প্রাক-প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার অন্তত ৫০টি আইন রয়েছে। এসব আইন প্রয়োগ করতে গিয়ে একটির সঙ্গে অন্যটির সাংঘর্ষিক অবস্থা তৈরি হয়। এতে নানা ধরনের জটিলতা সৃষ্টি হয়। এ জটিলতা কমাতে সব আইনগুলোকে এক ছাতার নিচে (আমব্রেলা আইন) করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সে লক্ষ্যে আজ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উচ্চপর্যায়ে একটি বৈঠক ডাকা হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, পাবলিক পরীক্ষা (অপরাধ) আইন ১৯৮০ এবং পাবলিক পরীক্ষা সংশোধনী ১৯৯২-এ প্রশ্নপত্র ফাঁস, প্রকাশ বা বিতরণের সঙ্গে জড়িত থাকার শাস্তি নূ্যনতম ৩ বছর থেকে সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদন্ডসহ অর্থদন্ডের বিধান রয়েছে। এখন নতুন আইনে প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে যুক্তদের শাস্তি বাড়াতে চায় সরকার। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এটা করতে হলে আগের আইন বাতিল করতে হবে। প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ্যপুস্তকের নোট বা গাইড বই মুদ্রণ ও বাজারজাত সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। ১৯৮০ সালের নোট বই (নিষিদ্ধকরণ) আইনে এই বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। এই আইন লঙ্ঘনের দায়ে সর্বোচ্চ সাত বছরের সশ্রম কারাদন্ড অথবা ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদন্ড অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত করার বিধান রয়েছে। পরবর্তীতে ২০০৮ সালে হাইকোর্ট বিভাগের এক আদেশে নোট বইয়ের পাশাপাশি গাইড বইও নিষিদ্ধ করা হয়। এরপর ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে আপিল বিভাগ হাইকোর্ট বিভাগের এই আদেশ বহাল রাখে। সরকার এখন নোট-গাইড নিষিদ্ধ করতে চায়। কর্মকর্তারা বলছেন, এটি করতে হলেও আগের আইনের কী হবে সে বিষয়ে ফয়সালা করতে হবে। এসব জটিলতার কারণে আট বছর ধরে ঝুলে আছে শিক্ষা আইন।

মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত বছর জুলাই মাসে ৬ষ্ঠ বারের মতো শিক্ষা আইনের খসড়াটি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হয়। মন্ত্রিপরিষদের আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি আইনটি বিভিন্ন ধারা-উপধারা পর্যালোচনা করে ১২ ধরনের পর্যবেক্ষণ দেয়। এতে বিভিন্ন ধরনের অসঙ্গতি রয়েছে বলে বলা হয়। কমিটি আইনের খসড়ায় নানা রকম ক্রটি, পরস্পরবিরোধী তথ্য এবং ভাষাগত সীমাবদ্ধতার পাশাপাশি বিদ্যমান বিভিন্ন আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ধারা-উপধারা রয়েছে বলে পর্যবেক্ষণে উলেস্নখ করেন। একই সঙ্গে প্রাথমিক থেকে উচ্চ স্তরের যে আইনগুলো রয়েছে তা যাচাই-বাছাই করে একটি আমব্রেলা আইন (এক ছাতার নিচে সব আইন) করার পরামর্শ দেন। এরপর এক বছর পর সেই পর্যবেক্ষণগুলো সামনে এনে নতুন করে কাজ শুরু করছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

আজকের সভায় সভাপতিত্ব করবেন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. জাবেদ আহমেদ। সভায় এ আইনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের ডাকা হয়েছে। সভায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরামর্শক হিসেবে প্রাক্তন সচিব কাজী হাবিবুল আউয়াল এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাবেক অতিরিক্ত সচিব ও ইউনিসেফের পরামর্শক চৌধুরী মুফাদ আহমদ থাকবেন। এছাড়া মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের নিরীক্ষা ও আইন শাখার অতিরিক্ত সচিব খালেদা আক্তার, দুজন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, একজন সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ, একজন বেসরকারি কলেজের অধ্যক্ষ, দুজন মাদরাসা সুপার এবং দুজন বিএম কলেজের অধ্যক্ষকে সভায় উপস্থিত থাকতে বলা হয়েছে।

এ ব্যাপারে সভার সভাপতি ও অতিরিক্ত সচিব মো. জাবেদ আহমেদ বলেন, আইনের খসড়াটি পরিমার্জন করা হচ্ছে। খসড়টি পরিমার্জনের বিষয়ে পরামর্শ দিতে দুজন পরামর্শক নিয়োগ করা হয়েছে। আজকের সভায় পরামর্শকরা আইনের খসড়টি পরিবর্তনের বিষয়ে তাদের চিন্তাধারা স্টেকহোল্ডারদের সামনে তুলে ধরবেন। তারপর অন্যান্য বিষয় নিয়ে আমরা কাজ শুরু করব।

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিক্ষানীতির আলোকে শিক্ষা আইন হবে একটি। কিন্তু বর্তমানে প্রায় অর্ধশতাধিক আইন বিদ্যমান রয়েছে। যেমন বাংলাদেশ বাধ্যতামূলক প্রাথমিক আইন, ১৯৯০ রয়েছে। নতুন করে আইন করতে হলে এ আইন রহিত বা এ আইনের মধ্যে ঢোকাতে হবে। কিন্তু শিক্ষা আইনের খসড়ায় বাধ্যতামূলক প্রাথমিক আইনের কিছু ধারা শিক্ষা আইনে রাখা হয়েছে আবার কিছু বিষয় বাদ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া নোট ও গাইড নিষিদ্ধকরণ এবং পাবলিক পরীক্ষা অপরাধ আইন থাকা সত্ত্বেও এগুলোর শাস্তির ধারাগুলো প্রস্তাবিত শিক্ষা আইনে রাখা হয়েছে। এসব ধারা শিক্ষা আইনে রাখতে হলে পুরনো দুটি আইন সংশোধন করতে হবে। এজন্য এ দুটি ধারা আদৌ শিক্ষা আইনে রাখার প্রয়োজন রয়েছে কি না তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখার কথা বলা হয়েছিল।

জানা গেছে, প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ্যপুস্তকের নোট বা গাইড বই মুদ্রণ ও বাজারজাতকরণ নিষিদ্ধ। ১৯৮০ সালের নোট বই (নিষিদ্ধকরণ) আইনে এই বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। এই আইন লঙ্ঘনের দায়ে সর্বোচ্চ সাত বছরের সশ্রম কারাদন্ড অথবা ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদন্ড অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত করার বিধান রয়েছে। পরবর্তীতে ২০০৮ সালে হাইকোর্ট বিভাগের এক আদেশে নোট বইয়ের পাশাপাশি গাইড বইও নিষিদ্ধ করা হয়। এরপর ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে আপিল বিভাগ হাইকোর্ট বিভাগের এই আদেশ বহাল রাখে। এখন নোট-গাইড নিষিদ্ধ করতে হলে আগের আইনের কী হবে সে বিষয়ে পর্যবেক্ষণ দেয়া হয় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে। এ ছাড়া প্রস্তাবিত আইনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে এমন আইন, বিধি, প্রবিধান, রীতি পর্যবেক্ষণ করতে বলা হয়েছে। প্রস্তাবিত আইন বা সংশোধনীর বিষয়ে উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত বা পর্যবেক্ষণ (যদি থাকে), আইন প্রণয়ন বা সংশোধনের উদ্দেশ্য ও এর সম্ভাব্য প্রভাব এবং সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক আইন, চুক্তি, কনভেনশন, সমঝোতা স্মারক, সিদ্ধান্ত, প্রটোকল খতিয়ে দেখার নির্দেশনা দেয় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের চিঠি নিয়ে কতটুকু অগ্রগতি হয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (নিরীক্ষা ও আইন) আহমদ শামীম আল রাজী বলেন, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে যেসব পর্যবেক্ষণ এসেছে তা একত্র করে একটি পূর্ণাঙ্গ আইন করার কাজ অনেক দূর এগিয়েছে। আশা করছেন, সেই আইন এবার আলোর মুখ দেখবে।

জানা গেছে, প্রাক-প্রাথমিক থেকে সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত শিক্ষাব্যবস্থাকে আইনি কাঠামোতে আনা এবং সবার জন্য বৈষম্যহীন, অসাম্প্রদায়িক ও মানসম্মত শিক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিত করতে জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০-এর আলোকে ২০১১ সালে `শিক্ষা আইন` প্রণয়নের উদ্যোগ নেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ২০১১ সালের জানুয়ারিতে আইন প্রণয়নের উদ্দেশ্যে প্রথম সভা হয়। ওই সভায় মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিবকে (আইন ও অডিট) আহ্বায়ক করে শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির কয়েকজন সদস্যকে শিক্ষা আইনের খসড়া তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয়। ওই কমিটি ২০১২ সালে শিক্ষা আইনের খসড়া তৈরি করে। পরে সংযোজন-বিয়োজন শেষে ২০১৩ সালের ৫ আগস্ট জনমত যাচাইয়ের জন্য আইনের খসড়া মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। খসড়া আইনে অনিয়মের জন্য শিক্ষকদের শাস্তি ও কোচিং বাণিজ্য বন্ধের বিষয়টি নিয়ে শিক্ষক সংগঠনসহ বিভিন্ন পর্যায় থেকে আপত্তি ওঠে। শিক্ষকরা এ আইনের বিরুদ্ধে মাঠেও নামেন। এছাড়া নোট-গাইড বইয়ের ব্যবসায়ীদের আন্দোলন, কওমি মাদরাসার মালিকদের হুমকিসহ নানা বিতর্ক দেখা দিলে এই আইন প্রণয়নের কাজ থমকে থাকে। পরে আবারও এই খসড়া মন্ত্রিসভায় উপস্থাপনের জন্য পাঠানো হলে এতে নানা রকম অসঙ্গতি থাকায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ফেরত পাঠানো হয়। সর্বশেষ ২০১৬ সালে ২৩ পৃষ্ঠার খসড়া আইন মন্ত্রণালয়ের ওযেবসাইটে দিয়ে নানা অসঙ্গতির কারণে তীব্র সমালোচনার মুখে তা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। এর আগেও ২০১৫ সালের ২০ অক্টোবর ওয়েবসাইটে দিয়ে নানামুখী সমালোচনার মুখে ২৭ অক্টোবর ওয়েবসাইট থেকে প্রত্যাহার করে নেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ বিষয়ে মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়, খসড়া আইনটি আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে পরিমার্জন করার প্রয়োজন আছে বিধায় শিক্ষা আইনের কপি ওয়েবসাইট থেকে প্রত্যাহার করা হলো।

সম্প্রতি শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেছেন, `চলতি বছরেই শিক্ষা আইনের খসড়া চূড়ান্ত করা হবে। তিনি বলেন, দেশে শিক্ষা-সংক্রান্ত অনেক আইন রয়েছে। এর কোনোটির সঙ্গে যেন শিক্ষা আইন সাংঘর্ষিক না হয়। কারণ, আইন করলাম, আর বিদ্যমান আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হলো; তাহলে কার্যকর করা কঠিন হবে। সেই কারণে একজন পরামর্শকের সহায়তা নিয়ে সমস্ত আইনগুলোর সঙ্গে যাতে সাংঘর্ষিক না হয়, সেটি আমরা দেখছি।`

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।