দীর্ঘ ১০ বছর পর বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হলেও বিএনপি-জামায়াতপন্থী অসাধু কিছু কর্মকর্তার ভুলের খেসারত দিচ্ছে সরকার। জনপ্রতিনিধিদের মতামতকে উপেক্ষা করে শিক্ষা অধিদফতর ও শিক্ষা বোর্ডকে বাইরে রেখে এমপিও’র কাজ করতে গিয়েই বেঁধেছে তালগোল।

যোগ্য প্রতিষ্ঠান বাদ দিয়ে অযোগ্য ভূঁইফোড় প্রতিষ্ঠানের এমপিও, যুদ্ধাপরাধী ও ‘শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান’ নামে চারটি প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হওয়ায় হতাশ ও ক্ষ্ব্ধু সংসদ সদস্যরা দ্বারস্থ হয়েছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের। বঞ্চিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্তি চেয়ে শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপু মনির কাছে ডিও লেটার দিয়েছেন সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী-এমপিরা। একই সঙ্গে ভুঁইফোঁড় এবং বিতর্কিত প্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্তি বাতিল চেয়েও ডিও লেটার দিয়েছেন।

পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিত খাচ্ছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষা বোর্ড ও শিক্ষা অধিদফতরের কর্মকর্তারা। সোমবার বিকেল পর্যন্ত মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখা, শিক্ষা বোর্ড ও অধিদফতরের অর্ধশতাধিক সংসদ সদস্য আবেদনপত্র দিয়েছেন বলে জানা গেছে। যাদের অধিকাংশ আবেদনের কপিই জনকণ্ঠের হাতে এসেছে। ফাইল নিষ্পত্তি করা নিয়ে বেকায়দায় পড়েছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। তবে তারা জানিয়েছেন, সংসদ সদস্যদের দাবি পুনর্বিবেচনার আবেদন নিয়ে আগামী ১৫ ডিসেম্বর বৈঠক ডাকা হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মোমিনুর রশিদ বলেছেন, আগামী ১২ ডিসেম্বর এমপিও নীতিমালা সংশোধন কমিটির দ্বিতীয় বৈঠক করা হবে। এর কয়েকদিন পরেই যেসব প্রতিষ্ঠান বাদ পড়েছে, সেগুলো আমরা রিভাইজ করার বিষয়ে বসা হবে। আশা করছি সংসদ সদস্যদের দেয়া ডিও লেটারগুলোর একটি যৌক্তিক সমাধানে পৌঁছানো হবে।

মন্ত্রণালয়ে গিয়ে দেখা যায়, যোগ্য হয়েও বাদ পড়েছে এমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তথ্য-উপাত্ত নিয়ে হাজির হচ্ছেন সংসদ সদস্য কিংবা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিরা। এদের মধ্যে একজন সিনিয়র সহকারী জজ তার এলাকার কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের এমপিও নিয়ে কেলঙ্কারির অভিযোগ করেছেন। এর মধ্যে দুইটি প্রতিষ্ঠানের একটিতে ২৩ লাখ টাকার বাণিজ্য আরেকটিতে ৩০ লাখ টাকার আর্থিক লেনদেন হয়েছে বলে সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ আনেন তিনি। একই সঙ্গে বলেন, ‘আমার নাম পরিচয় লিখেন না। লিখলে হয়তো আমার আবেদন নিয়ে কর্মকর্তারা কাজ করবেন না।’ বরগুনার বামনা উপজেলার ‘মাসুম চৌধুরী টেকনিক্যাল স্কুল এ্যান্ড কলেজ’র কোন অস্তিত্ব না থাকলেও সেটির এমপিওভুক্তি দেয়া হয়েছে এমন অভিযোগ নিয়ে এসেছেন ওই উপজেলায় কয়েক আওয়ামী লীগ নেতা।

ভুঁইফোঁড় ও ভুয়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এমপিও অবিলম্বে বাতিলের দাবি জানিয়েছেন ময়মনসিংহ-৭ (ত্রিশাল) আসনের সংসদ সদস্য ও ধর্ম মন্ত্রণালয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মোঃ হাফেজ রুহুল আমীন মাদানী।

ডিও লেটারে তিনি বলেছেন, আমার সংসদীয় এলাকার ত্রিশাল পৌরসভাধীন এলাকায় কয়েকটি রুম ভাড়া নিয়ে কলেজের নাম ব্যবহার করে কয়েক বছর যাবত কোচিং বাণিজ্য করে আসছে। অতি হাস্যকর বিষয় হলো উক্ত ভুয়া কলেজের অধ্যক্ষ শরাফত আলী ম-ল, আমার নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ত্রিশাল কারিগরি ও বাণিজ্যিক কলেজের একজন কম্পিউটার ডেমোনেস্ট্রেটর।

এমনকি উক্ত ভুয়া প্রতিষ্ঠানটিতে সে তার সহোদর তিন ভাই, তিন ভাইয়ের বউ, তার ভগ্নিপতিকে প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। এই কুচক্রী মহলটি জাল জালিয়াতির মাধ্যমে ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে তথ্য গোপন করে অন্যায়ভাবে এমপিওভুক্ত করেছে। কোন প্রকার তদন্ত না করেই বিনিময়ের মাধ্যমে ভুয়া কলেজটি এমপিওভুক্ত করা হয়। নামধারী প্রভাষক কুচক্রী মহলকে আইনের আওতায় এনে সুষ্ঠু বিচারের জোর সুপারিশও করেন তিনি।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সর্বশেষ সভায় এমপিওভুক্তি নিয়ে তীব্র অসন্তোষ ও ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়েছে। সংসদীয় কমিটির এক সদস্য বলছিলেন, যোগ্য প্রতিষ্ঠান বাদ দিয়ে অযোগ্য ভুঁইফোঁড় প্রতিষ্ঠানের এমপিও করা হয়েছে অনেক এলাকাতেই। যুদ্ধাপরাধী ও ‘শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান’ নামে চারটি প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হয়েছে।

এর ফলে রাজনৈতিকভাবে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। সরকার বিরোধী কিছু আমলার কারণে এমনটা হয়েছে বলেই আমরা মনে করি। এছাড়া নীতিমালাতেও ভেজাল আছে। তাই ইতোমধ্যেই সংসদীয় কমিটির পক্ষ থেকে নীতিমালার বিষয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। সংশোধন করার কথা বলা হয়েছে। এমনকি আরও যোগ্য প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করার কথা বলা হয়েছে।

জনপ্রতিনিধিদের মতামত না নিয়ে এমপিও দেয়ায় যোগ্য ও এলাকার প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠান বাদ পড়েছে বলে মনে করেন সংসদ সদস্যরাও। যোগ্য প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করতে তাই এখন প্রভাবশালী মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যরা পুনর্বিবেচনার আবেদন করেছেন শিক্ষামন্ত্রীর কাছে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়ক (মন্ত্রী পদমর্যাদা) ও সংসদ সদস্য আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ্ ডিও লেটারে বরিশালের আগৈলঝাড়ার ‘বাসাইল শহীদ সুকান্ত বাবু কলেজ’ এর উচ্চ মাধ্যমিক স্তর এবং বরিশাল সদরের কাউনিয়ার ‘আবদুর রব সেরনিয়াবাত কলেজ’ ডিগ্রী স্তরকে এমপিওভুক্তি করতে অনুরোধ করেছেন।

ডিও-তে বলা হয়, এই দুইটি প্রতিষ্ঠান ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে নিহত শহীদদের নামে প্রতিষ্ঠিত। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দু’টির অধ্যক্ষ এমপিওভুক্তির জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্ধারিত আবেদনপত্রে আবেদন করেছেন। এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দু’টি আমার মরহুম পিতা শহীদ আবদুর রব সেরনিয়াবাত এবং আমার পুত্র সুকান্ত বাবুর নামে প্রতিষ্ঠিত। ইতোপূর্বে সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এবং আপনার বরাবরও আধা সরকারীপত্র দেয়া হয়েছিল, কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শহীদ বরেণ্য এ ব্যক্তির নামে প্রতিষ্ঠিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দুটি এখনও এমপিওভুক্ত করা হয়নি। তাই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ১৫ আগস্টের সকল শহীদদের প্রতি সম্মান জানিয়ে বর্ণিত প্রতিষ্ঠান দুটি এমিপওভুক্তির পুনর্বিবেচনা করার জোর অনুরোধ করছি।

সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী ও ভোলা-১ আসনের সংসদ সদস্য তোফায়েল আহমেদ তার নির্বাচনী ওয়াদা পূরণ করতে জেলার সদর উপজেলার ‘চর জাঙ্গালিয়া হাইস্কুল এ্যান্ড কলেজটি’ এমপিওভুক্তির পুনর্বিবেচনা করতে বিনীত অনুরোধ করেছেন।

তিনি ডিও তে লিখেছেন, প্রতিষ্ঠানটি ১৯৭৮ সালে স্থাপিত হয়। কলেজটিতে ২০১৮ ও ২০১৯ সালে পাসের হার যথাক্রমে ৮৮.১০ শতাংশ ও ৮৫.৭১ শতাংশ। চরাঞ্চলের নারীশিক্ষা বিস্তারে কলেজটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। কিন্তু দীর্ঘ ১১ বছরেও উচ্চ মাধ্যমিক স্তর এমপিওভুক্ত না হওয়ায় বিষয়টি পুনর্বিবেচনার জোর দাবি জানান তিনি।

তথ্যমন্ত্রী ড. হাসান মাহমুদ তার নির্বাচনী এলাকা চট্টগ্রাম-৭-এর রাঙ্গুনিয়া উপজেলার পূর্ব কোদালা এমএ তাহের উচ্চ বিদ্যালয় নিম্ন মাধ্যমিক স্তরে এমপিওভুক্তি করার বিষয়টি পুনর্বিবেচনার অনুরোধ করেছেন। তিনি তার ডিওতে লিখেছেন, বিদ্যালয়টি ২০০১ সালে পাঠদানের অনুমতি পেয়ে ২০০৫ সালে একাডেমিক স্বীকৃতি পায়। বর্তমানে ৬ষ্ঠ থেকে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত মোট ১৭৩ শিক্ষার্থী রয়েছে। জেএসসি পরীক্ষা গত ২০১৭ ও ২০১৮ সালে পাসের হার যথাক্রমে ৭৪.৩৬ শতাংশ ও ৯৪.৭৪ শতাংশ। এর বাইরে চট্টগ্রাম বোর্ড থেকে জেএসসিতে ৬ জন শিক্ষার্থী জুনিয়র বৃত্তি লাভ করে। তাই এ প্রতিষ্ঠানটির এমপিও দিতে পুনর্বিবেচনার অনুরোধ করছি।

পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম, এমপি আধা সরকারীপত্র (ডিও) দিয়েছেন ভুঁইফোঁড় প্রতিষ্ঠানের এমপিও বাতিল করে তার নির্বাচনী এলাকা রাজশাহী-৬ এর বাঘা উপজেলার ‘আলহাজ এরশাদ আলী মহিলা ডিগ্রী কলেজ’ এমপিওভুক্তির পুনর্বিবেচনা করার জন্য আবেদন করেছেন। তিনি তার ডিও তে কলেজটির ডিগ্রী স্তরের এমপিওভুক্তি পুনর্বিবেচনা করার সুপারিশ করেছেন।

সিনিয়র সাংবাদিক ও জাতীয় সংসদ সদস্য মুহম্মদ শফিকুর রহমান বলেন, আমি ২৬৩ চাঁদপুর ৪, ফরিদগঞ্জের নির্বাচিত এমপি। কিন্তু ওই অঞ্চলের তালিকা করার সময় আমাকে জিজ্ঞেস করা হয়নি। না প্রশাসনের পক্ষ থেকে না মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে। এমনকি শিক্ষামন্ত্রী আমার জেলা সদরের এমপি। তিনি আমাকে একবারও জিজ্ঞেস করেননি। কেন করেননি তা আমি বুঝতে পারি। জিজ্ঞেস করলে জামায়াতের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যে এমপিও করা যাবে না। আমার ফরিদগঞ্জের দেইচর গ্রামের মডেল একাডেমি নামে একটি হাইস্কুল এবার এমপিওভুক্ত তালিকায় রয়েছে। এই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা হাফেজ আবু বক্কর নামে এক ব্যক্তি, ওই গ্রামেই বাড়ি। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তারা দুই ভাই রাজাকার ছিল। ডিসেম্বরের প্রথমদিকে পালিয়ে প্রথমে পাকিস্তান ও পরে লন্ডন চলে যায়। ’৭৫-এ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করে মিলিটারি জিয়া ক্ষমতায় এলে হাফেজ আবু বক্কর দেশে আসে এবং একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে। নাম দেয় দেইচর মডেল একাডেমি। চারদিকে ১০ ফুট উঁচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা। মাঝে মধ্যে ২/৩ দিন গেট বন্ধ থাকে, ভেতরটা নীরব-নিস্তব্ধ।

একটি যোগ্য প্রতিষ্ঠানের এমপিও’র প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, আমি সভাপতি হবার কারণেই কি কলেজটি বাদ পড়ল কি-না, আমি জানি না। নইলে এটি বাদ পড়তে পারে না। ফরিদগঞ্জে যদি একটি কলেজও এমপিওভুক্ত হয় তাহলে গল্লাক আদর্শ ডিগ্রী কলেজ সবার আগে ডিজার্ভ করে। ঘনিয়া পীর সাহেব হুজুর পরিচালিত ঘনিয়া মাঈদীয়া ফাজিল মাদ্রাসা ও কারিগরি কলেজটিও এমপিওভুক্ত হলো না। এর কারণও হয়তো পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপার। নইলে এটিও বাদ পড়ার কোন কারণ ছিল না। সূত্র:জনকণ্ঠ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।