আজও অমলিন সেই ঢোলসমুদ্র নামে দিঘি অদ্ভুত নামের এই দিঘিটি দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলা ঝিনাইদহে অবস্থিত। এত বড় দিঘি অত্র এলাকায় কোথাও নাই। দিঘিটির অবস্থান ঝিনাইদহ জেলা শহর থেকে প্রায় ৪ কিলোমিটার দূরে পাগলাকানাই ইউনিয়নের বাড়ি বাথান গ্রামে। দিঘির চার পাশে অতি মনোরম পরিবেশ। প্র

তিদিন সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত মজজমাট থাকে। ঢোলসমুদ্র দিঘি-কোন ঐতিহাসিক কীর্তি না হলেও আজো জনশ্রুতির কারণে ইতিহাস হয়ে আছে। ৫২বিঘা জমির উপর দিঘিটি খনন করা হয়েছিল। খননের কারণ সম্পর্কে জনশ্রুতিতে ছড়িয়ে আছে চমকে যাওয়ার মতো উপাখ্যান। মুলত ইট জল কষ্টের জন্য খনন করা হয়েছিল।

তথ্যানুযায়ী-রাজা মুকুট রায়ের আমলে এখানে একবার ভীষণ জলকষ্ট দেখা দেয়। উৎকণ্ঠা আর উদ্বেগ প্রজা মহলের চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। পানির অভাবে প্রজারা প্রান দিতে লাগল। বিল, বাওড়, নদী, দীঘি কোথাও পানি নেই। রাজা অত্যন্ত দুঃশ্চিন্তায় পড়লেন। পানির জন্য পূজা দিলেন। অনেক ধর্মীয়-আচার অনুষ্ঠান করলেন। কিছুতেই কিছু হলো না। অবশেষে রাজা স্থির করলেন একটা পুকুর খননের। প্রজারা অবশ্যই পানি পাবে সেখান থেকে। এমন চিন্তা করে এখানে বড় করে দিঘি খনন করা হয়। দেখতে দেখতে জলাশয় খনন শুরু হলো। অগণিত লোক কোদাল চালালো রাতারাতি খনন কাজ শেষ করতে। পুকুর গভীর হতে গভীরতর হলো, পানির দেখা নেই। কত জ্যোতিষী, কত দরবেশ এলো। কত উপদেশ পালিত হলো। কিছুতেই কিছু হলো না। রাজার ঘুম নেই। তিনি হতাশ হয়ে ভেঙ্গে পড়লেন। একদিন রাতে রাজা স্বপ্ন দেখলেন, যদি রাণী পুকুরে নেমে পূজা দেন, তবে পুকুরে পানি উঠবে। রাজা অনন্যোপায় হয়ে স্বপ্নের কথা রাণীকে বললেন। রাণী প্রজাহিতৈষী প্রস্তাব সানন্দে গ্রহন করলেন। ধূমধাম পড়ে গেল, দিনক্ষণ ঠিক হলো। ঢোল, সানাই, বাঁশি এলো। লোকে লোকারণ্য পুকুর পাড়। রাণী পূজার নৈবেদ্য নিয়ে পুকুরের পাড়ে আসলেন। ঢোল, সানাই, বাঁশী বেজে উঠলো। শঙ্খবাণী, উলুধ্বনি দিল মায়েরা। রাণী ধীরে ধীরে পুকুরে নামতে লাগলেন। শেষ পর্যন্ত তলদেশে উপস্থিতি। সহসা দেখা গেল তলা থেকে পানি উঠছে প্রবল বেগে। রাণী প্রজাদের মঙ্গল কামনা করে ঈশ্বরকে প্রনতি জানিয়ে পুকুর হতে উঠে আসতে লাগলেন। পানি দ্রুত রাণীকে গ্রাস করলো। ঢোল, কাশী, সানাই, বাঁশীর শব্দের এবং প্রজাদের আনন্দে পুকুরের দিকে কারো লক্ষ্য নেই। রাণীর সলিল সমাধি হলো। প্রাকৃতিক শোভামন্ডিত ঢোল সমুদ্র দিঘির পাড়ের চারপাশে নির্জন পরিবেশ আজো অসংখ্য পর্যটকদের আকর্ষণ। এই দিঘির টানে সারাবছর অগণিত পর্যটক আসেন। চারপাশের সবুজ প্রান্তরে মুক্ত নিঃশ্বাস নেন।

স্থানীয় বাসিন্দা রইস উদ্দিন জানালেন, ঢোল সমুদ্র দিঘি দেখতে বছরের প্রায় সব সময়ই মানুষকে বেড়াতে আসতে দেখা যায়। তবে শীতকালে মানুষের ভিড় বাড়ে। এ সময় অনেকে পিকনিকের আয়োজন নিয়েও এখানে আসেন। এখানে দুরদুরান্ত থেকে মানুষ বেড়াতে বা বনভোজন করতে আসে, বেশির ভাগ দেখা যায় বিকাল হলে পরিবার পরিজনরা বেড়াতে আসে। নৌকা নিয়ে দিঘির চতুর পাশে ঘুরে আনন্দ করে থাকে। ঝিনাইদহে রাজা মুকুট রায় নামে এক প্রতাপশালী জমিদার ছিলেন। রাজা মুকুট রায়ের অনেক সৈন্য সামন্ত ছিল। কথিত আছে তিনি ১৬ হল্কা হাতি, ২০ হল্কা অশ্ব ও ২,২০০ কোড়দার না নিয়ে বের হতেন না। খাঁন জাহান আলী (রাঃ) এর মত তিনিও জলাশয় প্রতিষ্ঠায় যত্নবান ছিলেন। রাস্তা নির্মাণ ও জলাশয় খনন করতে করতে তিনি অগ্রসর হতেন। ঝিনাইদহে তাঁর এমনি একটি অমর কীর্তি ঐতিহ্যবাহী পাগলা কানাই ইউনিয়নের ঢোল সমুদ্র দীঘি। দীঘিটি শতাব্দী পরিক্রমায় পানীয় জলের অফুরন্ত আঁধার হিসেবে কাজ করেছে এবং একজন পরাক্রমশালী রাজার রাজকীয় স্থাপনা সমূহের একটি স্মৃতি হিসেবে আজও টিকে আছে।

ঝিনাইদহ শহরের পূর্বে বিজয়পুর ছিল রাজা মুকুট রায়ের রাজধানী। বাড়ীবাথানে রাজার প্রকান্ড গোশালা ছিল। বহু সংখ্যক গাভী ছিল বলে লোকে তাকে বৃন্দাবনের বলত। বেড়বাড়ীতে রাজার উদ্যান ছিল। রাজার কোড়াদার সৈন্যরা যেখানে নন্দ মহারাজ বসবাস করত সে স্থানের নাম কোড়াপাড়া হয়েছে। এ সমস্ত স্থান এখনও বর্তমান। রাজা মুকুট রায়ের রাজবাটির কিছুই অবশিষ্ট নেই। তবে ঢোল সমুদ্র দীঘির দক্ষিণে ক্ষয়ে যাওয়া ইটের স্তুপে কোন ঐতিহাসিক নিদর্শন লুক্কায়িত থাকতে পারে বলে পুরাতাত্ত্বিকেরা মনে করেন। ঢোল সমুদ্র দীঘিটি ঝিনাইদহের একটি আকর্ষণীয় বিনোদন স্থান। ঢোল সমুদ্র দীঘি খননের পেছনে একটি লোক শ্রুতি আছে-রাজা মুকুট রায়ের রাজত্বকালে একবার জলকষ্ট দেখা দেয়। বিল, বাওড়, নদী দীঘি-কোথাও জল ছিল না। অনন্যোপায় হয়ে রাজা দীঘি খননের সিদ্ধান্ত নেন। অগণিত লোকের দিন রাত পরিশ্রমে দীঘি গভীর হতে গভীরতর এবং চতুর্দিকে প্রশস্ত হতে লাগল। কিস্তু পুকুরে জল উঠল না। হতাশ রাজা একদিন স্বপ্ন দেখলেন যে, রাণী যদি পুকুরে নেমে পূজা দেন, তবে পুকুরে জল উঠবে। রাণী পুকুরের তলদেশে উপস্থিত হয়ে ইষ্টদেবতাকে নিবেদন করলেন পূজার অর্ঘ্য। জল ওঠা শুরু হলো। প্রার্থনা পূর্ণ হওয়ায় রাণী উপরে উঠতে শুরু করলেন। সহসা প্রবল বেগে জলরাশি উত্থিত হল। জল দেখে উদ্বেলিত পাড়ের সহজ প্রজার উৎসব-আনন্দ আর বাদ্য-বাজনার মধ্যে অলক্ষ্যে রাণী অথৈ জলরাশির গভীরে তলিয়ে গেলেন। গভীর শোকে শোকাভিভূত প্রজাগন রাজাকে রাজপুরীতে যেয়ে এই দুঃসংবাদ জানালেন। সেই স্মৃতি স্মরণে আজও লোকজন এ দীঘিকে ঢোল সমুদ্র দীঘি বলে জানে।রাজা মুকুট রায় বাড়ী বাথানের যুদ্ধে নবাবের ও পাঠান সৈন্যের মিলিত শক্তির কাছে পরাজিত হন। নবাব সৈন্যরা রাজা মুকুট রায়কে বন্দী করে রাজধানীতে নিয়ে যায়।

রাজার পরিচয় জেনে নবাব তাঁকে মুক্তি দেন। কিন্তু রাজার পরিবারের সদস্যগণ রাজার অনিবার্য পরিণতি, মৃত্যু ভেবে সবাই আত্মহত্যা করেন। তাঁর কন্যার আত্মহত্যার স্থানকে কন্যাদহদু’রাণীর আত্মহত্যার স্থানকে দুসতীনের, রাজ জ্যোতিষীর আত্মহত্যার স্থানকে দৈবজ্ঞদহনামে অভিহিত করা হয়েছে, যা আজও এ নামেই পরিচিত।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।