দেশের শিক্ষাকার্যক্রমে প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তরে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হচ্ছে। এ লক্ষ্যে বিগত কয়েক বছর ধরে অব্যাহত কার্যক্রম চলছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) তত্ত্বাবধানে। ইতোমধ্যে সারা দেশের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কারিকুলাম বিশেষজ্ঞদের মতামত গ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। এখন চলছে সমন্বয় ও নতুন কারিকুলাম প্রণয়নের কাজ।

এনসিটিবি সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘ কয়েক যুগ ধরে চলমান মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের বিভাগ নির্বাচনের ব্যবস্থা আর থাকছে না। এটি আগামীতে নির্ধারণ করতে হবে উচ্চমাধ্যমিক স্তরে গিয়ে। এ ছাড়া পাবলিক পরীক্ষার নম্বর কমিয়ে শ্রেণিকক্ষে স্কুলে বার্ষিক পরীক্ষা ও ধারাবাহিক মূল্যায়নের গুরুত্ব বাড়ানো হবে। এ ধরনের পদ্ধতি যুক্তরাষ্ট্রে চালু আছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
শিক্ষার মানোন্নয়নে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদদের নিয়ে গঠিত কমিটির সুপারিশের আলোকে এসব সিদ্ধান্ত

আগামী ২০২৪ সাল থেকে বাস্তবায়ন সম্পন্ন হবে বলে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) সূত্রে বলা হচ্ছে। বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে শিক্ষার্থীদের উৎপাদনমুখী ও বৈশ্বিক নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে এ উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। নতুন শিক্ষামন্ত্রী-শিক্ষা উপমন্ত্রী দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে বলে আসছেন, বর্তমানে যে কারিকুলামে পাঠদান হচ্ছে, তা নিয়ে শিক্ষার্থীদের আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা সম্ভব হবে না। সংশ্লিষ্টরা জানান, যদিও কারিকুলাম পরিবর্তনের কাজ শুরু হয়েছে আরো আগে থেকেই (২০১৬ সাল থেকে)। নতুন মন্ত্রী-উপমন্ত্রীর নির্দেশনা নতুন কারিকুলামে সম্পৃক্ত করার সুযোগ রয়েছে।

এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা নতুন কারিকুলাম প্রণয়নের কার্যক্রম চলমান জানিয়ে গতকাল বলেন, নতুন কারিকুলাম পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করা হবে, শুরু হবে ২০২১ সাল থেকে। ২০২৩ সালে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়ন সম্পন্ন করার টার্গেট রয়েছে। সে লক্ষ্যে কর্মযজ্ঞ চলছে। কারিকুলাম বিশেষজ্ঞরা গত কয়েক বছর ধরে অব্যাহতভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।

এনসিটিবির সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক ড. মশিউজ্জামানও একই কথা বলেন। তিনি বলেন, নতুন কারিকুলাম নিয়ে কাজ চলছে। এবারই প্রথমবারের মতো প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত সব বইয়ের পরিবর্তন আসবে।

এনসিটিবি সূত্রে জানা গেছে, নতুন এ পরিবর্তনে নবম শ্রেণী থেকে বিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষা ও মানবিক বিভাগ পছন্দের আর সুযোগ থাকবে না। ২০২৩ সাল থেকে নবম-দশম শ্রেণীর সব শিক্ষার্থী একই কারিকুলামের একই পাঠ্যবই পড়ার সুযোগ পাবে। একাদশ শ্রেণীতে গিয়ে বিভাগ বিভাজন শুরু হবে। এতে একজন শিক্ষার্থী মাধ্যমিক স্তরে সব বিষয়ে জ্ঞান লাভ করতে পারবে। ২০২১ সালে প্রথম শ্রেণীর ও ষষ্ঠ শ্রেণীর শিক্ষার্থী নতুন কারিকুলাম ও বই পাবে। যথাসময়ে বই পৌঁছানোর লক্ষ্যমাত্রা হাতে নিয়ে এ স্তরের নতুন কারিকুলাম চূড়ান্ত হবে ২০২০ সালে মাঝামাঝি সময়ে। ২০২২ সালে দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর এবং ২০২৩ সালে পঞ্চম শ্রেণীর পাঠ্যবইও পরিবর্তন করা হবে। পাশাপাশি ২০২২ সালে সপ্তম শ্রেণীর, নবম ও একাদশ শ্রেণীর পাঠ্যবই পরিবর্তন হবে। আর ২০২৩ সালে অষ্টম শ্রেণীর পাঠ্যবইয়ে পরিবর্তন আনা হবে। সূত্র জানায়, কারিকুলাম পরিবর্তনের পাশাপাশি পাঠ্যবইও বদলে যাবে। এবারই প্রথমবারের মতো প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের কারিকুলাম একসাথে পরিবর্তন ও সমন্বয় করা হচ্ছে। কারিকুলাম পরিবর্তনে শিক্ষার্থীদের জ্ঞান বৃদ্ধিতে সহায়ক বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা হবে। পাঠ্যবইয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, জঙ্গিবাদ, নিরাপত্তা বিষয়গুলো যুক্ত করা হবে। শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের পাশাপাশি কাজটি করে দেখানোর বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া হবে। যুক্ত থাকবে খেলাধুলাও।

কারিকুলামে বড় পরিবর্তনের মধ্যে মাধ্যমিক স্তরে নবম শ্রেণী থেকে বিভাগ তুলে দিয়ে গুচ্ছ পদ্ধতি চালু করা হবে। ফলে এ স্তরে বিজ্ঞান, মানবিক বা বাণিজ্য নামে কোনো বিভাগ বা বিষয় আর থাকবে না। সবাইকে সব বিষয় পড়তে হবে বা বিষয় পছন্দের সুযোগ থাকবে। এতে একজন শিক্ষার্থী মাধ্যমিক স্তরেই সব বিষয়ের সাথে পরিচিত ও জ্ঞান লাভ করবে। শিক্ষা বিষয় বিশেষজ্ঞদের মত হচ্ছে , দশম শ্রেণী পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীর সব বিষয়ে সমান ধারণা থাকা উচিত। ২০২৩ সাল থেকে নবম শ্রেণীর বিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষা ও মানবিক বিভাগ উঠিয়ে দেয়া হবে এবং শিক্ষার্থীরা নতুন কারিকুলাম ও বই পাবে।

কারিকুলামে দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় পাবলিক পরীক্ষার সংখ্যা ও নম্বর কমিয়ে আনা। এর পরিবর্তে শ্রেণিকক্ষে ধারাবাহিক মূল্যায়নের পরিমাণ বাড়ানো হবে। শ্রেণিকক্ষে সব বিষয়ে ধারাবাহিক মূল্যায়নে ২০ নম্বর রাখা হবে। এতে পাবলিক পরীক্ষার নম্বর কমে যাবে। বর্তমানে গার্হস্থ্য অর্থনীতি/কৃষি শিক্ষা পরীক্ষা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধারাবাহিকভাবে মূল্যায়ন করা হচ্ছে। এ অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে নতুন কারিকুলামে যুক্ত হবে সব বিষয়। বিশেষজ্ঞদের সুপারিশ অনুযায়ী ২০১৮ সাল থেকে চতুর্থ বিষয়ের পরীক্ষা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধারাবাহিকভাবে মূল্যায়ন করা হচ্ছে। এ মূল্যায়নের নম্বর সংশ্লিষ্ট শিক্ষা বোর্ডে পাঠানো হচ্ছে প্রতিষ্ঠান থেকে। মূল মার্কশিটে এসব বিষয়ের প্রাপ্ত নম্বর উল্লেখ থাকছে। তবে পরীক্ষার ফলে কোনো প্রভাব পড়ছে না।

অপর দিকে, মাধ্যমিক স্তরে বিভাগ বিভাজনের ফলে বিজ্ঞান বিভাগ শিক্ষার্থীরা ব্যবহারিক পরীক্ষার সুযোগে বেশি নম্বর অর্জন করে থাকে। কিন্তু মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষার শিক্ষার্থীদের এ সুযোগ খুবই কম। এতে তারা এক ধরনের বৈষম্যের শিকার হচ্ছে বছরের পর বছর। এনসিটিবির বিষয় বিশেষজ্ঞরা বলেন, দেশের হাইস্কুলগুলোতে পর্যাপ্ত ল্যাবরেটরি সুবিধা নেই। সরকারি হাইস্কুলে প্র্যাকটিক্যাল করানোর মতো পর্যাপ্ত ল্যাব বা সহকারী নেই। এরপরও বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরা ১০০ নম্বর ব্যবহারিকের মধ্যে প্রায় শতভাগ নম্বর পেয়ে যায়। এতে মানবিক ও ব্যবসা শাখার শিক্ষার্থীরা ফলাফলে চরম বৈষম্যের শিকার হচ্ছে।

মন্ত্রণালয় ও এনসিটিবি সূত্রে জানা গেছে, মাধ্যমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদদের নিয়ে ২০১৬ সালে একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সদস্যদের নিয়ে একই বছরের ২৫ ও ২৬ নভেম্বর কক্সবাজারে দুই দিনের আবাসিক কর্মশালা হয়। এতে শিক্ষাবিদরা যে সুপারিশ করেছিলেন তারই আলোকে কয়েকটি সাব-কমিটিও গঠন করা হয়। শিক্ষাক্রম পর্যালোচনা সাব-কমিটিগুলো ২০১৭ সালের ৩০ নভেম্বর ৮ দফা প্রস্তাব করেছিল। প্রস্তাবে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষাক্রম বিষয়বস্তুর গুরুত্ব অনুসারে তিন গুচ্ছে ভাগ করার জন্য সরকারকে পরামর্শ দেয়া হয়। ‘ক’ গুচ্ছে বাংলা, ইংরেজি ও গণিত। ‘খ’ গুচ্ছে বিজ্ঞান, সমাজ পাঠ (ইতিহাস পৌরনীতি ও ভূগোল)। ‘ক’ ও ‘খ’ গুচ্ছ বাধ্যতামূলক। আর ‘গ’ গুচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তি, চারুকারুকলা, শরীরচর্চা ও খেলাখুলা, ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা, কৃষি ও গার্হস্থ্য, নৃ-গোষ্ঠীর ভাষা ও সংস্কৃতি। এ ছাড়া ‘ঘ’ গুচ্ছে প্রকৌশল প্রযুক্তি (বিদ্যুৎ, যন্ত্র, কাঠ, ধাতু ইত্যাদির ব্যবহারিক জ্ঞান ও প্রয়োগ) যুক্ত করার মত দেন শিক্ষাবিদরা। শিক্ষাবিদরা ‘গ’ গুচ্ছের বিষয়গুলোর জন্য কোনো পাবলিক পরীক্ষা না নিয়ে বিদ্যালয়েই ধারাবাহিক মূল্যায়ন করার পরামর্শ দেন। আর শিক্ষার্থীর ভবিষ্যতের কর্ম ও পেশা নির্বাচনের প্রস্তুতি হিসেবে নবম ও দশম শ্রেণীতে আগের শ্রেণীর গুচ্ছের সাথে ‘ঘ’ গুচ্ছ যুক্ত করার কথা বলেন। এই গুচ্ছে রয়েছে পদার্থ, রসায়ন, জীববিজ্ঞান, উচ্চতর গণিত, হিসাব, বিপণন, ব্যবস্থাপনা ও অর্থনীতি। ‘ঘ’ গুচ্ছ থেকে যে কোনো দু’টি বিষয় শিক্ষার্থীরা পছন্দ করে নিতে পারবে। শিক্ষার্থীরা ইচ্ছা করলে ‘ঘ’ গুচ্ছ থেকে ঐচ্ছিকভাবে আরো একটি বিষয় নিতে পারবে। তবে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। নবম-দশম শ্রেণীতে পাঁচটি বাধ্যতামূলক বিষয় ছাড়া ‘গ’ গুচ্ছ থেকে দু’টি ও ‘ঘ’ গুচ্ছ থেকে দু’টি বা তিনটি বিষয় নিতে হবে। ফলে এসএসসি পরীক্ষায় ১৪টি থেকে চারটি বিষয় কম যাবে। অর্থাৎ ঐচ্ছিক বিষয়সহ মোট ১০টি বিষয়ের পাবলিক পরীক্ষা হবে।

তবে বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষকরা প্রস্তাবিত গুচ্ছ পদ্ধতি সম্পর্কে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তারা বলেন, বিজ্ঞান বিভাগ তুলে দিয়ে গুচ্ছ পদ্ধতি চালু করলে বিজ্ঞান বিষয়ের গুণগত মান কমে যাবে। নবম শ্রেণীতে বিজ্ঞান বিভাগ না থাকলে উচ্চমাধ্যমিকে গিয়ে শিক্ষার্থীরা বর্তমান সিলেবাসের সাথে তাল মেলাতে পারবে না। কারণ বর্তমানে ৯ম-১০ম শ্রেণীর বিজ্ঞানের বিষয়ের বইগুলোয় যেসব কনটেন্ট আছে , তা মানসম্মত নয়। একাদশের যে কনটেন্ট রয়েছে, তা অনেকটাই দুর্বোধ্য মনে হয় শিক্ষার্থীদের কাছে। আর সিলেবাস রয়েছে, তাও অনেক বড় বা বেশি। এতে যে পরিমাণ শ্রেণী ও ক্লাস নেয়া হয় কলেজ পর্যায়ে তা দিয়ে সিলেবাস কাভার করা যায় না। এতে কিছুটা দুর্বল শিক্ষার্থীরা এইচএসসিতে খারাপ ফলাফল করে এবং পরে হতাশ হয়ে পড়ে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।