ঢাকাঃ পুরান ঢাকার সর্বত্রই ক্ষমতাসীন দলের সংসদ সদস্য হাজী সেলিমের একচ্ছত্র আধিপত্য। ২০০৮ সাল পর্যন্ত তার এ আধিপত্যে প্রভাবশালীদের কেউ কেউ ভাগ বসালেও গত এক যুগ ধরে তার কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। দখলবাজি, চাঁদাবাজি, অনিয়ম, দুর্নীতি আর দমন-পীড়নে এ সময়কালে তিনি স্রেফ নিজের অতীতকে ছাড়িয়ে গেছেন। ব্যবসায়ী তো বটেই, সাধারণ মানুষের কাছেও দিন দিন হাজী সেলিম পরিণত হয়েছেন এক মূর্তিমান আতঙ্ক হিসেবে। তার আধিপত্যের জালে পুরান ঢাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পর্যন্ত বাঁধা পড়েছে। পরিবারের সদস্যদের পাশাপাশি তার অনুগত অনেককেই বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি পদে বসিয়েছেন হাজী সেলিম। ফলে যা হওয়ার তা-ই হয়েছে; শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মান নেমে গেছে তলানিতে।

পুরান ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এসব প্রতিষ্ঠান চলে হাজী সেলিমের পরিবারের কথায়। ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি তো বটেই, অন্যান্য পদেও নিজের পছন্দের লোকদের বসিয়ে রেখেছেন তিনি। তাদের মধ্যে অনেকেই ডাহা মুর্খ ও অর্ধশিক্ষিত। তাদের কেউ কেউ আবার এলাকাতে চাঁদাবাজ ও নিষ্কর্মার ধাড়ি হিসেবে পরিচিত। ক্ষমতার প্রভাবে অথর্ব, অযোগ্যদের মসজিদ কমিটির সভাপতি পদে পর্যন্ত বসিয়ে দিয়েছেন হাজী সেলিম।

জানা যায়, আহমেদ বাওয়ানী একাডেমী স্কুল অ্যান্ড কলেজের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি পদে রয়েছেন হাজী সেলিমের বড় ছেলে সোলায়মান সেলিম।

স্থানীয়রা বলছেন, কলেজটিতে পালাক্রমে হাজী সেলিমের পরিবারের সদস্যরাই দায়িত্ব পালন করছেন এক যুগ ধরে। স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির অন্য পদগুলোতেও হাজী সেলিমের পছন্দসই লোক বসানো হয়েছে। এমনকি প্রধান শিক্ষক হিসেবে যিনি আছেন, তিনিও হাজী সেলিমের ‘কাছের লোক’ হিসেবে পরিচিত বলে অভিযোগ রয়েছে। পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির মান এখন পড়তির দিকে। হাম্মাদিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের দশা আরও খারাপ। এ স্কুলের ম্যানেজিং কমিটিতে প্রিন্স রবিন নামে একজনকে রাখা হয়েছে, যিনি হাজী সেলিমের ছেলে ইরফান সেলিমের সার্বক্ষণিক সহযোগী। এলাকাবাসীর কাছে ‘ভবঘুরে’ বলে পরিচিত এই প্রিন্স। একটি মহিলা মাদ্রাসার ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি হিসেবে রয়েছেন ইরফান সেলিমের স্ত্রী। আর ইরফান সেলিম ইসলামিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি। লালবাগের রহমাতুল্লাহ স্কুলের সভাপতি পদে বসানো হয়েছে আলিয়া মাদ্রাসা ও লালবাগ থানা ছাত্রলীগের সাবেক নেতা হাজী সেলিমের ঘনিষ্ঠ বলে কথিত সাগর আহমেদ শাহীনকে। যদিও সাগর আহমেদ শাহীন বকশিবাজারের বাসিন্দা।

আনোয়ারা বেগম গার্লস স্কুলের সভাপতি হিসেবে রয়েছেন ইরফান সেলিমের ‘ডান হাত’ হিসেবে পরিচিত আবদুর রাজ্জাক। আবদুর রাজ্জাককে স্থানীয়রা চেনেন ইরফান সেলিমের ফুটফরমায়েশ খাটা লোক হিসেবে। ইসলামবাগের হাজী সেলিম বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের সভাপতি হাজী সেলিমের ছেলে সোলায়মান সেলিম। অগ্রণী স্কুল অ্যান্ড কলেজের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতিও তিনি। এ স্কুলের সাবেক সভাপতি হাজী সেলিমের স্ত্রী গুলশান আরা সেলিম। প্রতিষ্ঠানটির সদস্য হিসেবে রয়েছেন লালবাগ থানা ছাত্রলীগের সাবেক নেতা শরীফুল এমদাদ নাঈম।

আজিমপুর এলাকার ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত ওয়েস্ট অ্যান্ড হাই স্কুলের সভাপতি হিসেবে রয়েছেন হাজী সেলিমের সার্বক্ষণিক সহযোগী দেলোয়ার হোসেন মিয়া। দেলোয়ার হোসেন মিয়ার বিরুদ্ধে জমি দখল, চাঁদাবাজিসহ বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। তিনি দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের স্থায়ী বাসিন্দা। অথচ ওয়েস্ট অ্যান্ড হাই স্কুল ওই ওয়ার্ডে নয়। জগৎমোহন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সভাপতি হাজী আসলাম। স্থানীয়রা জানান, হাজী আসলামের কোনো অক্ষরজ্ঞানই নেই। হাজী সেলিমের সার্বক্ষণিক ফুটফরমায়েশ তামিল করায় পুরস্কার হিসেবে তাকে বিদ্যালয়টির সভাপতি পদে বসানো হয়েছে। শুধু তাই নয়, চৌধুরীপাড়া জামে মসজিদের সভাপতিও হাজী আসলাম।

পুরান ঢাকার ছোট-বড় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই হাজী সেলিম ও তার পরিবারের একচ্ছত্র আধিপত্য। এমনকি বেসরকারিভাবে গড়ে ওঠা বিভিন্ন স্কুল ও কিন্ডারগার্টেনগুলোর ম্যানেজিং কমিটিতেও হাজী সেলিমের পরিবারের সদস্যদের রাখা হয়েছে।

এসব বিষয় নিয়ে কথা বলার জন্য হাজী সেলিমের মোবাইল ফোন নম্বরে কল করা হলেও অপর প্রান্ত থেকে রিসিভ করা হয়নি।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।