প্রাথমিকের সাড়ে ১০ কোটি বিনামূল্যের বই ছাপা নিয়ে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। সময়মত কাগজ ও আর্টপেপারের ছাড়পত্র না পাওয়ায় কার্যাদেশ পাওয়ার দেড় মাস পরও প্রাথমিকের একটি বইও ছাপাতে পারেনি মুদ্রণের কাজ পাওয়া ৪৩টি প্রতিষ্ঠান। এতে নতুন বছরের প্রথম দিনে শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেয়া নিয়ে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) কর্তৃপক্ষের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। এনসিটিবি ও মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীল একাধিক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

এনসিটিবির তথ্যানুযায়ী, ২০২০ শিক্ষাবর্ষের সাড়ে ১০ কোটি বই ছাপার কার্যাদেশ দেয়া হয় গত ২০ আগস্ট। চুক্তি অনুযায়ী আগামী ২০ নভেম্বরের মধ্যে শতভাগ বই ছাপিয়ে উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে পৌঁছে দিতে হবে। তবে কার্যাদেশের পরবর্তী ৪৯ দিনের মধ্যে মোট বইয়ের অর্ধেক সরবরাহ করতে হবে। কিন্তু ২৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১০ কোটি বইয়ের মধ্যে প্রাক-প্রাকমিকে অল্প কিছু ছাপা হলেও প্রাথমিকে একটি বইও ছাপা হয়নি। এজন্য কাগজ পরিদর্শনের থাকা প্রতিষ্ঠানকে দায়ী করে কর্মকর্তারা বলছেন, পরিদর্শনটি টিম মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানকে অহেতুক হয়রানি করছে। সব ঠিক থাকার পরও কোনো কাগজের ছাড়পত্র দিচ্ছে না।

জানা গেছে, বিনামূল্যেই ৩৫ কোটি পাঠ্যবই ছাপার কাগজ, আর্টপেপারসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় বিষয়াদি দেখভালের জন্য সরকার বেসরকারি দুটি প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দিয়েছে। প্রতিষ্ঠান দুটির দায়িত্ব কাগজ ও আর্ট কার্ডের মান যাচাই করে ছাড়পত্র দেয়া। কিন্তু সর্ষের মধ্যে ভূতের খোঁজ পেয়েছে এনসিটিবি। মাধ্যমিকে বস্নু বাইন্ডার্স এবং প্রাথমিক স্তরের জন্য কন্টিনেন্টাল ইন্সপেকশন বিডি’র বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উঠেছে। এর মধ্যে কন্টিনেন্টালের বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট পেপার মিল থেকে কাগজ কিনতে বাধ্য করা, ছাড়পত্রের নামে মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান থেকে উৎকোচ নেয়াসহ নানা হয়রানির অভিযোগ উঠেছে। উৎকোচ না দিলে নানা কারণে ছাড়পত্র আটকে দেয়া হচ্ছে। এতে প্রাথমিক পর্যায়ের সাড়ে ১০ কোটির বেশি বই ছাপার কাজ আটকে গেছে।

বিষয়টি স্বীকার করে এনসিটিবির চেয়ারম্যান প্রফেসর নারায়ণ চন্দ্র সাহা সাংবাদিকদের বলেন, প্রাথমিকের পরিদর্শন প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে একটু জটিলতা তৈরি হয়েছে। সেটা কাটাতে চারপক্ষীয় (এনসিটিবি, ডিপিই, মুদ্রণ সমিতি এবং পরিদর্শন টিম) সভা ডাকা হচ্ছে। সেখানে একটা সমাধান আসবে বলে মনে করেন তিনি। পরিদর্শন টিম কারও কাছে কোনো অনৈতিক সুবিধা চাইলে তা তদন্ত হবে। প্রমাণ হলে তাকে কালো তালিকাভুক্ত করা হবে।

এনসিটিবির সূত্র জানায়, গত ১৭ সেপ্টেম্বর এনসিটিবিতে এক সেমিনারে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব আকরাম আল-হোসেনের কাছে ইন্সপেকশন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ করেন মুদ্রণকারীরা।

অভিযোগে তারা বলেন, প্রাথমিকের পরিদর্শন টিম তাদের হয়রানি করছে। কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সরাসরি চাঁদা চেয়েছে বলেও সচিবের কাছে নালিশ করেন তারা। এছাড়াও প্রেসের কর্মচারীদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত খারাপ আচরণ করার অভিযোগ করা হয় সচিবের কাছে। সব শুনে দ্রুত বিষয়টি সুরাহা করার তাগিদ দেন প্রাথমিক সচিব। এরপর নড়েচড়ে বসেছে এনসিটিবি। মুদ্রণ ব্যবসায়ী, পরিদর্শন প্রতিষ্ঠান, প্রাথমিক অধিদপ্তর এবং এনসিটিবি এ চারপক্ষীয় বৈঠকের জন্য দপ্তর প্রধানদের চিঠি দিয়েছে সংস্থাটি।

পাঠ্যপুস্তক ও বিতরণ শাখার একজন কর্মকর্তা বলেন, কাগজ ছাড়পত্র দেয়া হয়নি এমন ১০৫টি স্যাম্পল সংগ্রহ করে এনসিটিবি বিকল্প পন্থায় সায়েন্স ল্যাবরেটরি, বিএসটিআই, বুয়েট থেকে পরীক্ষা করায়। যেখানে কাগজের কোনো সমস্যা পায়নি। এরপর কাগজের ছাড়পত্র দেয়ার জন্য কন্টিনেন্টালকে বলা হলে প্রতিষ্ঠানটির অভিযোগ, সায়েন্স ল্যাবরেটরি, বিএসটিআই ও বুয়েটের মেশিনগুলো চীন থেকে আনা। এসব মেশিনে কাগজের সঠিক মান যাচাই করা সম্ভব না। এটাকে হাস্যকর যুক্তি বলে কর্মকর্তারা বলেছেন, প্রাথমিকের বই ছাপার প্রকল্পটা ফেল করানোর জন্য কন্টিনেন্টাল এসব কাজ করছে। তাদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ তদন্ত হচ্ছে। প্রমাণ পেলে তাদের চুক্তিপত্র বাতিল করা হবে। প্রয়োজনে সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে কাগজ পরিদর্শন করানো হবে।

এদিকে গত ১৫ সেপ্টেম্বর জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) চেয়ারম্যানের কাছে লিখিত একটি অভিযোগ করেন মুদ্রণ শিল্প সমিতি। অভিযোগে পরিদর্শন টিমের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলেছেন। তাদের অভিযোগ, একই জিএসমের কাগজ মাধ্যমিক পর্যায়ে ছাড়পত্র পেলেও প্রাথমিক স্তরে আটকে দেয়া হচ্ছে। গোডাউনে কাগজের মান যাচাইয়ের জন্য চিঠি দিলে বিনা কারণে এক সপ্তাহ, কখনও ১০ দিনের বেশি ঘুরানোর পর পরিদর্শনে আসে। শুধু তাই নয়, সরকারি ছুটির দিন অথবা গভীর রাতে প্রেসে হাজির হয়ে কাগজ পরিদর্শনের নামে কর্মচারীদের হয়রানি করছে। মুদ্রণ ব্যবসায়ীরা সরকারি যে কোনো প্রতিষ্ঠান দিয়ে কাগজ পরীক্ষা করার পাশাপাশি এ প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে দ্রম্নত আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানান। এ ব্যাপারে এনসিটিবির চেয়ারম্যান বলেন, মুদ্রণকারীসহ আরও অন্যান্য জায়গা থেকে একাধিক অভিযোগ আমার কাছে এসেছে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাৎক্ষণিক এ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানান তিনি।

কর্মকর্তারা অভিযোগ করে বলেন, ‘ন’ আদ্যক্ষরের একটি পেপার মিল থেকে কাগজ কিনলে কোনো বাধা ছাড়াই ছাড়পত্র মিলছে। এর বাইরে যে কোনো মিলের কাগজ হলেই আটকে দেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। মুদ্রণ ব্যবসায়ীদের এমন অভিযোগের বেশ কয়েকটি প্রমাণও সংগ্রহ করেছে বোর্ড।

এ ব্যাপারে এনসিটিবির সদস্য (পাঠ্যপুস্তক) প্রফেসর ফরহাদুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, গত বছর এ ধরনের অভিযোগ ছিল এবং প্রমাণও মিলেছে। এবারও এমন অভিযোগ আসছে। তিনি চলতি বছর এ পদে আসার পর সবাইকে ডেকে সাবধান করে দিয়েছেন। এরপর যদি কেউ এসব কাজ করে তার বিরুদ্ধে সরাসরি ব্যবস্থা নেয়া হবে।

এ ব্যাপারে মুদ্রণ শিল্প সমিতির সাধারণ সম্পাদক জহুরুল ইসলাম বলেন, এ প্রতিষ্ঠানটি শুরু থেকেই নানাভাবে হয়রানি করছে। কাগজের ব্রাইটনেস ঠিক নেই এমন অভিযোগে বাতিল করার এক সপ্তাহ পর সেই কাগজের মান ভালো বলে ছাড়পত্র দিয়েছে এমন প্রমাণও রয়েছে। তিনি আরও বলেন, ৮৮ থেকে ৯০ পার্সেন্টের কম ব্রাইটনেস হলে আর্ট পেপার তৈরিই করা যায় না। আর কন্টিনেন্টাল ৮০ পার্সেন্টের কম ব্রাইটনেসের অভিযোগ তুলে আট কার্ডের ছাড়পত্র দিচ্ছে না। এটা হয়রানি ছাড়া আর কিছুই না।

কাজ দিতেও স্বজনপ্রীতি :

২০২০ শিক্ষাবর্ষের বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক ছাপার কাগজ ও আর্ট কার্ডের মান যাচাইয়ে সর্বনিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়নি এনসিটিবি। দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সদস্য ও প্রতিষ্ঠানটির সচিব বিরোধিতা করার পরও বিতর্কিত এ প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিতে তিন দফা পুনঃটেন্ডার করা হয়। শেষ পর্যন্ত কন্টিনেন্টালকে কাজ দেয় নানা অভিযোগে অপসারিত হওয়া এনসিটিবির সদস্য (পাঠ্যপুস্তক) মিয়া ইনামুল হক রতন সিদ্দিকী।

এনসিটিবি সূত্র জানায়, ২০২০ শিক্ষাবর্ষের মাধ্যমিক (বাংলা, ইংরেজি ভার্সন) ও এসএসসি ভোকেশনাল স্তরের বিনামূল্যের পাঠ্যপুস্তক ছাপা, বাঁধাই ও সরবরাহের লক্ষ্যে সাড়ে ১৮ হাজার মেট্রিক টন কাগজ ও ২৪শ’ মেট্রিক টন আর্ট কার্ডের প্রি-শিপমেন্ট, প্রি-ডেলিভারি ও পোস্ট ল্যান্ডি ইনেসপেকশন সংক্রান্ত দরপত্র আহ্বান করা হয়। গত ২৭ ফেব্রম্নয়ারি দরপত্র বিজ্ঞপ্তি বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশ করা হয়। দরপত্র মূল্যায়ন করতে এনসিটিবির তৎকালীন সদস্য (পাঠ্যপুস্তক) রতন সিদ্দিকীকে আহ্বায়ক করে সাত সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়। পাঁচটি প্রতিষ্ঠান দরপত্র ক্রয় করলেও চারটি প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়।

সূত্র জানায়, ইন্ডিপেনডেন্ট ইনেসপেকশন সার্ভিস বিডি ১০ লাখ ২৪ হাজার ১০০ টাকা, কন্টিনেন্টাল ইনেসপেকশন বিডি ১৪ লাখ ৩০০ টাকা, বালটিক কন্টরোল (বিডি) লি. ১৪ লাখ ৪২ হাজার ১০০ টাকা ও বু্যরো ভার্টিটাস বাংলাদেশ (প্রাইভেট) লি. ২৫ লাখ ২৮ হাজার ৯০০ টাকা দর দিয়ে দরপত্র জমা দেয়। সর্বনিম্ন দরদাতা হওয়ার পরও ইন্ডিপেনডেন্টকে কাজ দেয়নি এনসিটিবি। প্রাক্কলনের চেয়ে কেন কম দর দেয়া হয়েছে সেটার জন্য চিঠি দেয়া হয় এবং তার কাজের বিভাজন চাওয়া হয়। প্রতিষ্ঠানটি সব জবাব দেয়ায় তা সন্তোষজনক হলেও দ্বিতীয় টেন্ডার করা হয়। এরপর মূল্যায়ন কমিটির অন্যান্য সদস্যদের সর্বনিম্ন দুটি দরদাতা প্রতিষ্ঠানকে কাজ না দিয়ে তৃতীয় প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়ার জন্য রতন সিদ্দিকী চাপ দেন। এভাবে দ্বিতীয় টেন্ডারে কন্টিনেন্টাল ১৪ লাখ থেকে ৫ লাখে নেমে আসে। প্রথম টেন্ডারে যেহেতু ১০ লাখের কাজ দিতে পারেনি তাই প্রাক্কলনের চেয়ে কম মূল্য দেয়ার অভিযোগে দ্বিতীয় টেন্ডারও বাতিল করা হয়। এরপর তৃতীয় টেন্ডারে নানা কৌশলে কন্টিনেন্টালকে পৌনে দশ লাখ টাকায় সর্বনিম্ন দরদাতা করে কাজ দেয়া হয়। যার খেসারত দিচ্ছে এনসিটিবি ও মুদ্রাকররা।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।