আঞ্চলিক ভাষায় ভাব বা ভাবনা থেকে ভাওয়াইয়া শব্দের উৎপত্তি বলে অনেকে মনে করেন। তবে রংপুর অঞ্চলের কথ্য ভাষাকে কাব্যিক ঢংয়ে যে গান রচনা হয় তাকেই ভাওয়াইয়া গান বলে। যে গানে তুলে ধরা হয় সমাজের ভাবনাকে। সেই গানের কিংবদন্তী ছিলেন মহেশ চন্দ্র রায়। তিনি রংপুর বেতারের প্রথম শ্রেণির তালিকাভুক্ত শিল্পী ছিলেন। প্রতিদিন রংপুর বেতার থেকে বিকেল ৪.৩০ মিনিটে এ গান প্রচার হয়। তিস্তা নদীর নামে ভাওয়াইয়া গানের প্রচার অনুষ্ঠানটির নাম তিস্তা পারের গান। প্রমত্তা তিস্তা যেমন আজ মরা খাল, রেডিওর স্থান হয়েছে কাপড় রাখার বাক্সে তেমনি ভাওয়াইয়া গানের শিল্পী শ্রোতাও শূন্যের কোঠায় নামতে শুরু করেছে। ৯০’র দশক পর্যন্ত বাড়ির বউঝিরা বিকাল সাড়ে ৪টা বাজার আগেই রেডিও নিয়ে অপেক্ষা করতো। সাড়ে ৪টা বাজার সঙ্গে সঙ্গেই রেডিওর ভলিউম অন করে রংপুর বেতারে সংযোগ দেয়া হতো। তখন তিস্তাপাড়ের গানের অনুষ্ঠানে প্রচার হয় ভাওয়াইয়া গান। একেক দিন একেক ভাওয়াইয়া শিল্পীর গান প্রচার হয়। তবে মহেশ চন্দ্র রায়ের গানের শ্রোতা অন্যান্য শিল্পীদের চেয়ে শতগুণ বেশি।

সবচেয়ে মহিলারা তার গানের বেশি শ্রোতা ছিলেন। সমসাময়িক ঘটনা নিয়ে মহেশ চন্দ্র রায় গান রচনা করতেন, নিজে সুর দিতেন এবং গাইতেন। বলতে গেলে তিনি ছিলেন থ্রি ইন ওয়ান। সুরের যাদুকর ওই শিল্পী ৭৫ বছর বয়সে ১৯৯৩ সালের ২৯ জানুয়ারি মারা যান। গীতি কবি মহেশ চন্দ্র রায়ের বাড়ি ছিল নীলফামারী সদর উপজেলার সংগলশী ইউনিয়নের দীঘলডাঙ্গী গ্রামে। তার জন্মস্থান হলো এই জেলার কিশোরগঞ্জ উপজেলার পুটিমারী গ্রামে। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে তিনি মা হারা হন। তার বাবার নাম বাবুরাম রায় ও মায়ের নাম বিমলা রাণী রায়। পিতামহি তাকে মায়ের স্নেহে লালন পালন করেন। নীলফামালী সদরের সংগলশী ইউনিয়নের দীঘলডাঙ্গী গ্রামের গগন চন্দ্র রায়ের ছোট মেয়ে বীনাপানি রায়কে বিয়ে করে শ্বশুর বাড়িতেই অবস্থান করেন।

প্রয়াত মহেশ চন্দ্র রায়ের অধিবাস এলাকার জ্যেষ্ঠ নাগরিকরা জানান মূলত তিনি ছিলেন চারণ ভাওয়াইয়া শিল্পী। তার গানের কথায় গ্রাম্য সমাজের সুখ, দুঃখ, হাসি, কান্না, বিরহ, ব্যাথা, কৃষি, বন্যা স্থান পেয়েছে। প্রকৃতিও তার গানের কথা থেকে বাদ যায়নি। অসাম্প্রদায়িক চেতনাধারী হওয়ায় তিনি ছিলেন সকল ধরনের প্রাণিভক্ত মানুষ।

এ প্রসঙ্গে কথা হয় নীলফামারীর সিনিয়র সাংবাদিক জসিম উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি জানান, আশির দশকে সোনা ব্যাঙ ধরে বিদেশে রপ্তানি করা হতো। রপ্তানিকারকের এজেন্টরা বিভিন্ন লোক দিয়ে ব্যাঙ ধরে তা কেটে হিমায়িত করে বিদেশে পাঠাতো। এমন ধরনের ব্যাঙ কেনার আড়ত গড়ে উঠেছিল বর্তমান খয়রাত নগর রেলস্টেশনে (যা পূর্বে ছিল উলটপাড়া রেল স্টেশন)। সেখানে আড়তদাররা বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে ব্যাঙ কিনে নিয়ে ব্যাঙের মাথা ও পা কেটে ফেলে দিত। ধর থেকে মাথা আলাদা করার পরেও ব্যাঙ ডাকতো। রেল স্টেশনের পাশে শীতানাথের চায়ের দোকানে প্রতিদিন সকালে মহেশ চন্দ্র রায় বাড়ি থেকে এসে চা খেতো। আর ওই দোকানে বাঁশের তৈরী বেঞ্চে বসে দিত আড্ডা। একদিন তার নজর পড়ে যায় ব্যাঙ কাটার দৃশ্য এবং দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন ব্যাঙের মাথার আর্তচিৎকার। ব্যাঙের আর্তচিৎকার শুনে তিনি তখনই গান লিখে শুরু করে গাইতে থাকেন ব্যাঙ হত্যার বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টি করতে। সেই গানের কথা ছিল এমন ঘ্যাৎ ঘোৎ চিরিত চারাত, ব্যাঙ ডাকেছে উলোট পাড়াত, কাউলিয়া কাউলিয়ারে। ব্যাঙের আর্তনাদকে ঘিরে রচনা তার ওই গানটি সেই সমং রংপুর বেতার থেকে প্রচারিত হলে টনক নড়ে দেশের নীতি নির্ধারক মহলে। পরে সরকার অবশ্য ব্যাঙ ধরা এবং রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। ওই সাংবাদিকের মতে বর্ষাকালে পানির তোড়ে মাছ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ক্ষেতে খামারে ডোবা, নালা, নদীতে বেশ মাছ পাওয়া যায়। গ্রামের মানুষরা দেশীয় তৈরী মাছ ধরার যন্ত্র দিয়ে মাছ ধরেন। সেই মাছ ধরা এবং মাছ ধরার দেশীয় যন্ত্র নিয়েও তিনি গান রচনা করে গেয়েছেন। আর তা হলো আইল কাটিয়া জোলোংগা বসানু ধরিবার আশায় চ্যাঙ, সগায় (সবাই) পাইল শিংগী মাগুর, মোর কপাল চাপুয়া হোলা ব্যাঙ। এ গানে তার মাছ না পাওয়ার বেদনার কথা উঠে এসেছে।
কথা হয় প্রয়াত মহেশ চন্দ্র রায়ের বড় মেয়ে স্বর্গীয় মাধবী লতা রায়ের ছেলে গোপাল চন্দ্র রায়ের সঙ্গে। তিনি তার মায়ের মুখে শুনেছেন বিয়ের পরে গরুর বাড়ীতে চড়ে যখন তার মা শ্বশুর বাড়িতে আসছিল, এ সময় ছইওয়ালা গরুরগাড়ী থেকে বার বার বাবার বাড়ির দিকে তাকাচ্ছিল তার মা। মেয়ের সেই তাকানোর আকুতি ঘিরে তার নানা গান রচনা করেছিলেন, ধীরে বোলাওরে গাড়িয়াল আস্তে বোলাও গাড়ী, আর এক নজর দেখিয়া নেওরে মুই দয়াল বাপের বাড়ি। এই গানটি রংপুর বেতারে মহেশ চন্দ্র রায়ের কন্ঠে প্রচারিত হওয়ায় দেশজুড়ে নারী সমাজের হৃদয়ে ব্যাপক নাড়া দেয়। সেই সময়ে রংপুর অঞ্চলের মানুষের মুখে মুখে গানটি আলোড়ন তুলেছিল।

মরণাপন্ন দাদীর শিয়রে বসে নাতনি কাঁদছে আর বিলাপ করছে, এই ঘটনাকে ঘিরে শিল্পী মহেশ চন্দ্র রায় রচনা করেন ও আবো (দাদী) তুই মরিয়া গেইলে নাইওর মোক কায় নিয়া যাইবে, নারু, চিড়া, মুড়কির ভোকনা (পোটলা) কায় পাঠায়ে দিবে। এছাড়াও নাতনীর অসুখের পর মুখে স্বাদ ফেরাতে দাদী যে মাছের তরকারি রান্না করে নাতনীকে খাইয়েছিলেন সেই বিষয়ে তার রচিত গান হলো খোড়া নদীর মাগুর মাছ, পোড়ার হাটের অসুন (রশুন) শাক, কায় (কে) আন্দিায়া (রেধে) দিবে মোক (আমাকে) ঝোলে ঝালে, ও আবো তুই মরিয়া গেইলে। মধুমাসে নানার বাড়িতে আম কাঁঠাল নিয়ে যাওয়াকে ঘিরে মহেশ চন্দ্র রায়ের লেখা গান হলো, কাইল (কাল) গেছুনু নানার ঘরে বাড়ি, গাছের আম গাছের কাঁঠাল দুই চাঙারি (ডালি) ধরি, ঘাটাও নোহায় ঘোরত (রাস্তা অনেক দূর) ইছামতির পারত, দুপুরি অইদোত (দুপুরের রোদে) ভাড় উভিয়া (ভারে করে) ফোসা পইল কাঙ্গোত (কাঁধে)। এমন হাজারো আঞ্চলিক ভাষায় গাওয়া গান রয়েছে ভাওয়াই গানের রাজা মহেশ চন্দ্রের কন্ঠে। তার রচিত পল্লীগীতি হলো তিস্তা নদীরে এই কি রে তোর খেলা, ভাসায়ে নিলু সাধের ডিংগা, মোক থুইয়া একেলা। তার গাওয়া এবং লেখা দেশ গান রক্ত দিয়া ওরা লিখে গেছে নাম, রফিক, জব্বার আর বরকত সালাম। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় তার লেখা গান বাংলা হামার নাড়ী পোতা জাগারে, হামরা গিলা (আমরা) বাংলাদেশী, বাংলা হামার (আমাদের) মাও, কোল জুড়িয়া আছি মায়ের, দশ কোটি ছাও (সন্তান)।
মহেশ চন্দ্র রায়ের প্রতিটি গানের কথায় দেশপ্রেম, মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা আর সমাজে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনার প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে। দেবরের প্রতি ভাবীর ছোট খাটো চাওয়া পাওয়ার বিবরণ তার গানে পাওয়া যায়। যেমন ও দ্যাওড়ারে (দেবর) আম পাড়ায়ে দে, ঝিকের (বাঁশের কথিড়) কোঠা দিয়া, খাটা খাবার মনায়ছে (মন চাইছে) মোক, পাটাশাক তুলিয়া। অথচ সৃষ্টিশালী দেশপ্রেমিক এ মানুষটি আজ সমাজ থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে। রেডিওর চল উঠে যাওয়ায় তার গান আজ গ্রামের মানুষেরা শুনতে পায় না। ভাওয়াইয়া গানের চর্চা না থাকায় নতুন কোন ভাওয়াইয়া শিল্পী গড়ে উঠছে না। অন্য গানের শিল্পীরাও মহেশ চন্দ্র রায়ের গান গাইছেন না। ফলে ধীরে ধীরে যাদুকরী কন্ঠের ওই মহান শিল্পী মানুষের স্মৃতি থেকে হারিয়ে যাচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে কথা হয় রংপুর বেতারের গীতিকার কাজী জাহিদের সঙ্গে। তিনি মাটি ও মানুষের শিল্পী মহেশ চন্দ্র রায়ের গানকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে দেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে অন্যান্য গানের অনুষ্ঠানের মতো রংপুর অঞ্চলের ভাওয়াইয়া গানের অনুষ্ঠান করার দাবি জানান। আর গানের মূল সুর থেকে কখনই সরে আসা যাবে না বলে মন্তব্য করেন। ভাওয়াইয়া গানের ঐতিহ্য ফেরাতে কথা হয় ভাওয়াই শিল্পী গীতিকবি মহেশ চন্দ্র রায়ের ছাত্রী সৈয়দপুর সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত) নার্জিজ বানুর সঙ্গে। তিনি বলেন রেডিওর শ্রোতা নেই বললেই চলে। সে কারণে প্রয়াত মহেশ চন্দ্রের গান চর্চা ও বাঁচিয়ে রাখতে হলে নীলফামারীতে ভাওয়াইয়া একাডেমি প্রতিষ্ঠা সময়ের দাবি হয়ে উঠেছে। তাছাড়াও অন্যান্য অঞ্চলের লোক সংগীতের গীতিকারের মতো মহেশ চন্দ্র রায়ের গানের চর্চা উদীয়মান শিল্পীদের গলায় তুলে নিয়মিত গাওয়া হলে ওই গুণি শিল্পীকে মানুষের মাঝে বাঁচিয়ে রাখা যেতে পারে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।