চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জের তরুণ সবুর আলী লিখিত, ভাইভা ও স্বাস্থ্য পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে স্বপ্নের চাকরির নিয়োগপত্রও পেয়েছিলেন। সেটি নিয়ে কর্মস্থলে যোগ দিতে গেলেই বাধে বিপত্তি। এ যে ভুয়া নিয়োগপত্র! চাকরিটা পাওয়ার জন্য তিনি ১১ লাখ টাকা দেন। এ জন্য তার সব পরীক্ষা নেওয়া হয়েছিল `বিশেষ ব্যবস্থায়`। শুরুতে কিছুই বুঝতে পারেননি। যাদের টাকা দিয়েছেন, তাদেরও আর সন্ধান পাননি। শেষ পর্যন্ত বুঝতে পারেন সরকারি চাকরি নামের সোনার হরিণ ধরতে গিয়ে প্রতারণার শিকার হয়েছেন তিনি।

একই অবস্থা হয়েছে পাবনার ফরিদপুর উপজেলার ধানোয়াঘাট গ্রামের আবু সাঈদের। তিনি কথিত স্বাস্থ্য পরীক্ষায় পাসের পর চাকরির জন্য নানাবাড়ির জমি বিক্রি করে দিয়েছিলেন আড়াই লাখ টাকায়। নিয়োগপত্র নিতে গিয়ে বুঝতে পারেন তিনি প্রতারকের খপ্পরে পড়েছেন। সবকিছু হারিয়ে এই শিক্ষিত যুবক এখন তৈরি পোশাক কারখানার শ্রমিক।

ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ব্যাপক প্রতিযোগিতা থাকায় স্বল্প বেতনের তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির পদে চাকরি পাওয়াও কঠিন হয়ে পড়েছে। এই সুযোগে দেশজুড়ে প্রতারণার জাল পেতে বসেছে একাধিক চক্র। সবুর আলী আর আবু সাঈদের মতো শত শত শিক্ষিত তরুণ এই ফাঁদে পা দিয়ে নিজেদের ভিটেমাটি হারিয়েছেন। প্রতারকচক্র লাখ লাখ টাকা দিয়ে লিখিত পরীক্ষা, ভাইভা ও স্বাস্থ্য পরীক্ষার নাটক করে সরকারি কর্মকর্তাদের সিল আর স্বাক্ষর জাল করে ধরিয়ে দিচ্ছে `নিয়োগপত্র`। সেই নিয়োগপত্র নিয়ে কর্মস্থলে যোগ দিতে গেলে উন্মোচিত হয় প্রতারকচক্রের কারসাজি। প্রতারণার শিকার বেশ কয়েকজন চাকরিপ্রার্থীর সঙ্গে কথা বলে মিলেছে প্রায় অভিন্ন তথ্য।

গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, সরকারি চাকরিতে এখন যেমন বেতন ভালো, তেমনি কাজও করতে হয় না। এর ওপর `উপরি আয়` করা সম্ভব। সব মিলিয়ে ভবিষ্যৎ নিয়ে একটা নিরাপত্তাবোধ কাজ করে। এ জন্য উচ্চশিক্ষিত তরুণরাও চতুর্থ শ্রেণির একটি চাকরির পেছনে ছোটে। তবে যত চাকরিপ্রত্যাশী, তত পদ নেই। এই সুযোগটাই কাজে লাগাচ্ছে প্রতারকচক্র।

এই গবেষক বলেন, গত ২০-২৫ বছর ধরে পুরো চাকরির প্রক্রিয়াটাই একটা বাণিজ্যে রূপ নিয়েছে। পরিস্থিতি এমন জায়গায় গেছে, শুধু মেধা থাকলে হবে না, চাকরি পেতে লাখ লাখ টাকা দিতেই হবে। এ অবস্থার পরিবর্তন না হলে একটা সময়ে প্রতিষ্ঠানে মেধাশূন্যতা সৃষ্টি হবে।

পাঁচ ধাপে বিক্রি :প্রতারণার শিকার প্রার্থী ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, একজন প্রার্থীকে পাঁচ ধাপে বিক্রি করা হয়। এ জন্য একেক ধাপের সদস্যরা কমিশন পায়। প্রতারণার প্রথম ধাপটি স্থানীয় `প্রমোটার` বা প্রার্থী সংগ্রাহক। এরা নির্দিষ্ট জেলায় চাকরিপ্রার্থী খুঁজে বের করে। ঢাকায় বড় সরকারি কর্মকর্তার সঙ্গে পরিচয় থাকার দাবি করে কৌশলে প্রার্থীকে আকৃষ্ট করে ঢাকায় পাঠানোর কাজ করে থাকে। পরের ধাপের নাম `ব্যবস্থাপনা টিম`। প্রমোটার চাকরিপ্রার্থীকে এই টিমের কাছে হস্তান্তর করে নিজের কমিশন নিয়ে নেয়। ব্যবস্থাপনা টিমের সদস্যরা প্রার্থীর কাগজপত্র যাচাই করে। এরপর এই গ্রুপটি চাকরি দিতে লিখিত চুক্তি করে। তৃতীয় ধাপে রয়েছে `ভাইভা টিম`। ব্যবস্থাপনা টিমের সদস্যরা এই টিমের কাছে চাকরিপ্রার্থীকে কথিত লিখিত পরীক্ষা ও ভাইভার জন্য হস্তান্তর করে। তারা `বিশেষ ব্যবস্থায়` প্রার্থীর লিখিত ও ভাইভা নেয়। এরপর প্রার্থীকে পাঠানো হয় `মেডিকেল টিমের` কাছে। তারা নির্ধারিত ডায়াগনস্টিক সেন্টারে প্রার্থীর কথিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করায়। পরে সব কাগজপত্রসহ শেষ ধাপ `বস টিম` বা `হাই অফিসিয়াল টিমে`র সদস্যদের কাছে পাঠানো হয়। এই টিমের সদস্যরা নিজেদের বিভিন্ন সংস্থার বড় কর্মকর্তা বা সরকারি অফিসের যুগ্মসচিব পরিচয় দেয়। তারা ভুয়া নিয়োগপত্র দেখিয়ে চুক্তি অনুযায়ী সব টাকা হাতিয়ে নেয়। পরে ভুয়া নিয়োগপত্র হাতে ধরিয়ে দিয়ে আত্মগোপনে চলে যায়।

এর বাইরে কোনো কোনো প্রতারকচক্র আউটসোর্সিংয়ে নিয়োগের নামে রীতিমতো অফিসও খুলে বসে বলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে। বিভিন্ন চক্র আবার ভুয়া বিজ্ঞাপন দিয়েও চাকরি দেওয়ার নামে টাকা হাতিয়ে নেয়। প্রায় সব চক্রের টার্গেট মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাস বেকার যুবক।

প্রতারক চক্র এমনকি সেনাবাহিনীর নামও ব্যবহার করে থাকে। প্রতারণার শিকার আবু সাঈদ সমকালকে বলেন, ঢাকায় এক প্রতারকের সঙ্গে তার ভাইয়ের পরিচয় হয়েছিল। `আলাউদ্দিন` নামের ওই প্রতারক নিজেকে পুলিশের এসআই পরিচয় দেন। নিজে থেকেই বলেন, শিক্ষিত কেউ থাকলে তিনি চাকরি দিতে পারবেন, তার একজন ভাই সেনাবাহিনীর বড় কর্মকর্তা। শেষ পর্যন্ত সৈনিক পদে চাকরি দেওয়ার জন্য আড়াই লাখ টাকা নেন আলাউদ্দিন।

আবু সাঈদ বলেন, আলাউদ্দিন তাকে ঢাকার ফকিরাপুলে কথিত সেনাকর্মকর্তার বাসায় নেন। তিনি ওই এলাকায় স্বাস্থ্য পরীক্ষা করান। নানা ধরনের পরীক্ষা নিয়ে তাকে জানানো হয়, তিনি পাস করেছেন। নিয়োগপত্র দিয়ে দেবেন।

পরে তিনি বুঝতে পারেন পুরো ঘটনাই সাজানো। কারণ, সেনাবাহিনীতে কোনো তদবিরে চাকরি হয় না। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের সময়ও প্রতারকদের খপ্পরে না পড়ার জন্য সাধারণ মানুষকে সতর্ক করা হয়ে থাকে।

র‌্যাব সদস্যরা গত এক মাসে অভিযান চালিয়ে ঢাকায় রীতিমতো অফিস খুলে বসা দুটি প্রতারক চক্রের অন্তত ২৪ সদস্যকে গ্রেফতার করেছে। সম্প্রতি ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) সদস্যও এই ধরনের প্রতারক চক্রের অন্তত পাঁচ সদস্যকে গ্রেফতার করে।

র‌্যাব-৪ এর অধিনায়ক চৌধুরী মঞ্জুরুল কবির বলেন, চক্রগুলো সেনাবাহিনী, রেলওয়ে, বিভিন্ন ব্যাংক ও সরকারি দপ্তরসহ প্রায় সব অফিসেই চাকরি দেওয়ার নামে ফাঁদ পাতে। এক একটি পদের জন্য তারা পাঁচ লাখ টাকা থেকে ১২ লাখ টাকা পর্যন্ত নেয়। এরপর ভুয়া নিয়োগপত্র ধরিয়ে দিয়ে আত্মগোপনে চলে যায়।

র‌্যাব-৪ এর অপারেশন অফিসার সাজেদুল ইসলাম সমকালকে বলেন, একজন চাকরিপ্রার্থী পাঁচ ধাপে বিক্রি হন। প্রথম ধাপের সদস্যরা এমনভাবে প্রতারণার ফাঁদ পাতে যাতে মনে হবে তারা মানবিক কারণেই কাউকে চাকরি পেতে সহায়তা করছে। ঢাকায় নিয়োগ প্রতিষ্ঠানের বড় অফিসারের সঙ্গে নিজের পরিচয়ের কথা বলে প্রার্থী ও তার পরিবারকে আশ্বস্ত করে। তবে মাঠ পর্যায়ের প্রতারক এটাও জানিয়ে দেয়, সে শুধু পরিচয় করিয়ে দিতে পারবে।

আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্র জানায়, এই প্রতারক চক্রের একটি অন্যতম হোতা পলাতক মাসুদ রানা ও জসিম উদ্দিন। তাদের হয়ে চাকরি দেওয়ার সব কাজ সম্পন্ন করে প্রশান্ত কুমার সাহা। তার পরেই রয়েছে সাকির আলী ওরফে শাকিল। তারা কখনও মেজর, কখন যুগ্মসচিবসহ সরকারি বড় কর্মকর্তা সাজেন। অপর দুটি চক্রের হোতা মানিক চাঁদ ওরফে রাজ এবং শাহিনুর আলম।

আগে রিকশা চালাতেন, এখন নিয়োগকর্তা! :খুলনার কয়রা এলাকার শাহিনুর আলম (২৮) টেনেটুনে এসএসসি পাস করেছিলেন। ১০ বছর আগে ঢাকায় এসে জীবিকার তাগিদে রিকশা চালানো শুরু করেন। নানাপথ ঘুরে তিনি এখন সরকারি-বেসরকারি প্রায় সব প্রতিষ্ঠানের নিয়োগকর্তা! কোনো প্রতিষ্ঠানে চতুর্থ শ্রেণির চাকরির নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিলেই বিভিন্ন এলাকায় স্থানীয় পর্যায়ে তার নিয়োগ করা দালালচক্র সক্রিয় হয়ে ওঠে। তারা কৌশলে চাকরিপ্রার্থীদের ঢাকায় এনে তুলে দেয় তার হাতে। এ জন্য দালালরা পায় কমিশন। শাহিনুর টাকার বিনিময়ে চাকরিপ্রার্থীদের হাতে তুলে দেয় ভুয়া নিয়োগপত্র। এসব অপকর্ম করতে মিরপুরে ও পুরানা পল্টনে রীতিমতো অফিস খুলে বসেছে সে। প্রতারণার টাকায় এক সময়ের রিকশাচালক শাহিনুর এখন `মেহেজাবিন প্রপার্টিজ` নামের একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক। গত ১০ মে ডিবি পুলিশ তাকে চার সহযোগীসহ গ্রেফতারের পর এসব তথ্য বেরিয়ে আসে।

ডিবির ধানমণ্ডি জোনাল টিমের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার আহসান খান সমকালকে বলেন, চাকরিপ্রার্থী ভুক্তভোগীদের অভিযোগে গ্রেফতারের পর শাহিনুরের কাছ থেকে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর, কারা অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ভুয়া নিয়োগপত্র জব্দ করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে ওই প্রতারক স্বীকার করেছে, গত কয়েক বছরে চাকরি দেওয়ার নাম করে দুই শতাধিক বেকার তরুণদের কাছ থেকে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে সে।

ভুয়া বিজ্ঞাপনে প্রতারণা : রামপুরা এলাকায় ছাপাখানার ব্যবসা করেন হারুন অর রশিদ ওরফে পরাগ (৫৪) ও নুরুল ইসলাম শেখ (৫৬)। ছাপাখানার আড়ালে কথিত জাতীয় দৈনিকে সরকারি প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের ভুয়া বিজ্ঞপ্তি দেয় তারা। এরপর চাকরিপ্রার্থীদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেয় লাখ লাখ টাকা।

ওই চক্রটি গত ১০ মে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) যুগ্মসচিব (প্রশাসন ও অর্থ) আসাদুল ইসলাম নাম ব্যবহার করে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয়। এতে বলা হয়, সীমান্ত এলাকায় গবাদি পশু আমদানির শুল্ক্ক আদায়ের জন্য আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে এক হাজার ৭৪৩ জনকে নিয়োগের দায়িত্ব পেয়েছে তাদের `সিয়া এন্টারপ্রাইজ`। তবে আসাদুল ইসলাম নামে কোনো যুগ্মসচিব এনবিআরে নেই।

র‌্যাব-৩ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল এমরানুল হাসান বলেন, তাদের কাছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড থেকে পাঠানো একটি চিঠিতে বলা হয়, ওই বিজ্ঞাপনের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। এই ধরনের নিয়োগ প্রক্রিয়াও নেই। এর পরই তদন্ত চালিয়ে চক্রটিকে শনাক্ত করে পরাগ ও নুরুলকে গ্রেফতার করা হয়।

চাকরির পরিবর্তে মামলা :র‌্যাব ও ডিবি কর্মকর্তারা বলছেন, চাকরি দেওয়ার নামে প্রতারকচক্র অগ্রিম অর্ধেক টাকা নেয়। বিশ্বাস অর্জনের জন্য চাকরিপ্রার্থী বা তার অভিভাবককে সেই টাকার সমপরিমাণ ব্যাংক চেক দেয়। পাশাপাশি চাকরি দেওয়ার নামে সাদা স্ট্যাম্পে সই নেয় প্রার্থীর। পরে এগুলোই কাল হয়ে দাঁড়ায় চাকরিপ্রার্থীর। চাকরি দিতে না পারায় টাকা ফেরত চাওয়ায় উল্টো প্রার্থীর বিরুদ্ধেই মামলা করে দেয় প্রতারকচক্র। টাকা পাওয়ার দাবি করে ব্যাংক চেক ও সাদা স্ট্যাম্পে নিজেদের মতো লিখে তা উপস্থাপন করে। শেষ পর্যন্ত মামলা থেকে রক্ষা পেতে প্রতারক চক্রের সঙ্গে আপস করেন চাকরিপ্রত্যাশীরা।

প্রতারণার শিকার সিরাজগঞ্জের রাশেদুল ইসলাম লিটন বলেন, তার ভাতিজাকে পুলিশে চাকরি দেওয়ার জন্য এসআই পরিচয় দেওয়া আলাউদ্দিন ১২ লাখ টাকা নিয়েছিল। প্রতারকের খপ্পরে পড়েছেন বুঝতে পেরে তিনি টাকা ফেরত চাইলে উল্টো তার বিরুদ্ধে তিনটি মামলা দেওয়া হয়। মামলায় অভিযোগ করা হয়, তিনি (লিটন) বিদেশে লোক পাঠানোর কথা বলে ইসমাইল ও রতন নামে দুই ব্যক্তির কাছ থেকে ৩০ লাখ টাকা নিয়েছেন। লিটন বলেন, শেষ পর্যন্ত তিনি র‌্যাবের কাছে অভিযোগ করেন। র‌্যাব সদস্যরা গত ১২ মে ওই চক্রটিকে গ্রেফতার করে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।