যশোরের সীমান্তবর্তী উপজেলা শার্শা। উপজেলা সদর থেকে মাত্র ২০ কিলোমিটার উত্তরে সীমান্তঘেঁষা গ্রামের নাম কাশিপুর। ওপারে ভারতের চব্বিশ পরগনার বয়রা। বাংলাদেশ সীমান্তের গোবিনাথপুর আর কাশিপুর মৌজার সীমানার কাশিপুর পুকুর পাড়ে চিরতরে ঘুমিয়ে আছেন বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদসহ সাতজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা। এখানে নির্মাণ করা হয়েছে শহীদ বীরশ্রেষ্ঠ ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ শেখ স্মৃতিস্তম্ভ। তারা দেশের জন্য প্রাণ দিয়ে দেশকে শত্রুমুক্ত করে চিরদিনের মত ঘুমিয়ে আছেন এখানে।

অপর ছয়জন হলেন- শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল আহাদ, শহীদ সুবেদার মনিরুজ্জামান (প্রাক্তন ইপিআর), শহীদ সৈয়দ আতর আলী (তদানীন্তন গণপরিষদ সদস্য), শহীদ বাহাদুর আলী, শহীদ সিপাহী আব্দুস ছাত্তার বীর বিক্রম (প্রাক্তন ইপিআর) ও শহীদ সিপাহী এনামুল হক বীর প্রতীক (প্রাক্তন ইপিআর)।

তবে স্বাধীনতার ৪৯ বছরেও সংরক্ষণ হয়নি বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদের স্মৃতিস্তম্ভ। এখানে একটি মুক্তিযোদ্ধা মিউজিয়াম স্থাপন করার কথা থাকলেও আজ পর্যন্ত তা বাস্তবায়ন করা হয়নি। সরকারিভাবে তদারকির জন্য এলাকাবাসী এখানে একজন কেয়ারটেকার রাখার দাবি করলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি।

আজ ৫ সেপ্টেম্বর। স্বাধীনতার সূর্য সন্তান বীর শ্রেষ্ঠ ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদের ৪৯তম শাহাদতবার্ষিকী। সৈনিক জীবনের কঠিন কর্তব্য দায়িত্ববোধ থেকে বিচ্যুত না হয়ে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। সহযোদ্ধাদের জীবন বাঁচাতে নিজে এগিয়ে গেছেন নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে। তার সে চেষ্টা সার্থক হয়েছিল। নিরাপদে ফিরতে পেরেছিলেন সহযোদ্ধারা। শুধু ফিরে আসেননি নূর মোহাম্মদ। শত্রুপক্ষের একটি মর্টারের গোলা শেষ পর্যন্ত কেড়ে নিয়েছিল তার জীবন। পরে জঙ্গলের মধ্যে পাওয়া যায় এই বীরশ্রেষ্ঠর নিস্তেজ দেহটি। পাকিস্তানি হায়েনারা উপড়ে ফেলেছিল তার দুটি চোখ। দেহকে ছিন্নভিন্ন করেছিল বেয়নেটের খোঁচায়।

নূর মোহাম্মদ শেখের জন্ম ১৯৩৬ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি, নড়াইল জেলার মহিষখোলা গ্রামে। বাবা মোহাম্মদ আমানত শেখ, মা জেন্নাতুন্নেসা। শৈশবেই বাবা-মাকে হারানোয় পড়াশোনা করতে পারেননি বেশি। ১৯৫৯ সালে যোগ দেন পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর)-এ। ১৯৭০ সালে ল্যান্স নায়েক পদে উন্নীত হয়ে আসেন যশোর সেক্টর সদর দফতরে।

১৯৭১ সালের মার্চ মাসে গ্রামের বাড়িতে ছুটি কাটাতে আসেন নূর মোহাম্মদ। জাতির ক্রান্তিলগ্নে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারেননি তিনি। যোগ দেন মুক্তিবাহিনীতে। ১৯৭১-এর ৫ সেপ্টেম্বর নূর মোহাম্মদকে অধিনায়ক করে একটি স্ট্যান্ডিং পেট্রল পাঠানো হয় যশোর জেলার গোয়ালহাটি গ্রামে। টের পেয়ে পাক সেনারা চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে তাদের। শুরু হয় গুলিবর্ষণ। সহযোদ্ধাদের বাঁচাতে জীবনবাজি রেখে আক্রমণের মোকাবিলা করতে থাকেন নূর মোহাম্মদ শেখ। এক পর্যায়ে কামানের গোলার আঘাতে লুটিয়ে পড়েন সেখানেই। পরে তার মরদেহ উদ্ধার করেন সহযোদ্ধারা। পরে কাশিপুর সীমান্তের মুক্ত এলাকায় তাকে সামরিক মর্যাদায় দাফন করা হয়। মুক্তিযুদ্ধে বীরোচিত ভূমিকা ও আত্মত্যাগের স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ খেতাবে ভূষিত করা হয়।

এদিকে বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদসহ সাত শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্মৃতিস্তম্ভ প্রতি বছর ২-১ বার ধুয়ে মুছে জাতীয় দিবসগুলো পালন করেই যেন দায়িত্ব শেষ। স্মৃতিস্মম্ভগুলো সরকারিভাবে রক্ষণাবেক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেই। স্মৃতিস্তম্ভগুলো আজও পড়ে আছে অযত্ন আর অবহেলায়। সরকারিভাবে রক্ষণাবেক্ষণ না করায় সীমান্তঘেঁষা অজপাড়া গাঁয়ের এসব শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিস্তম্ভ আজ বনে জঙ্গলে পরিণত হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে এসব মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে এখানে একটি মুক্তিযোদ্ধা মিউজিয়াম স্থাপন করার কথা থাকলেও আজ পর্যন্ত তা বাস্তবায়ন হয়নি। সরকারিভাবে তদারকির জন্য এলাকাবাসী এখানে একজন কেয়ারটেকার রাখার দাবি করলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি ৪৯ বছরেও।

প্রতিবছর স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস ও তার মৃত্যু দিবসে ওই এলাকার বিভিন্ন স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীরা এসে তার স্মৃতি সৌধে ফুল দিয়ে যান। ফুল দেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা। উপজেলা প্রশাসন ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও এসব দিবসে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। গ্রামবাসী মিলাদ দেন প্রতি বছর। তারা গর্ববোধ করেন একজন বীর শ্রেষ্ঠের স্মৃতিসৌধ তাদের গ্রামে থাকার জন্য।

এ উপলক্ষে শনিবার কাশিপুর নূর মোহাম্মদ স্মৃতি সৌধে বিজিবি, উপজেলা প্রশাসন, সরকারি বীরশ্রেষ্ট নূর মোহাম্মাদ কলেজ, উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে, বীরের সম্মানে গার্ড অব অনার, স্মৃতি সৌধে শ্রদ্ধাঞ্জালি অর্পণ, রুহের মাগফিরাত কামনা করে দোয়া ও আলোচনা সভা।

এলাকাবাসী ও শহীদ বীরশ্রেষ্ঠ ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ শেখের পরিবারের সদস্যরা জানান, বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখের স্মৃতিস্তম্ভ সারাবছর ধরে খুব কঠিন অবস্থার মধ্যে থাকে। সেখানে কোনো নিরাপত্তা বেষ্টনী নেই। বাইরে থেকে কেউ আসলে বসার রুম বা রেস্ট রুমের কোনো ব্যবস্থা আজও করা হয়নি। ইতোমধ্যে উপজেলা থেকে একটি প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে সচিবের নিকট। জায়গাটাকে সুন্দর করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবি জানান তারা।

যশোরের জেলা প্রশাসক তমিজুল ইসলাম খান বলেন, স্থানীয় জনগণের দাবির বিষয়টি আমি শুনেছি। আমরা এই জেলায় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সম্বলিত যে সমস্ত স্থাপনা রয়েছে বা যে সমস্ত বিষয়গুলো রয়েছে সেগুলো সব সংরক্ষণের জন্য ব্যবস্থা নিচ্ছি। আমরা ইতোমধ্যে কিছু কিছু জায়গায় কিছু কার্যক্রম শুরু করেছি। বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ নূর মোহাম্মদের যে স্মৃতিস্তম্ভ রয়েছে, সেটা যথাযোগ্য মর্যাদায় আমরা সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিব এবং এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে আমরা অবহিত করব।

 

আমাদের বাণী ডট কম/০৫ সেপ্টেম্বর ২০২০/পিপিএম

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।