তিন হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। দুই মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে। সূত্রটির তথ্য, প্রতি উপজেলায় অন্তত দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হতে পারে; পাশাপাশি যোগ্য সব প্রতিষ্ঠানও এমপিও পাবে।

এমপিওভুক্তির জন্য বছরের পর বছর আন্দোলন করে আসা শিক্ষকরা বলছেন, দীর্ঘ দশ বছর পর এমপিওভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েও যদি সাড়ে ৯ হাজারের মধ্যে তিন হাজার অর্থ্যাৎ তিন-চতুর্থাংশ প্রতিষ্ঠানকেই বাদ দেয়া হয়; তবে তা তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। এটা তাদের কষ্ট আরো বাড়িয়ে দেবে বলে মনে করছেন অনেকে।

গতকাল সংসদে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেছেন, যোগ্য বিবেচিত সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্তির সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। কাউকে বঞ্চিত করা সরকারের লক্ষ্য নয়। তিনি বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্তির জন্য যে ৪টি ক্রাইটেরিয়া ধরে অনলাইনে আবেদন আহ্বান করা হয়েছিল, তার ভিত্তিতে এমপিওর জন্য যোগ্য বিবেচনা করা হয়েছে। পাশাপাশি তিনি বলেন, যেসব শিক্ষক টাকার বিনিময়ে শিক্ষার্থীদের নোট পড়াতে, গাইড বই পড়তে, কোচিংয়ে যেতে বাধ্য করে। যাদের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ রয়েছে আমরা তাদেরতো পুরস্কৃত করতে চাই না। ওইসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এমপিও দিলে যোগ্যতার কদর থাকে না।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় দেওয়া মানদন্ডগুলো হলো প্রতিষ্ঠানের একাডেমিক স্বীকৃতি, শিক্ষার্থীর সংখ্যা, পরীক্ষার্থীর সংখ্যা এবং পরীক্ষায় পাসের হার। প্রতিটি মানদন্ডের জন্য ২৫ নম্বর রাখা হয়।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিক্ষামন্ত্রীর ওই বক্তব্য আমলে নিলেও বোঝা যায়, এমপিওবিহীন বড় একটি অংশের শিক্ষকদের বঞ্চনা থেকেই যাচ্ছে। ফের তাদের রাস্তায় নামা ছাড়া উপায় থাকবে না।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানিয়েছে, নীতিমালা অনুসারে তারা ৩ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এমপিওর জন্য তালিকাভুক্ত করার ছক কষেছেন। গত বছরের জুলাইয়ে এমপিওভুক্তির দাবিতে নন-এমপিও শিক্ষক-কর্মচারীদের ব্যানারে কয়েক হাজার শিক্ষকের প্রায় এক মাস অনশনের পর সরকারের তরফ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে এমপিওর জন্য আবেদন করতে বলা হয়। যার প্রেক্ষিতে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিম্ন-মাধ্যমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক, মাদ্রাসা, কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ ৯ হাজার ৬১৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনলাইনে তাদের আবেদন জমা দেয়। এরপর সরকারের করা নীতিমালা অনুসারে যোগ্য প্রতিষ্ঠান খুঁজে বের করতে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ভেরিফিকেশন করা হয়। মন্ত্রণালয়ের ভেরিফিকেশন অনুসারে প্রায় সাড়ে নয় হাজার প্রতিষ্ঠান আবেদন করলেও তারা মাত্র ৩ হাজার যোগ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পেয়েছে। যেগুলো এমপিওভুক্তির শর্ত পূরণ করে।

একটি সূত্র জানায়, জাতীয় সংসদে বাজেট প্রস্তাব উত্থাপনের পর থেকেই এ নিয়ে কাজ শুরু করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ঠিক কতটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হবে, তা নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না হলেও মন্ত্রণালয়ের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র নিশ্চিত করেছে, এর সংখ্যা তিন হাজারের কম হবে না।

এর আগে নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক-কর্মচারী ফেডারেশনের সভাপতি অধ্যক্ষ গোলাম মাহমুদুন্নবী গণমাধ্যমকে বলেন, ‘দীর্ঘ দশ বছর পর এমপিওভুক্তির একটি কার্যক্রম শুরু হবে বলে আমরা আশা করছি। এ জন্য আমাদেরকে দীর্ঘ সংগ্রাম করতে হয়েছে। প্রায় সাড়ে নয় হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওর জন্য আবেদন করেছে। আমরা চাই সরকার সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত করবে। অনেকের কাছে মনে হতে পারে সাড়ে নয় হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনেক বেশি। কিন্তু এটাও আমাদের মাথায় রাখতে হবে গত দশ বছরে দেশে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত করা হয়নি। এছাড়া দশ বছর পূর্বে যখন এমপিওভুক্ত করা হয় তাও সংখ্যায় ছিল খুবই সীমিত। সবকিছু বিবেচনায় নিলে সাড়ে নয় হাজার বেশি নয়।’

নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক-কর্মচারী ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ ড. বিনয় ভূষণ রায় বলেন, ‘আমাদের দাবি অত্যন্ত পরিষ্কার। আবেদনকৃত সব প্রতিষ্ঠানকেই এমপিওভুক্ত করতে হবে। তবে সরকার বিষয়টি কিভাবে দেখছে তা আমাদের কাছে পরিষ্কার নয়। কারণ গত মার্চে যখন আমরা প্রেসক্লাবের সামনে আন্দোলনে ছিলাম তখন শিক্ষামন্ত্রী নিজে এসে আমাদেরকে কথা দিয়েছিলেন তিনি আমাদেরকে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করিয়ে দেবেন। আমরা নিজেরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের সমস্যা তুলে ধরতে চাই। কারণ আমরা মনে করি প্রধানমন্ত্রীকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রকৃত সমস্যা জানতে দেয়া হচ্ছে না। এ কারণে আমরা নিজেরা তাকে বাস্তব অবস্থা জানাতে চাই। কিন্তু দেড় মাস হয়ে গেলেও আমাদেরকে দেখা করার ব্যবস্থা করা হয়নি।’

শিক্ষকদের এসব বক্তব্য নিয়ে অবশ্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা কোনো মন্তব্য করতে চাননি। মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘নীতিমালার আওতায় এমপিওভুক্ত হতে হবে এটাই নিয়ম। কিন্তু এর বাইরে শিক্ষকদের দাবির মুখে সরকার বাড়তি আরও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত করবে কিনা এটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়।’

মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, আবেদন করা সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে একসঙ্গে এমপিওভুক্ত করা সম্ভব হবে না। এমপিওবিহীন সাত হাজার ১৪২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে একসঙ্গে এমপিওভুক্ত করতে গেলে বার্ষিক দুই হাজার ১৮৪ কোটি ২৭ লাখ ৫২ হাজার ২৫০ টাকা লাগবে। এর মধ্যে এক হাজার ২২৭টি নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের জন্য ২১৯ কোটি ৭১ হাজার ৩০০ টাকা, এক হাজার ৮৯টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের জন্য ৩৬৮ কোটি ১৫ লাখ ২৭ হাজার ৮৫০ টাকা, এমপিওভুক্ত তিন হাজার ২৭৫টি নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়কে মাধ্যমিকে উন্নীত করে এমপিওভুক্ত করতে ৫২২ কোটি ৬০ লাখ ৮১ হাজার ২৫০ টাকা, ৫১৮টি উচ্চমাধ্যমিক কলেজের জন্য ৩৫৭ কোটি ১২ লাখ ৪৭ হাজার ৪০০ টাকা এবং এমপিওভুক্ত এক হাজার ৩৩টি উচ্চমাধ্যমিক কলেজকে ডিগ্রি স্তরে উন্নীত করে এমপিওভুক্ত করতে ৭১৭ কোটি ৩৮ লাখ ২৩ হাজার ৪৫০ টাকা লাগবে। ডিগ্রি কলেজ এমপিওভুক্ত করতে বছরে লাগবে ৬৯ লাখ ৪৪ হাজার ৬৫০ টাকা, উচ্চমাধ্যমিক কলেজের জন্য লাগবে ৬৮ লাখ ৯৪ হাজার ৩০০ টাকা, আর নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের জন্য লাগবে ১৫ লাখ ৯৫ হাজার ৭৫০ টাকা।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।