বাংলাদেশ উপকূলে প্রকৃতির রুদ্র রেশে গত দুই শতকে অন্তত ২৫ লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও অন্তত ১০ লাখ কোটি টাকা। এরপরেও প্রকৃতির সাথেই লড়াই করেই বেঁচে আছে দেশের উপক‚লসহ দক্ষিণাঞ্চলের কয়েক কোটি মানুষ। আগাম সতর্কতার কারণে প্রাণহানির সংখ্যা আশাব্যঞ্জকভাবে কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। যা গোটা বিশ্বের কাছে একটি মডেল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে ইতোমধ্যে।

দেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগের ইতিহাস পর্যালোচনা করে যে ভয়ঙ্কর তথ্য পাওয়া গেছে, তা অনেকটাই লোমহর্ষক। ১৯৬৯ সালে তৎকালীন অবিভক্ত সুন্দরবনের সাগর দ্বীপের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া এক প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড়ে দুই বাংলার অর্ধ লক্ষাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটে। ১৭৬০ সালে গোটা সুন্দরবন এলাকার ওপর দিয়ে আরেক ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণহানির সংখ্যা ছিল প্রায় ৫০ হাজার। পাঁচ বছর পরে ১৭৬৫ সালে চট্টগ্রাম উপক‚লে আঘাত হানা অনুরূপ এক ঘূর্ণিঝড়ে ওই এলাকার জনবসতি পর্যন্ত নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। প্রাণহানির সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও তা ছিল ৪০ হাজারের ওপরে। ১৮২২ সালে বর্তমান বরিশাল বিভাগের জেলাগুলোতে বঙ্গোপসাগর থেকে ধেয়ে আসা আরেক প্রলয়ঙ্কারী ঝড়ে প্রায় অর্ধ লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটে। ১৮৬৭ সালে বঙ্গোপসাগর থেকে ধেয়ে আসা আরেক ঘূর্ণিঝড় সুন্দরবন থেকে উত্তরে পাবনা পর্যন্ত জনবসতি লন্ডভন্ড করে দেয়। মৃতের সংখ্যা ছিল প্রায় ২৫ হাজার। ১৮৭২ সালে কক্সবাজার উপক‚লে, ১৮৭৬ সালে ভোলা-মনপুরা, হাতিয়া ও স›দ্বীপ উপক‚লে এবং ১৮৯৫ সালে সুন্দরবন সংলগ্ন বাগেরহাট উপক‚লে ৩টি ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে জানমালের ব্যাপক ক্ষতি হলেও তার সঠিক পরিসংখ্যান জানা যায়নি। কুতুবদিয়া উপক‚লে ১৮৯৭ সালে প্রবল ঘূর্ণিঝড় হ্যারিকেনের রূপ নিয়ে আঘাত হানলে প্রায় ১৫ হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটে।

১৯১৯ সালে বৃহত্তর বরিশাল উপক‚ল থেকে ফরিদপুর পর্যন্ত ছোবল হানা ঘূর্ণিঝড়ে জানমালের ব্যাপক ক্ষতি হয়। ১৯৬০ সালের ৯ ও ১০ অক্টোবর সাগর থেকে উঠে আসা আরেক ঘূর্ণিঝড় বিশাল জলোচ্ছ্বাস নিয়ে নোয়াখালী-হাতিয়া উপক‚লে আঘাত হানে। এক বছর পরে ১৯৬১ সালে ভোলা ও ল²ীপুরের মধ্যবর্তী মেঘনার মোহনা ধরে আছড়ে পড়া দেড়শ’ কিলোমিটার বেগের ঘূর্ণিঝড়ের সাথে প্রায় ১০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে ১০ সহস্রাধিক মানুষের প্রাণপ্রদীপ নিভে যায়।

১৯৬৩ সালের মে মাসে আরেক ঘূর্ণিঝড়ে লন্ডভন্ড হয়ে যায় স›দ্বীপ থেকে কুতুবদিয়া-মাতারবাড়ী-মহেশখালী হয়ে কক্সবাজার উপক‚ল। ১৯৬৫’র মে ও ডিসেম্বর মাসে দু’দফায় আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড়ে ২৫ হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটে। গৃহহীন হয় আরো ৫০ হাজার মানুষ। ’৬৬ সালে প্রায় দেড়শ’ কিলোমিটার বেগে উপক‚লের ৪টি জেলায় আরেক ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে জানমালের ব্যাপক ক্ষতি হয়।

গত দুই শতাব্দীর ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় হয়েছিল ১৯৭০ এর ১২ নভেম্বর রাতে। ইতিহাসের ভয়াবহ এ ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণহানির সংখ্যা ছিল সর্বকালের সর্বাধিক প্রায় ৫ লাখ। ১৯৮৫ সালের ৫ মে রাতে ভোলার পূর্ব তীর থেকে ল²ীপুর-হাতিয়া ও স›দ্বীপ উপক‚লে ১৪০ কিলোমিটার বেগের এক ঝড় আছড়ে পরে। ৫ সহস্রাধিক মানুষের মৃত্যু ঘটে। ’৮৮ সালে সুন্দরবন সংলগ্ন বাগেরহাট-খুলনা ও সাতক্ষীরা জেলার উপক‚লভাগে প্রায় ২শ’ কিলোমিটার বেগের ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। সাম্প্রতিক কালের ভয়াল ওই ঘূর্ণিঝড়কেও প্রতিহত করে সুন্দরবন।

১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল রাতে আরেক ভয়াল ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে চট্টগ্রাম থেকে ভোলা উপক‚ল হয়ে পটুয়াখালী পর্যন্ত। ইতিহাসের ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে নিহত হয় প্রায় দেড় লাখ মানুষ। তবে ঝড়ের আগাম প্রস্তুতির কারণে প্রাণহানির সংখ্যা ’৭০ এর ঝড়ের চেয়ে কম ছিল।

২০০৮ এর ১৫ নভেম্বর রাতে ২৫৪ কিলোমিটার বেগের ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর’ বরগুনা ও বাগেরহাটের মধ্যবর্তী বলেশ্বর নদী হয়ে উপক‚লের ৭টি জেলায় আঘাত হানে। ঝড়ের আগাম সতর্কতা ও প্রস্তুতি থাকায় প্রাণহানির সংখ্যা ছিল সাড়ে তিন হাজারেরও কম। নিখোঁজের সংখ্যাও ছিল প্রায় ২ হাজার। কিন্তু ফসল ও গবাদি পশুসহ সম্পদের ক্ষতির পরিমাণ সরকারি হিসেবেই ছিল ১৬ হাজার কোটি টাকা।

২০০৯ এর মে মাসে ঘূর্ণিঝড় ‘আইলা’র আঘাতে সুন্দরবন উপক‚লের ব্যাপক ক্ষতি হয়। ২০১৩ এর ১৬ মে প্রত্যুষে ঘূূর্ণিঝড় ‘মহাসেন’ বঙ্গোপসাগর থেকে উঠে এসে বরগুনা-কুয়াকাটা/কলাপাড়া হয়ে ভোলা-মনপুরা-হাতিয়া উপক‚ল দিয়ে মেঘনা মোহনায় পৌঁছার আগেই দুর্বল হয়ে পড়ে। ২০১৫ সালের ২৬ জুলাই ঘূর্ণিঝড় ‘কোমেন’ এর আঘাতে উপক‚লে ৮৫ জনের মৃত্যু হয়। ২০১৬ সালে ‘রোয়ানু’ ১, ২০১৭ সালে ‘মোরা’ এবং গত মে আরেক ঘূর্ণিঝড় ‘ফণি’র আঘাতেও শতাধিক মানুষের প্রাণহাণি ঘটে।

তবে আঘাত হানতে যাওয়া ঘুর্ণিঝড় ‘বুলবুল’ নিয়ে উৎকন্ঠায় দিন কাটাচ্ছে উপক‚লের মানুষ।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।