স্বাস্থ্য শিক্ষা ব্যুরোর নির্ধারিত ছাপাখানায় (প্রেস) মেশিনম্যান পদের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী আবদুস সালাম। সর্বসাকুল্যে বেতন ৩০ হাজার টাকা। কিন্তু অঢেল সম্পদের মালিক তিনি। শুধু ঢাকা, সাভার ও মানিকগঞ্জেই রয়েছে তার শতবিঘা জমি। সামান্য একজন চাকুরে কীভাবে এত সম্পদের মালিক হলেন? গ্রেপ্তারের পর সিআইডির জিজ্ঞাসাবাদে এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে বলে সংশ্নিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

সূত্র মতে, জিজ্ঞাসাবাদে সালাম জানিয়েছেন, মেডিকেল আর ডেন্টাল কলেজে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ছাপার পর গোপনে তা তিনি তুলে দিতেন সিন্ডিকেটের হাতে। নিজের খালাতো, মামাতো আর চাচাতো ভাইসহ নিকটাত্মীয়দের নিয়ে গড়েছিলেন সেই সিন্ডিকেট। প্রশ্নপত্র ফাঁস করে তাদের কাছ থেকে পাওয়া টাকায় কিনেছেন বিঘায় বিঘায় জমি। সিআইডির এক কর্মকর্তা সমকালকে জানান, সালাম সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র কিনে মেডিকেল ও ডেন্টালে ভর্তি হয়েছেন- এমন অন্তত শতাধিক শিক্ষার্থীকে খুঁজছেন তারা। বেশ কয়েকজনের সন্ধানও পাওয়া গেছে। ওই শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে সব ধরনের প্রমাণ হাতে নিয়ে তাদের বহিস্কারের জন্য সংশ্নিষ্ট প্রতিষ্ঠানে চিঠি দেওয়া হবে।

বিভিন্ন বছর মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের মামলায় গত সোমবার পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডি তাকে গ্রেপ্তার করে। গত মঙ্গলবার তাকে আদালতে হাজির করে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে প্রভাবশালীদের নানা অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়টি করোনাকালে সামনে আসে। এর আগে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মেডিকেল এডুকেশন শাখার হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা আবজাল হোসেনের লুটপাটের বিষয়ে সারাদেশে তোলপাড় হয়। গত মাসেই গ্রেপ্তার হন স্বাস্থ্য শিক্ষা ব্যুরোর গাড়িচালক আবদুল মালেক। এই চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর শত কোটি টাকার সম্পদের মালিকানার তথ্য বেরিয়ে আসে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের স্টোর অফিসার নাজিম উদ্দিনের ‘সম্পদের পাহাড়’ও গোপন করা সম্ভব হয়নি। সর্বশেষ সেই স্বাস্থ্যের প্রেস কর্মী আবদুস সালামের শতবিঘা জমির বিষয়টি সামনে এলো।

সিআইডির সাইবার সেন্টারের বিশেষ পুলিশ সুপার এস এম আশরাফুল আলম গতকাল বুধবার সমকালকে জানান, আবদুস সালাম প্রশ্নপত্র ফাঁস করে বিঘায় বিঘায় জমি কিনেছেন, কিন্তু ব্যাংকে কোনো টাকা রাখেননি। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি জানিয়েছেন, জমির মালিক হওয়া তার শখ। এ জন্য অবৈধ আয়ের সবটুকু জমিতে বিনিয়োগ করেছেন। প্রাথমিক হিসাবে তিনি শতবিঘার ওপরে জমি কিনেছেন। অবশ্য সালাম এ বিষয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য দিচ্ছেন।

সিআইডির অন্য একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সোর্সের মাধ্যমে তারা জানতে পেরেছেন, ঢাকা ছাড়াও সাভার, মানিকগঞ্জের সাটুরিয়াসহ বিভিন্ন এলাকায় আবদুস সালামের অন্তত শতবিঘা জমি রয়েছে। এসব জমির মালিকানার বিষয়ে নিশ্চিত হতে সংশ্নিষ্ট বিভাগে সিআইডির পক্ষ থেকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। মালিকানা নিশ্চিতের পর তার বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইনে মামলা দায়ের করা হবে।

সিআইডি সূত্র জানায়, মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা ছাপাখানায় ছাপানো হয়। তবে এসব ছাপাখানায় স্বাস্থ্য শিক্ষা ব্যুরোর নিয়োগ করা কর্মীরা কাজ করেন। বহু বছর ধরে নির্ধারিত ছাপাখানায় মেশিনম্যানের দায়িত্ব পালন করতে গিয়েই প্রশ্নপত্র ফাঁস শুরু করেন আবদুস সালাম। ২০০৬ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত মেডিকেল ও ডেন্টালের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করে এসেছেন তিনি। তবে ২০০৬ সালে প্রশ্নপত্র ফাঁসের পর বিষয়টি জানাজানি হয়। ওই সময়ে ভর্তি পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি প্রশ্ন ফাঁসে আবদুস সালামের সংশ্নিষ্টতা পেলে তাকে মেশিনম্যানের পদ থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। ২০০৭ ও ২০০৮ সালে তিনি প্রশ্নপত্র ছাপার কাজে ছিলেন না।

২০০৯ সালে মন্ত্রণালয়ের প্রভাবশালীদের চাপে তাকে ফের ওই পদে দায়িত্ব দেওয়া হয়। এরপর তিনি প্রশ্নপত্র ছাপার কাজে জড়িত ছিলেন। পাশাপাশি নিজেও প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন। ওই সময়েই নিজের খালাতো ভাই জসিম উদ্দিন ভূঁইয়া, নিকটাত্মীয় জাকির হোসেন দিপু, পারভেজ খান, মোহাইমিনুল ওরফে বাঁধন ও এসএম সানোয়ার হোসেনকে নিয়ে সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। তাদের এই চক্রে যুক্ত হন অন্তত পাঁচজন চিকিৎসক। যারা কোচিং সেন্টারে মেডিকেল শিক্ষার্থীদের ক্লাস নিতেন।
সিআইডির সাইবার পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, আবদুস সালামের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ওই পাঁচ চিকিৎসককেও শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য-প্রমাণ হাতে নেওয়ার পর আইনের আওতায় নেওয়া হবে।

মেডিকেল ও ডেন্টালের শতাধিক শিক্ষার্থীকে খুঁজছে সিআইডি :সিআইডি সূত্র জানায়, যারা সালাম সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র কিনে ভর্তি পরীক্ষায় পাস করে মেডিকেল বা ডেন্টাল কলেজে ভর্তি হয়েছেন, এমন শিক্ষার্থীদের বিষয়েও অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। তাদের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য নিয়ে আইনের আওতায় নেওয়া হবে। বিভিন্ন সময়ে গ্রেপ্তার হওয়া সালাম সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্য জসিম উদ্দিন ভূঁইয়ার কাছ থেকে এমন কয়েক শিক্ষার্থীর নাম-ঠিকানাও পাওয়া গেছে। এ ছাড়া যারা মেডিকেল বা ডেন্টালে ভর্তি পরীক্ষার মৌসুমে সালাম সিন্ডিকেটের সদস্যদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে লেনদেন করেছেন, তাদের বিষয়ে অনুসন্ধান করা হচ্ছে। এমন শতাধিক শিক্ষার্থীর বিষয়ে খোঁজ নেওয়া হচ্ছে।

সিআইডির সাইবার সেন্টারের বিশেষ পুলিশ সুপার এস এম আশরাফুল আলম বলেন, বিভিন্ন হাত ঘুরে ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা কিনে নিতেন। এ জন্য যারা প্রশ্নপত্র কিনে মেডিকেলে ভর্তি হয়েছিলেন, তাদের চিহ্নিত করতে সময় লাগছে। তবে নানা সূত্রের মাধ্যমে এরই মধ্যে অনেকের বিষয়ে তথ্য মিলেছে। শতভাগ প্রমাণ হাতে পাওয়ার পর ফাঁস হওয়া প্রশ্নে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সিআইডি সূত্র জানায়, চলতি বছরের ১৯ জুলাই সালাম সিন্ডিকেটের সদস্য জসিম উদ্দিন ভূঁইয়াকে গ্রেপ্তার করে তার ব্যাংক লেনদেনের তথ্য নেওয়া হয়। ওই লেনদেনের সূত্র ধরে শতাধিক শিক্ষার্থীর তথ্য মেলে। তাদের মধ্যে এখন পর্যন্ত সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজের একজন শিক্ষার্থী, বরিশাল মেডিকেল কলেজের একজন শিক্ষার্থী, খুলনা মেডিকেল কলেজের একজন এবং ঢাকার বিভিন্ন মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজের একাধিক শিক্ষার্থীর বিষয়ে অনুসন্ধান চলছে। তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়াও গ্রামের বাড়ির ঠিকানাও সংগ্রহ করা হচ্ছে।

আমাদের বাণী ডট কম/৮ অক্টোবর ২০২০/পিপিএম

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।