ডেস্ক রিপোর্ট, ঢাকা;‘রোজার ঈদে ছোট ছেলেডা নতুন জামা চাইছিল। তখন ওরে করোনার ভয় দেখাইয়া কইছি, কোরবানিতে দেব। গত এক সপ্তাহ ধইরা পোলায় মার্কেটে যাওয়ার জন্য কানতাছে। হামারো (আমার) তো মনে চায় ঈদে পোলাপানরে নতুন কাপড়চোপড় দিতে। কিন্তু কী করমু। এপ্রিল থেইক্কা বেতন পাই না। রিকশা চালাইয়া পেট চালাই। কিন্তু করোনায় যাত্রীও মেলে না। কবে বেতন পামু তা-ও জানি না। পোলাপানের মুখের দিকে তাকালে কান্না আসে। লজ্জায় ওদের সামনে যেতে পারি না।’
কথাগুলো বলছিলেন টানা তিন মাস বেতন বকেয়া থাকা জয়পুরহাট চিনিকল শ্রমিক তাজুল ইসলাম। শুধু তাজুল নয়, বেতন না পেয়ে এমন করুণ অবস্থা বাংলাদেশ চিনি শিল্প করপোরেশনের অধীন ১৫টি চিনিকলের হাজার হাজার শ্রমিক ও সেখানে আখ বিক্রি করা চাষিদের। কবে তারা বকেয়া টাকা পাবেন তা-ও জানেন না। আন্দোলনেও মিলছে না কোনো প্রতিকার। অথচ করোনা ও বন্যায় তাদের জীবন এখন বিপর্যস্ত। শ্রমিকরা বলছেন, পরিবার নিয়ে এখন তাদের রাস্তায় নামার উপক্রম হয়েছে।
জয়পুরহাট চিনিকলের শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের সহসাধারণ সম্পাদক জহুরুল হক জুয়েল বলেন, ‘বকেয়া বেতনের দাবিতে অবস্থান ধর্মঘট, কর্মবিরতি, মানববন্ধন, জাতীয় মহাসড়কে বিক্ষোভ মিছিলসহ শান্তিপূর্ণ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছি। তারপরও কোনো কাজ হয়নি। সামনে কোরবানির ঈদ। অথচ শ্রমিকদের জন্য এখনো কিছুই করতে পারিনি। বেতন দেবে কি না তা-ও জানি না।’
করোনা ও বন্যা পরিস্থিতিতে শ্রমিকরা যখন ক্ষুধার তাড়নায় রাস্তায়, তখন বেতন পরিশোধে তেমন কোনো তাড়া নেই ঋণের বোঝায় জর্জরিত বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের। ব্যাংকের কাছে টাকা না পেয়ে সরকারের কাছে টাকার আবেদন করেই দায় সেরেছে প্রতিষ্ঠানটি। চিনি বিক্রি করতে পারলে বা সরকার কখনো ভর্তুকি দিলেই বেতন দেওয়ার উদ্যোগ নেবে করপোরেশন।
করপোরেশনের চেয়ারম্যান সনৎ কুমার সাহা বলেন, ‘আমাদের কাছে টাকা নেই। ব্যাংক নতুন করে ঋণ দিচ্ছে না। আমদানি চিনির চেয়ে বেশি দাম হওয়ায় আমাদের চিনিও কেউ কিনছে না। সরকার যদি টাকা দেয় তাহলে শ্রমিকের বেতন দেওয়া সম্ভব হবে।’
করপোরেশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বর্তমানে তাদের অধীন চিনিকলের সংখ্যা ১৫টি। এসব কারখানায় কর্মরত ১৬ হাজার নিয়মিত শ্রমিককে মাসে প্রায় ২২ কোটি টাকা বেতন দিতে হয়। কারখানাগুলোতে বছরে ৪-৫ মাস কাজ থাকে। এ সময় কিছু অনিয়মিত শ্রমিককেও নেওয়া হয়। বাকি সময়টা সবাই অলস কাটায়।
চাষিদের থেকে আখ কিনে মাড়াই করে চিনি ও চিটাগুড় উৎপাদন করা হয়। আখের দাম, শ্রমিকের মজুরি, কারখানার খরচ ও ব্যাংক ঋণের সুদসহ প্রতিকেজি চিনি উৎপাদনে খরচ হয় প্রায় ২০০ টাকা। আর চিনি ও চিটাগুড় বিক্রি করে আয় আসে কেজিতে গড়ে ৭০ টাকা, অর্থাৎ কেজিপ্রতি চিনিতে লোকসান ১৩০ টাকা।
দেশে বছরে প্রায় ১৮ থেকে ২০ লাখ টন চিনি আমদানি হলেও চিনি শিল্প করপোরেশন উৎপাদন করে মাত্র ৬০ হাজার টনের মতো। প্রতিবছর এই স্বল্পসংখ্যক পরিমাণের চিনি উৎপাদনে বিশাল ভর্তুকি দেওয়ায় অনেকেই কলগুলোকে বন্ধ করে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। বর্তমানে করপোরেশনের কাছে ৫৩ হাজার টন চিনি ও ৩০ হাজার টন চিটাগুড় অবিক্রীত রয়েছে।
করপোরেশন কারখানার বিশাল অঙ্কের ভর্তুকি দিতে প্রতিবছর সরকার ও ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ নেয়। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২০ অনুযায়ী, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে চিনি শিল্প করপোরেশনের লোকসান ছিল ৫১৬ কোটি ৫২ লাখ টাকা। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত তা বেড়ে দাঁড়ায় ৯৮২ কোটি টাকায়। ২০১৯ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত করপোরেশনের বকেয়া ঋণের পরিমাণ ছিল ৬ হাজার ৫৩ কোটি টাকা। বর্তমানে তা প্রায় সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছেছে।
এক বছরেরও বেশি সময় ধরে ঋণ পরিশোধ না করায় ব্যাংক এখন আর ঋণ দিচ্ছে না। সরকারের পক্ষ থেকেও এ বছর কোনো ভর্তুকি আসেনি। চিনিও বিক্রি হচ্ছে না। তাই তিন মাস ধরে শ্রমিকের বেতন বন্ধ। জুলাইয়ের বেতন যুক্ত হলে তা চার মাসে দাঁড়াবে। এছাড়া গ্রাচুয়িটির টাকাসহ অন্যান্য ভাতা তো আরও আগেই বন্ধ হয়ে আছে। এর আগে চলতি বছরের জানুয়ারি-মার্চ মাসের বেতন বকেয়া ছিল। তখন কিছু চিনি বিক্রি করে বেতন দিয়েছিল করপোরেশন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে করপোরেশনের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, ‘আগে টাকা না দিতে পারলে শ্রমিক ও চাষিদের চিনি দিতাম। কিন্তু বাইরের চিনির দাম কমে যাওয়ায় এখন তারাও চিনি নিচ্ছে না। দাম কমালে তো ভর্তুকি আরও বাড়বে। কবে যে তারা টাকা পাবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।’
শুধু শ্রমিক নয় চিনিকলে আখ দিয়ে বিপাকে আছেন দেশের হাজার হাজার আখচাষি। তারা গত মৌসুমে আখ দিয়েছিলেন। কিছুদিন পরেই নতুন মৌসুম শুরু হবে। কিন্তু এখনো চাষিদের বড় একটি অংশ গত মৌসুমের আখের দাম পাননি। তাদের চিনি নিতে বলেছিল মিল কর্র্তৃপক্ষ। কিন্তু দাম না থাকায় তা-ও নিতে পারছেন না। অথচ যারা ঋণের টাকায় আখ চাষ করেছিলেন তারা মহাজনের চাপে দিশেহারা।
গাইবান্ধার আখচাষি আজাদুল ইসলাম বলেন, ‘কোম্পানি টাকা দিতে না পারায় মহাজনের টাকা দিতে পারিনি। কিন্তু সুদ ঠিকই দিয়ে যাচ্ছি। টাকা চাইতে গেলেই বলে চিনি নিয়ে যেতে। এখন কি আমি লোকসান দিয়ে চিনি নেব?’
চিনিকল শ্রমিকের এমন দুর্দশা কতদিন চলবে তা জানে না কেউ। কিন্তু শ্রমিকরা ততদিন কীভাবে চলবেন? বিগত বছরগুলোতে প্রায়ই এমন দুর্দশা লেগে থাকছে তাদের ভাগ্যে। তাই তারা এর একটি স্থায়ী সমাধান চান। চাষিরাও সময়মতো আখের ন্যায্য মূল্য চান। কিন্তু এর প্রতিকারে তাদের কী করতে হবে তা নিয়েও অন্ধকারে।
বাংলাদেশ চিনিকল শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক মো. আনারুল হক বলন, ‘বিভিন্ন সময় সংকট নিরসনে দাবি জানালেও এর কোনো সমাধান হয়নি। বর্তমান চেয়ারম্যানের কাছে আমরা বারবার আকুতি জানালেও তিনি আমাদের কথা কর্ণপাত করেন না। এভাবে চলতে থাকলে আমাদের না খেয়ে মরতে হবে। দ্রুত বেতন ভাতা পরিশোধে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন তিনি।’
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য অ্যাডভোকেট নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন ও শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদারের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করলেও তারা কেউ ফোন রিসিভ করেননি।
সূত্র; দেশ রূপান্তর