক প্রান্তিক এলাকায় বাঁ চরাঞ্চলে বদলীর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
** পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যসূচির বিষয়বস্তু যুগোপযোগী ও সহজতর করতে হবে এবং পরীক্ষা নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনতে হবে।
** শিক্ষার্থীদের মানবিকতা বিকাশে নৈতিক শিক্ষার প্রতি গভীর মনোযোগ ও অধিক গুরুত্ব দিতে হবে।
** জেলা ও উপজেলার শ্রেষ্ঠ শিক্ষকদের বিদেশে শিক্ষা সফরে প্রেরণ করে, লব্ধ অভিজ্ঞতা সম্পন্ন মাষ্টার ট্রেনার নিয়োগ দিয়ে শিক্ষকদের ধারাবাহিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

দেশের পাঁচ লক্ষাধিক এমপিওভুক্ত শিক্ষকগণ আসন্ন ২০১৯/২০২০ অর্থ বছরের বাজেটেই সকল বৈষম্য দূরীকরণ ও জাতীয়করণের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় বরাদ্দের প্রত্যাশা করে। শিক্ষকদের অভাব অনটন ও অমর্যাদায় রেখে শ্রেণীকক্ষে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা অসম্ভব। অপরদিকে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা বঙ্গোপসাগরে ছুড়ে ফেলে দিলেই সমস্যার সমাধান হবে না। প্রবাদ আছে, “মানুষ যে স্থানে পাছার খায়, সেখানেই ভর করে উঠে দাড়ায়”। দ্যর্থহীন ভাবে বলতে পারি, শিক্ষাক্ষেত্রে সকল বৈষম্য দূরীকরণের মাধ্যমে এবং বাস্তবতার নিরিখে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার প্রনয়ন করে আমাদের শিক্ষার মানোন্নয়ন করা অবশ্যই সম্ভব। সংশ্লিষ্টদের শুভ বোধ জাগ্রত হোক সেই প্রত্যাশায়।

সভাপতি
বাংলাদেশ বেসরকারি শিক্ষক কর্মচারী ফোরাম

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।