বাংলাদেশে সরকারি কর্মকর্তারা সহজ শর্তে ফ্ল্যাট, গৃহঋণ সুবিধা পাচ্ছেন, তাদের বেতন বেড়েছে কয়েক গুণ; কিন্তু তাদের দুর্নীতির খবর প্রায়ই আসছে গণমাধ্যমে। এমনকি এতিমদের জন্য বরাদ্দ টাকাও ছাড়ছেন না তারা। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে এক এতিমখানায় যা ঘটেছে তা রীতিমতো বিস্ময়কর।

ফেনীর সোনাগাজীতে একটি এতিমখানার জন্য পাতিল-কড়াই, খাট-টেবিলসহ আসবাবপত্র কিনতে যে দাম ধরা হয়েছে তা অবিশ্বাস্য। বর্তমান বাজারমূল্যের সঙ্গে এতিমখানার আসবাবপত্র কেনার দামের যে ফারাক তাকে আকাশ-পাতালই বলা চলে।

প্রস্তাবিত আটতলা ভবনে এতিম ও প্রবীণদের থাকার জন্য ১০০টি স্টিলের খাট কেনা হবে। একটির মূল্য ১০ হাজার টাকা ধরে এসব স্টিলের খাট কিনতে খরচ ধরা হয়েছে ১০ লাখ টাকা। একটির মূল্য ২৫ হাজার টাকা ধরে ২৫টি হুইলচেয়ার কিনতে খরচ হবে ছয় লাখ ২৫ হাজার টাকা। ১০০টি টেবিল, যার প্রতিটির মূল্য চার হাজার টাকা ধরা হয়েছে। ফেনীর ফুলগাজী উপজেলায় ‘প্রবীণ নিবাস ও এতিমখানা ভবন’ নির্মাণ প্রকল্পে এসব অস্বাভাবিক খরচ ধরেছে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও বাস্তবায়নকারী সংস্থা সমাজসেবা অধিদপ্তর।

কালেরকন্ঠের এক প্রতিবেদনে এসব দুর্নীতির তথ্য উঠে আসে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ২৪ কোটি ৬৮ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটিতে প্রতিটি চেয়ারের দাম এক হাজার ৫০০ টাকা ধরে ১০০টি চেয়ারের দাম ধরা হয়েছে দেড় লাখ টাকা। প্রতিটি আলনা এক হাজার ৫০০ টাকা করে ১০০টি আলনা কেনা হবে দেড় লাখ টাকায়।

রাজধানীর শেওড়াপাড়ায় অবস্থিত নিউ স্টাইল ফার্নিচার দোকান থেকে সারা দেশের দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য সমজাতীয় আসবাবপত্র কিনেছে সরকারি আরেকটি সংস্থা। মেট্রো রেল প্রকল্পের বিভিন্ন আসবাব কেনা হয়েছে এই দোকান থেকে। দোকানের অন্যতম অংশীদার রবিন মিয়া বলেন, ‘দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য সরবরাহ করা সিঙ্গল স্টিলের খাটের দাম ধরা হয়েছিল তিন হাজার ৮০০ টাকা করে। আর ডাবল স্টিলের খাটের দাম ধরা হয়েছিল চার হাজার টাকা। এ ছাড়া প্রতিটি টেবিল দুই হাজার টাকা দরে সরবরাহ করা হয়েছিল। সে হিসাবে এতিম ও প্রবীণদের জন্য প্রস্তাবিত স্টিলের খাট ও টেবিলের দাম ধরা হয়েছে সরবরাহ করা খাট ও টেবিলের দামের দ্বিগুণেরও বেশি।’

নিউ স্টাইল ফার্নিচার দোকানের অংশীদার রবিন মিয়া আরো জানিয়েছেন, সোনাগাজীর জন্য যে স্পেসিফিকেশনের ম্যাট্রেস, কম্বল ও বিছানার চাদর কেনা হচ্ছে তার দামও ধরা হয়েছে অস্বাভাবিক, যার সঙ্গে বর্তমান বাজারমূল্যের কোনো মিল নেই। এই প্রকল্পের আওতায় ১০০টি ম্যাট্রেস কেনা হবে, যার প্রতিটির খরচ ধরা হয়েছে পাঁচ হাজার টাকা। সে হিসেবে ১০০টি ম্যাট্রেস কিনতে খরচ পড়বে পাঁচ লাখ টাকা। একেকটির মূল্য তিন হাজার টাকা ধরে ১০০টি কম্বল কেনা হবে তিন লাখ টাকায়। আর প্রতিটি বিছানার চাদরের একেকটির মূল্য এক হাজার ৫০০ টাকা ধরে ১১০টি কেনা হবে এক লাখ ৬৫ হাজার টাকায়।

প্রস্তাবিত প্রকল্পে বিভিন্ন আসবাবের যে দাম ধরা হয়েছে তার সঙ্গে বর্তমান বাজারমূল্যের সামঞ্জস্য কতটুকু তা দেখতে রাজধানীর শ্যামলীর কয়েকটি মার্কেট, কাজীপাড়া ও কারওয়ান বাজারে গিয়ে ব্যাপক ফারাক পাওয়া যায়।

শ্যামলীর কামাল সার্জিক্যাল স্টোরের স্বত্বাধিকারী কামাল হোসেন মৃধা জানালেন, মাঝারি মানের একটি হুইলচেয়ার বিক্রি হচ্ছে চার হাজার ২০০ টাকা থেকে চার হাজার ৫০০ টাকায়। আর ভালো মানের একটি হুইলচেয়ার বিক্রি হচ্ছে সাত হাজার ৫০০ টাকা করে, কিন্তু প্রস্তাবিত প্রকল্পে একটি হুইলচেয়ারের দাম ধরা হয়েছে ২৫ হাজার টাকা। প্রস্তাবিত প্রকল্পে একটি ম্যাট্রেসের দাম ধরা হয়েছে পাঁচ হাজার টাকা, কিন্তু বাজারে ম্যাট্রেস বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ দুই হাজার টাকায়। এসব মার্কেট থেকে সারা দেশেই হুইলচেয়ার ও ম্যাট্রেস সরবরাহ করা হয়।

প্রস্তাবিত প্রকল্পে একটি স্টিলের খাট কেনা বাবদ দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১০ হাজার টাকা। মিরপুরের স্টেডিয়াম মার্কেট ও কাজীপাড়ার দোকান গুলোতে প্রতিটি সিঙ্গল স্টিলের খাট বিক্রি হচ্ছে গড়ে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকায়। এখানেও দাম ধরা হয়েছে দ্বিগুণ।

কাজীপাড়ায় অবস্থিত চায়না গার্ডেন ফার্নিচারের স্বত্বাধিকারী মফিজুল ইসলাম জানালেন, তাঁর দোকান থেকে সরকারি ও বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থায় খাট, আলনা ও চেয়ার সরবরাহ করা হয়। স্টিলের খাট মানভেদে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কারওয়ান বাজার ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিটি তাওয়া বিক্রি হচ্ছে তিন শ থেকে পাঁচ শ টাকায়। অথচ এই প্রকল্পে প্রতিটি তাওয়ার দাম ধরা হয়েছে দুই হাজার টাকা। এখানেও ব্যয় চার গুণ বেশি।

প্রকল্পের আওতায় একটি ডেস্কটপ, একটি সাদাকালো লেজার প্রিন্টার ও একটি স্ট্যান্ডার্ড স্ক্যানার মেশিনের যে দাম ধরা হয়েছে, তা শুনে আকাশ থেকে পড়লেন রাজধানীর আইডিবি ভবনের আরএস কম্পিউটারের স্বত্বাধিকারী পীযূষ চক্রবর্তী। প্রকল্প প্রস্তাবনা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, একটি ডেস্কটপ কোর আই ৫ স্ট্যান্ডার্ড ইউপিএসসহ ধরা হয়েছে ৭৫ হাজার টাকা। পীযূষ চক্রবর্তী বলেন, বর্তমানে ডেল ও এইচপি ডেস্কটপ স্ট্যান্ডার্ড ইউপিএসসহ খরচ হবে ৪৫ হাজার টাকা।

প্রকল্পটি যার হাত দিয়ে তৈরি হয়েছে তিনি সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা শাখার উপসচিব শফিকুল হায়দার। তিনি বলেন, প্রস্তাবিত প্রকল্পে আসবাবপত্রের যে দাম ধরা হয়েছে, তা গণপূর্তের রেট শিডিউল ও বাজার জরিপ করেই করা হয়েছে। সমজাতীয় অন্য প্রকল্প থেকে তথ্য সংগ্রহ করে দাম ঠিক করা হয়েছে। তবে দরপত্র আহ্বানের পর দাম কমতেও পারে। আবার বাড়তেও পারে। শফিকুল হায়দার বলেন, সরকারের যে পিপিআর রয়েছে, সেটিও অনুসরণ করা হয়েছে এখানে।

প্রকল্প পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এই প্রকল্পের আওতায় প্রবীণ ও এতিমদের ভাত রান্নার জন্য ১০টি বড় পাতিল কিনতে প্রতিটির জন্য খরচ ধরা হয়েছে তিন হাজার টাকা। আর মাঝারি আকারের পাতিলের দাম দুই হাজার ৫০০ টাকা। যদিও রবিন মিয়ার ভাষ্য মতে, বড় আকারের পাতিলের দাম সর্বোচ্চ ৫০০ টাকার মধ্যে। সে হিসাবে খরচ দেখানো হয়েছে ছয় গুণ বেশি। এই প্রকল্পের আওতায় লুকিং গ্লাস কেনা হবে ১০টি। একেকটি লুকিং গ্লাসের মূল্য ধরা হয়েছে দুই হাজার ৫০০ টাকা। প্রতিটি বঁটি এক হাজার ১০০ টাকা করে ধরে চারটি বঁটি কেনা হবে চার হাজার ৪০০ টাকায়। একই প্রকল্পে ১০টি বড় কড়াই কিনতে প্রতিটি দুই হাজার টাকা করে ২০ হাজার টাকা খরচ হবে। মাঝারি কড়াই প্রতিটি এক হাজার ৮০০ টাকা করে ১০টির দাম ১৮ হাজার টাকা। একেকটি তাওয়া দুই হাজার টাকা ধরে পাঁচটি তাওয়া কেনা হবে ১০ হাজার টাকায়।

এসব বিষয়ে শফিকুল হায়দার বলেন, ‘অনেক ছোটখাটো বিষয় চোখ এড়িয়ে যায়। আপনি আসবাবপত্রের যে দামের কথা বলেছেন, তা আসলেই বর্তমান বাজারমূল্যের সঙ্গে মিল নেই। হয়তো বিষয়টি নজরে আসেনি।’

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।