শীতকালে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা প্রজাতির অতিথি পাখি আসে। এসব পাখি শীতের শুরুতে আসে এবং শীতের শেষে চলে যায়। তবে ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে ছোট সরালির ক্ষেত্রে।

এক সময় অন্যান্য পাখির মত এরা অতিথি হয়ে আসলেও এদের একটা অংশ করোনাভাইরাস মহামারিতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বছরব্যাপী থাকছে। তবে মহামারি শেষে স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরলে এই পরিস্থিতি থাকবে কিনা তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন কেউ কেউ।

পাখি বিশেষজ্ঞরা জানান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব অতিথি পাখি আসে তার অন্যতম ছোট সরালি। সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় আসে এরাই। অন্যান্য পাখির তুলনায় বেশি সংখ্যক আসে বলে এদের চোখেও পড়ে বেশি।

তবে অতিথি হলেও এরা পরিযায়ী নয়। অর্থাৎ এরা বহির্বিশ্বের কোনো দেশ থেকে আসে না। আসে দেশেরই অন্য কোন স্থান থেকে। তবে অনেকে ভুলবশত ছোট সরালিকে পরিযায়ী পাখি ভাবেন। এর একটা অন্যতম কারণ এরা পরিযায়ী পাখির মত শীতের শুরুতে আসে এবং শীতের শেষে চলে যায়।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মো. কামরুল হাসান বলেন, “ছোট সরালি পরিযায়ী নয়। এরা আমাদের দেশের আবাসিক পাখি। তবে শীতে আসে বলে অনেকে ভুল করে এদের পরিযায়ী ভাবেন।”

জানা যায়, ছোট সরালি সাধারণত শীতের আগেভাগেই অর্থাৎ সেপ্টেম্বর মাসেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আসে। আর শীতের শেষে অর্থাৎ মার্চ কিংবা এপ্রিলে চলে যায়। তবে গত দু’বছর ধরে এর ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে। শীতকালে বড় সংখ্যায় অতিথি হয়ে আসলেও এদের সবাই ফিরে যাচ্ছে না। বরং একটা অংশ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে যাচ্ছে।

২০১৯ সালের শীতে মৌসুম থেকেই শুরু। সেবার বিগত বছরগুলোর তুলনায় অনেক বেশি সংখ্যক ছোট সরালির আগমন ঘটে। তবে শীতের শেষ দিকে দেশে করোনাভাইরাস মহামারি শুরু হলে দেশের অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ন্যায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এতে লোক সমাগম কমে যাওয়ায় ছোট সরালিদের একটা অংশ এখানে থেকে যায়। থেকে যাওয়া সেসব সরালি ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থানে বাসা তৈরি বাচ্চার জন্ম দেয়।

অধ্যাপক মো. কামরুল হাসান জানান, গতবার তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্থানে অন্তত ১০ টি ছোট সরালির বাসা দেখেছেন। যদিও এর আগেও ক্যাম্পাসে ছোট সরালির বাচ্চা দিয়েছে। তবে গত দুই বছর ধরে এই সংখ্যাটা অনেক বেড়েছে।

উইকিপিডিয়ায় দেয়া তথ্য অনুযায়ী, পাতি বা ছোট সরালি (বৈজ্ঞানিক নাম Dendrocygna Javanica) সরালি, গেছো হাঁস প্রভৃতি নামে পরিচিত। বাংলাদেশ ছাড়াও দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে এদের দেখা যায়। সারা পৃথিবীর এক বিশাল এলাকা (প্রায় ৫৬ লাখ ৭০ হাজার বর্গকিলোমিটার) জুড়ে এদের আবাস। তবে বিগত কয়েক বছর ধরে এদের সংখ্যা কমছে। কিন্তু তা আশংকাজনক অবস্থায় পৌঁছায়নি। এ কারণে আই.ইউ.সি.এন এই প্রজাতিটিকে ন্যূনতম বিপদগ্রস্ত ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশেও এরা সংরক্ষিত পাখি।

এদিকে গত বছরের ন্যায় এবারও শীতের শেষ হলেও ছোট সরালিদের ক্যাম্পাসের লেকে দেখা যাচ্ছে। তবে গতবারের চেয়ে এই সংখ্যাটা অনেক বেশি বলে জানা গেছে।

অধ্যাপক কামরুল হাসান জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়াইল্ড লাইফ রেসকিউ সেন্টারের ভেতরের লেকে পাঁচশ থেকে ছয়শত ছোট সরালি রয়েছে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতন কলা ভবন সংলগ্ন লেকেও বেশ কিছু ছোট সরালি দেখা যাচ্ছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতন কলা ভবন পাশেই রয়েছে একটা বেশ বড়সড় আকারের লেক। তীব্র দাবদাহে যখন সবার হাঁসফাঁস অবস্থা তখন দুপুর বেলা এই লেকের একেবারে মাঝখানে দেখা গেল ১৬টি সরালি। এদের ১৩টি পরিত্যক্ত কিছু একটার ওপরে বসে বিশ্রাম নিচ্ছে। আর বাকি ৩টি একটু দূরে ব্যস্ত জলকেলিতে।

অধ্যাপক কামরুল হাসান বলেন, এখনো অনেক ছোট সরালি ক্যাম্পাসের লেকগুলোতে আছে। তবে এত বেশি সংখ্যক হয়তো কিছুদিন পরেই থাকবে না। বড় কোন ঝড় হলে এদের একটা অংশ চলে যাবে আর কিছু থেকে যাবে।

তিনি বলেন, “গতবার ছোট সরালি ক্যাম্পাসে বাসা তৈরি করে বাচ্চা দিয়েছিল। এবারও এরা ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থানে বাসা তৈরি করা শুরু করেছে।”

এই বন্যপ্রাণি গবেষক জানান, ছোট সরালিরা সাধারণত লতাপাতা দিয়ে ঘেরা বা ঝোঁপ জাতীয় গাছের আড়ালে বাসা তৈরি করে। যাতে বাসা বাইরে থেকে না দেখা যায়। তবে সেটা খুব উঁচুতে নয়, ৩০ থেকে ৪০ ফুট উঁচুতে। এর কারণ জন্মের পর বাচ্চা লাফ দিয়ে নিচে নামে। এরপর মা সরালি পথ দেখিয়ে পানিতে নিয়ে যায়। ফলে বেশি উঁচুতে বাসা থাকলে বাচ্চারা নামতে গিয়ে পড়ে মারা যায়। আর যেহেতু জন্মের পর পরই পানিতে নামতে হয়, লেকের পাশে বাসা তৈরির মত উপযুক্ত গাছ থাকতে হয়। কারণ পানি নিরাপদ এবং এখানেই এদের খাবার। তা না হলে বাসা থেকে নেমে পানিতে পৌঁছানোর আগেই শিকারী প্রাণির আক্রমণের শিকার হয়।

অধ্যাপক মো. কামরুল হাসান বলেন, “আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক সময় দেখা যায় লেকের পাশে উপযুক্ত স্থান না পেয়ে ছোট সরালিরা একটু জঙ্গলের ভেতরে বাসা তৈরি করে। ফলে সেখান থেকে মাটিতে নেমে লেকে আসতে আসতেই শিয়াল, বেজি, গুঁইসাপ ইত্যাদি প্রাণির আক্রমণে মারা যায়। তবে ডিস্টার্বেন্স কম থাকলে যেসব লেকে এরা বেশি বিচরণ করে, ক্রমেই সেসব লেকের পাশে বাসা তৈরি করা শুরু করবে।”

তবে করোনাভাইরাস মহামারিতে আবাসিক পাখির মত আচরণ করলেও ছোট সরালিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থানীয় পাখি বলার সময় আসেনি বলে মত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলামের। তিনি বলেন, “এখন পরিবেশ-পরিস্থিতি অন্য রকম। করোনাভাইরাস মহামারির কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা নেই। পরিবেশ অনেকটাই শান্ত। ওদের জন্য অনুকূল এটা। একারণে ভিন্ন পরিবেশ পেয়ে হয়তো এরা এখানে থাকা শুরু করেছে। করোনা থাকা অবস্থায় আমরা তাদের স্বাগত জানাই। তবে এটাই যে ওদের ন্যাচারাল হ্যাবিটেট হবে তা বলা যায় না। দেখতে হবে সবকিছু স্বাভাবিক হলে ওরা এখানে অতিথি থেকে আমাদের সদস্য হয়ে থাকে কিনা।”

ক্যাম্পাসে আসা এসব পাখিদের উপযুক্ত পরিবেশ বজায় রাখতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সব সময় সচেতন। আর ভবিষ্যতেও এই ধারা অব্যাহত থাকবে। তবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে এখনকার মত পাখিদের জন্য এতটা অনুকূল পরিবেশ হয়তো থাকবে না, জানালেন উপাচার্য।

উপাচার্য বলেন, “আমরা পাখিদের বিরক্ত করতে নিষেধ করি। তবে সবকিছু স্বাভাবিক হলে এমনিতেই তাদের ডিস্টার্ব হবে। লোকজনের যাওয়া-আসাতেই তারা ডিস্টার্বড হয়। এটা তো আর বন্ধ করা যায় না। তবে আমরা যেটা করতে পারি- আমরা যখন উৎসব করি, তখন কিন্তু সাবধনতা অবলম্বন করে পুরাতন প্রশাসনিক ভবন থেকে চৌরঙ্গী পর্যন্ত সাউন্ড অফ করে রাখি। এই ধরণের সচেতনতা আমরা ভবিষ্যতেও আনব। তবে নিশ্চয় আমাদের শিক্ষার্থীদের আনন্দ, অবসর, বিনোদন বিনষ্ট না করে। কারণ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের জন্যেই।”

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।