ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার কানাইডাঙা গ্রামের আলী হোসেন। চাকরি দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে নিজ এলাকারই বেশ কয়েকজন চাকরিপ্রার্থীর কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন বিপুল পরিমাণ অর্থ। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক এবং পুলিশের এসআইসহ বিভিন্ন পদে চাকরি প্রত্যাশীরাই তার মূল টার্গেট।

ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, চাকরি দেওয়ার নামে সুকৌশলে অর্থ হাতিয়ে নেন আলী হোসেন। আর চাকরি না পেয়ে টাকা ফেরত চাইতে গেলে ভুক্তভোগীদের নানাভাবে হুমকি দেন তিনি। এক যুগেরও বেশি সময় ধরে এভাবে প্রতারণা করে আসছেন আলী হোসেন। আগামী ১৭ মে থেকে শুরু হতে যাওয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক পদের নিয়োগ পরীক্ষাকে সামনে রেখে আবারও তিনি সাধারণ মানুষের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

শুধুমাত্র আলী হোসেন একাই নন, এই নিয়োগ পরীক্ষাকে ঘিরে দেশের আনাচে-কানাচে বেশ কিছু সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্র সক্রিয় হয়ে উঠেছে বলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদপ্তরও জানতে পেরেছে। আর এ বিষয়ে চাকরি প্রত্যাশীদের সতর্ক করে সম্প্রতি একটি গণবিজ্ঞপ্তি দিয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়।

মন্ত্রণালয়ের কাছে অভিযোগ রয়েছে, এসব প্রতারক চক্রের সঙ্গে উচ্চ পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর এবং উপজেলা ও জেলা শিক্ষা কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের যোগসাজশ রয়েছে। এ কারণে অভিযোগ আমলে নিয়ে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে চাকরি প্রার্থীদের সতর্ক করার পাশাপাশি ভুক্তভোগীদের থানায় অভিযোগ করার অনুরোধ জানিয়েছেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব আকরাম আল হোসেন।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সক্রিয় কিছু সংঘবদ্ধ চক্র এই নিয়োগ পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে বিপুল পরিমাণ অর্থ লেনদেন করবে এমন আশঙ্কার কথা একটি গোয়েন্দা সংস্থা মন্ত্রণালয়কে এরইমধ্যে জানিয়েছে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সচিব আকরাম আল হোসেন বলেন, ‘এইসব প্রতারক চক্রের বিরুদ্ধে মাঠে গোয়েন্দা সংস্থা কাজ করছে। আর আমরাও সজাগ রয়েছি। এ কারণে এমন প্রতারক চক্রের সন্ধান পেলেই স্থানীয় থানায় অভিযোগ দেওয়ার জন্য গণবিজ্ঞপ্তি দিয়েছি।’

মহেশপুরের কয়েকজন ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চাকরি পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে ২০১৫ সালে উপজেলার মান্দাবাড়িয়া গ্রামের শারমিন সুলতানা বেলী এবং উজ্জ্বলপুর গ্রামের কবির হোসেন লিটনের কাছ থেকে প্রায় ৭ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন আলী হোসেন। টাকা নেওয়ার পর হঠাৎই লাপাত্তা হয়ে যান তিনি। এ ঘটনার এক বছর পর তাকে ঝিনাইদহ শহরের নতুন কোর্টপাড়ায় বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতে দেখা যায়।

ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, টাকা চাইতে গেলে তাদের (ভুক্তভোগীদের) পরিবারের অন্য সদস্যদের হত্যার হুমকি দেন আলী হোসেন। এ কারণে ভয়ে তারা থানায় অভিযোগ করেননি। তবে তার বিরুদ্ধে স্থানীয় থানায় প্রতারণার একাধিক মামলা রয়েছে।

এমনই একজন ভুক্তভোগী পরিবারের নিরাপত্তার স্বার্থে নাম প্রকাশ না করে বলেন, ‘গত প্রায় এক বছর ধরে আলী হোসেনকে এলাকায় দেখা যায়নি। কিন্তু সহকারী শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার আগে আগে তাকে আবারও এলাকায় দেখা যাচ্ছে। তিনি এরই মধ্যে বেশ কিছু প্রার্থীর কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা নিয়েছেন বলেও জানতে পেরেছি।’

আরেক ভুক্তভোগী শারমিন সুলতানা বেলী বলেন, ‘তিন ভাই-বোনের মধ্যে আমি সবার বড়। ফলে একটা চাকরি খুব দরকার ছিল। অনেক চেষ্টা করেও যখন চাকরি পাচ্ছিলাম না তখন আলী হোসেনের সঙ্গে পরিচয় হলে তিনি আমাকে চাকরি পাইয়ে দেওয়ার প্রলোভন দেন। এ জন্য সাড়ে তিন লাখ টাকা দিতে বলেন। বাবা জমি বিক্রি করে তার হাতে টাকা তুলে দেন। পরে ভুয়া একটা নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি হাতে ধরিয়ে দিয়ে সে হঠাৎ লাপাত্তা হয়ে যায়। যখন তাকে খুঁজে পেলাম তখন টাকা চাইতে গেলে সে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। পরে আর তার কাছে যাইনি। আলী হোসেন এখন আবার প্রাথমিক নিয়োগ পরীক্ষার প্রার্থীদের টার্গেট করেছে বলে শুনেছি।’

আলী হোসেনের মতো প্রতারকদের বিষয়ে প্রার্থীদের সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব আকরাম আল হোসেন বলেন, ‘এই নিয়োগের লিখিত পরীক্ষা থেকে শুরু করে চূড়ান্ত নিয়োগ খুবই স্বচ্ছভাবে সম্পন্ন হয়। খুবই উন্নত প্রযুক্তিতে বুয়েটের মাধ্যমে লিখিত পরীক্ষা হবে। অনলাইনে আবেদন গ্রহণ, আবেদন যাচাই শেষে প্রার্থীদের কাছে অনলাইনে প্রবেশপত্র প্রেরণ, পরীক্ষা কেন্দ্রের সিট বিন্যাস, একাধিক সেট প্রশ্নপত্রের মাধ্যমে পরীক্ষা গ্রহণ এবং উত্তরপত্র মূল্যায়ন শেষে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রার্থীদের তালিকা প্রকাশসহ বিভিন্ন সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণপূর্বক অত্যন্ত স্বচ্ছতার সঙ্গে শিক্ষক নিয়োগ সম্পন্ন করা হয়ে থাকে। তাই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রতারণার মাধ্যমে বা অনৈতিকভাবে অর্থের বিনিময়ে চাকরি পাওয়ার কোনো প্রকার সুযোগ নেই।’

সারা দেশ থেকে এবার রেকর্ডসংখ্যক ২৪ লাখের বেশি প্রার্থী সহকারী শিক্ষক পদে নিয়োগের আবেদন করেছেন বলেও জানান সচিব আকরাম আল হোসেন।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।