গণকমিটি

নিজস্ব সংবাদদাতা, মাগুরা;  মাগুরা জেলা করোনা দুর্যোগ মোকাবিলায় গণ কমিটি ১০ দফা দাবিতে আজ শনিবার (০৯ মে ২০২০)  সকাল ১১টায় শহরের চৌরঙ্গী মোড়ে অবস্থিত কফি হাউসে সংবাদ সম্মেলনে করে।

সংবাদ সম্মেলনে সভাপতিত্ব ও লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন গণকমিটির আহ্বায়ক কাজী ফিরোজ (বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টি মার্কসবাদী মাগুরা জেলা আহ্বায়ক) ও পরিচালনা করেন যুগ্ম সদস্য সচিব শম্পা বসু (বাসদ কেন্দ্রীয় পাঠচক্র ফোরামের সদস্য)। সংবাদ সম্মেলনে বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন যুগ্ম আহ্বায়ক এটিএম মহব্বত আলী ( বাংলাদেশ জাসদ মাগুরা জেলা শাখার সভাপতি), সদস্য সচিব এটিএম আনিসুর রহমান (সিপিবি সদর উপজেলা সভাপতি ) ও বিশিষ্ট সমাজ সেবক কামরুজ্জামান চপল। উপস্থিত ছিলেন মোঃ সোহেল (সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট এর শহর কমিটির আহ্বায়ক) প্রমুখ।

সংবাদ সম্মেলনে সরকারি ত্রাণের অপ্রতুলতা ও বিতরণে অসংগতি তুলে ধরা হয় ।

‘সর্বশেষ আদম শুমারী অনুযায়ী মাগুরা জেলায় ৯ লাখ মানুষ বসবাস করে । দেশের যে ৭টি জেলার জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি দরিদ্র তার মধ্যে অন্যতম মাগুরা জেলা । অর্থাৎ এই জেলার সাড়ে ৪ লাখ মানুষ খুব গরীব । করোনা দুর্যোগে ২৮ মার্চ ও ৩০ মার্চ সরকারি ত্রাণ বরাদ্দ করা হয়েছে । মাগুরা জেলার জন্য চাল বরাদ্দ করা হয়েছে যথাক্রমে ৩১০ মেট্রিক টন ও ৭৫ মেট্রিক টন এবং নগদ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে যথাক্রমে ১০ লাখ ৫৪ হাজার ৫০০ টাকা এবং ২ লাখ টাকা। তার মানে মাগুরা জেলায় সরকারি ভাবে মোট চাল বরাদ্দ হয়েছে ৩৮৫ মেট্রিক টন এবং মোট নগদ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে ১২ লাখ ৫৪ হাজার ৫০০টাকা । অর্থাৎ মাগুরা জেলার একজন দরিদ্র মানুষের জন্য নগদ ২ টাকা ৭৮ পয়সা ও ৮৬৯ গ্রাম চাল বরাদ্দ করা হয়েছে ?  এই অবস্থা থেকে বোঝা যায় সরকারি ত্রাণ বরাদ্দ ভীষণ রকম ভাবে কম ।

এছাড়া বিভিন্ন এলাকায় ঘরে ঘরে যেয়ে গণকমিটির সদস্যরা তালিকা প্রণয়ন করেছেন।

নিম্নে তুলে ধরা হলো:

৯ নং ওয়ার্ড : জজ কোর্ট পাড়া
৬২ টি হতদরিদ্র পরিবারের মধ্যে ৩৫ টি পরিবার বিশেষ ওএমএস কার্ড পাননি।

৮ নং ওয়ার্ড : সর্দার পাড়া
২৯ টি হতদরিদ্র পরিবারের মধ্যে ২২ টি পরিবার বিশেষ ওএমএস কার্ড পাননি।

৩ নং ওয়ার্ড : বেলে মাঠ পাড়া
৩১ টি হতদরিদ্র পরিবারের মধ্যে ২৬টি পরিবার বিশেষ ওএমএস কার্ড পাননি।

৪ নং ওয়ার্ড : পিটিআই পাড়া (আংশিক)
৭ টি হতদরিদ্র পরিবারের মধ্যে কোন পরিবারই বিশেষ ওএমএস কার্ড পাননি।

অর্থাৎ হতদরিদ্রের প্রায় এক তৃতীয়াংশ বিশেষ ওএমএস কার্ড পান নি। তবে কার্ড পাওয়ার বিষয়ে তাদের আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে । নেতৃবৃন্দ প্রশ্ন তুলে ধরেন, ‘দেড় মাসেও তারা কার্ড পেলেন না, কবে পাবেন?’

কার্ড বিতরণের ক্ষেত্রে নিয়ম অনুযায়ী হতদরিদ্র, তারপর দরিদ্র, তারপর নিম্নবিত্ত এভাবে দেওয়ার কথা । কিন্তু যেহেতু কার্ড বিতরণ করছেন মেম্বার বা কাউন্সিলর গণ , ফলে দলীয়করণের অভিযোগ থেকে যাচ্ছে ।

বেশির ভাগ পরিবার একবার সরকারি ত্রাণ ( ৫ কেজি চাল, ১কেজি ডাল, ১ কেজি আলু, হাফ লিটার তেল, লবন) পেয়েছে । ৩/৪ দিনের বেশি একটি পরিবারের চলবে না । জজ কোর্ট পাড়ায় পরিবারগুলো এই ত্রাণের বাইরে আরেকবার সরকারি ত্রাণ পেয়েছে (৭কেজি চাল, ৩কেজি আলু)।

পুরো মাগুরা জেলার চিত্রই এরকম । কিন্তু মাগুরা জেলার সরকারি প্রতিনিধিরা বলছেন , ‘ত্রাণের এবং মানুষের খাদ্যের কোন অভাব নেই । মাগুরায় কোন কিছুর কোন সমস্যা নেই ।’ নীতি নির্ধারকদের এমন মনোভাবের কারণে মাগুরার দরিদ্র মানুষেরা আরও বেশি সংকটে পড়েছেন।

এমন পরিস্থিতিতে মাগুরা জেলা করোনা দুর্যোগ মোকাবিলায় গণকমিটির নেতৃবৃন্দ সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে দাবি ও কর্মসূচি ঘোষণা করেন ।

সংবাদ সম্মেলনের লিখিত বক্তব্য ;  করোনা দুর্যোগ মোকাবিলায় মাগুরা জেলা গণ কমিটির পক্ষ থেকে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাই। করোনাভাইরাস-জনিত মহামারির বৈশ্বিক দুর্যোগের সাথে সাথে বাংলাদেশেও স্বাস্থ্য সংকট ও মানুষের জীবনের সংকট ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। সাধারণ ছুটির ৪৫তম দিন চলছে। মাগুরা জেলার কর্মহীন শ্রমজীবী দরিদ্র নিম্নবিত্ত মানুষ খাদ্য সংকটে খুব মানবেতর জীবনযাপন করছে। সরকারি ভাবে যে ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে সেটা খুবই অপ্রতুল। বিশেষ ওএমএস (১০ টাকা কেজি চাল বিক্রি) কার্ড প্রয়োজনের তুলনায় অতি নগণ্য। মার্চ মাসের শেষ ও এপ্রিলের প্রথম দিকে মাগুরা পৌর এলাকার ৯টি ওয়ার্ডে ৩৬০০ ওএমএস কার্ড দেওয়া হয়। অর্থাৎ ওয়ার্ড প্রতি ৪০০ কার্ড। এপ্রিলের শেষে ও মে মাসের শুরুতে ওয়ার্ড প্রতি আরও ২০০ কার্ড দেওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ ওয়ার্ড প্রতি মোট প্রাপ্ত কার্ড ৬০০। যেখানে মাগুরা পৌর এলাকার ওয়ার্ড প্রতি গড়ে ১৫০০ পরিবার অতি দরিদ্র। কার্ড এর সংখ্যা অনেক কম আর সেটা বিতরণ নিয়েও আছে দলীয়করণ ও দুর্নীতির অনেক অভিযোগ। আবার এই কার্ডধারী পরিবারগুলোকে এপ্রিলে দেওয়া হয়েছে ১০০ টাকায় ১০ কেজি চাল। জানা গেছে মে ও জুন মাসে দেওয়া হবে ২০ কেজি করে চাল। মানুষের খাবারে কেবল ভাত হলে চলে না, পুষ্টির কথা না হয় বাদই দিলাম। এছাড়াও পরিবারে যদি ছোট শিশু ও অসুস্থ কেউ থাকে তাহলে তাদের প্রয়োজনটা জরুরি হয়ে যায়। অর্থাৎ যারা কার্ড পাচ্ছেন তারাও এ দিয়ে তাদের বেঁচে থাকার জন্য নূন্যতম প্রয়োজন মেটাতে পারছেন না। কার্ড দেওয়ার আগে সরকারিভাবে ত্রাণ দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন এলাকায় ১ বার বা সর্বোচ্চ ২বার করে। সেটার পরিমানও অপর্যাপ্ত। ৫/৭ দিনের বেশি চলা সম্ভব নয়, কিন্তু পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে ২/৩ মাস লাগবে।
আবার মাগুরা জেলার চিকিৎসা ব্যবস্থাও ভীষণভাবে দুর্বল। মাগুরা জেলায় করোনা টেস্ট করারই কোন ব্যবস্থা নেই। যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরিতে টেস্ট হচ্ছে মাগুরা জেলার নমুনা। মাগুরা থেকে গড়ে প্রতিদিন ১০টি নমুনা পাঠানো হয় পরীক্ষা করার জন্য যা ৯ লাখ মানুষ বসবাসকারী জেলার জন্য ভীষণভাবে কম। নমুনা সংগ্রহের মান নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। মাগুরা জেলায় সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ নেই, ভেন্টিলেটরও নেই। ফলে করোনা রোগীর চিকিৎসার প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজন নেই বললেই চলে। করোনা ছাড়া অন্যান্য রোগীদের চিকিৎসা পাওয়ার ক্ষেত্রেও
সংকট তৈরি হয়েছে ।

এমনই সংকটময় পরিস্থিতিতে গত ২০ এপ্রিল করোনা দুর্যোগ মোকাবিলায় মাগুরা জেলা গণ কমিটি গঠিত হয়েছে । ২২ এপ্রিল বিভিন্ন দাবিতে জেলা প্রশাসক বরাবর স্মারকলিপি পেশ করা হয়। ২৩ এপ্রিল মাগুরা জেলা সিভিল সার্জন এর সাথে মতবিনিময় করে গণকমিটি । ২৮ এপ্রিল মানববন্ধন করে দাবিসমূহ তুলে ধরা হয় । কিন্তু আমরা দাবিসমূহ বাস্তবায়নের তেমন কোন উদ্যোগ দেখতে পাচ্ছি না ।

এ পরিস্থিতিতে আমরা করোনা দুর্যোগ মোকাবিলায় গণকমিটির পক্ষ থেকে নিম্নলিখিত দাবি ও কর্মসূচি ঘোষণা করছি-
দাবিসমূহ:

১| ত্রাণসামগ্রীর পরিমাণ বৃদ্ধি, ত্রাণের আওতা ও ত্রাণ বিতরণের জন্য গ্রহীতার সংখ্যা বাড়াতে হবে। যেন কেউ ত্রাণ বঞ্চিত না হয়।
২। ত্রাণ বিতরণে দুর্নীতি দলীয়করণ বন্ধ করতে হবে। করোনা দুর্যোগ মোকাবিলায় দলীয়করণ বাদ দিয়ে সর্বদলীয় গণকমিটি গঠন করতে হবে।
৩| দরিদ্র, নিম্নবিত্ত কর্মহীন শ্রমজীবী প্রতিটি পরিবারকে একটি বিশেষ ওএমএস কার্ড প্রদান করতে হবে।
৪| দরিদ্র, নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত, কর্মহীন শ্রমজীবী প্রতিটি পরিবারকে ন্যূনতম ৬ মাস আর্মি রেটে রেশন বরাদ্দ করতে হবে।
৫| মাগুরা জেলা সরকারি হাসাপাতালে অবিলম্বে করোনা টেস্টের ব্যবস্থা করে প্রতিদিন নমুনা পরীক্ষা আরও বাড়াতে হবে, আইসিইউ ও কমপক্ষে ৫টি ভেন্টিলেটরের ব্যবস্থা করতে হবে।
৬| সরকার নির্ধারিত দামে খোদ কৃষকের কাছ থেকে ধান ক্রয় করতে হবে।
৭| ডাক্তার, নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মী এবং নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজে নিয়োজিতদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।
৮| শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সচল না হওয়া পর্যন্ত মাগুরা জেলা সকল মেস ভাড়া মওকুফ করতে হবে।
৯| গর্ভবতী মা ও ৫ বছরের নিচের শিশুদের জন্য শিশুখাদ্য, ওষুধসহ বিশেষ বরাদ্দ করতে হবে।
১০| নন এমপিও ভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারী, গৃহকর্মী, সেলুন কর্মী (নরসুন্দর), হোটেল কর্মী, হস্তশিল্পী, স্বর্নকার, দর্জি শ্রমিক, পরিবহণ শ্রমিকসহ দুর্যোগে বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত পেশাজীবীদের বরাদ্দ দিতে হবে

কর্মসূচি:
(শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে সকল কর্মসূচি পালন করা হবে) ১২ মে-১৬ মে— প্রচারপত্র বিতরণ ও ১৭ মে— জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ

করোনা দুর্যোগের মতো একটি জাতীয় দুর্যোগকে মোকাবিলার জন্য প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ। করোনার সাথে সাথে কর্মহীন মানুষ অনাহার ও দুর্ভিক্ষের ঝুঁকির মধ্যে পড়ার আশঙ্কা আছে। একদল ব্যবসায়ী বাজারকে অস্থির করে তুলে সাধারণ মানুষের জীবনকে দুর্বিসহ করে তুলতে চেষ্টা করছে। মানুষকে বাঁচাতে তাই সকলের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা দরকার। সাংবাদিক বন্ধুদের প্রতি আহ্বান এ সকল দাবি জনগণের কাছে তুলে ধরার মধ্য দিয়ে তাদেরকে অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে সহযোগিতা করবেন ।

আমাদের বাণী ডট/০৫ মে ২০২০/পিবিএ 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।