তখন ২০১৫ সালের শুরু। ২০১৪ সালের শেষদিনে আমাদের ফাইনাল পরীক্ষার রেজাল্ট হলো। তার মানে আমরা তখন ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে নতুন বছরের সাথে সাথে নতুন জীবনে পা দিলাম। সবাই ক্লিয়ারেন্স নেওয়া নিয়ে ব্যস্ত। সাইন নিতে হবে, ক্যাম্পাসের প্রায় শতাধিক জায়গায় যেয়ে। উপরন্তু হলের সকল বকেয়া লেনদেন চুকিয়ে নির্ধারিত সময়ে হল ছাড়তে হবে। শহীদ লে. সেলিম হলে আমার পাশের রুমে থাকে শোভন আর নয়ন। তানভীর সিদ্দিকী নয়ন, হঠাৎ করে নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। কিছুই খেতে পারছে না। শরীরে শক্তি পাচ্ছে না। রুয়েট (রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়) মেডিকেল সেন্টারে দেখানোর পর ডাক্তার পরামর্শ দিলেন রাজশাহী মেডিকেলে দেখাতে। সেখানে দেখানোর পর যেটা শোনা গেল তার জন্য আমরা কেউই মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। তখন ডাক্তাররা কিছু টেস্ট করে প্রাথমিকভাবে জানালেন কিডনিতে সমস্যা। এরপর আর দেরি নয়। নয়নকে নেওয়া হলো ঢাকায়। ওর পরিবার সাথে। আমরা সবাই খবর পাচ্ছি নিয়মিত। আর দিনের বেলা দৌঁড়াচ্ছি ক্লিয়ারেন্স নিতে। খবর এল। তানভীরের দুই কিডনিই নষ্ট। সবাই যেন আকাশ থেকে পড়ল।

কি করা যায়? ওর পরিবারও প্রথমে বুঝতে পারেনি। বোঝার কথাও নয়। হতভম্ব হওয়া ছাড়া আর কি-ই বা থাকে এমন সংবাদে। এই সময়টাতে বন্ধু হিসাবে আমাদের অনেক কিছু করতে হবে, এটাই স্বাভাবিক ছিল। নয়নের পরিবারের সাথে আমাদের বন্ধুদের একটা গ্রুপ যোগাযোগ করল। উনাদের আর্থিক অবস্থা জানার পর আবাসিক হলে মিটিং বসলো। এইদিকে বিদায়ী ব্যাচের সবাই হল ছাড়ছে দিনে দিনে। মিটিংএ সিদ্ধান্ত হলো যে কয়দিন আছি আমরা চেষ্টা করে দেখি। ফেসবুকে ইভেন্ট খোলা হলো, যে যার অবস্থান হতে এগিয়ে আসলো। সিদ্ধান্ত হলো হল ছাড়লে যে জামানত ফেরত পাওয়া যায়, ’০৯ ব্যাচের পক্ষ থেকে সেটা তানভীরের নামে জমা হবে। বিদায়ী ব্যাচের সবাই এক এক করে ক্যাম্পাস ছাড়লো। চার বছরের ক্যাম্পাসের মায়ায় যতটা না চোখ ভিজলো তার চেয়ে বেশি ভিজলো তানভীরের জন্য। ফেব্রুয়ারি মাস। একুশে বইমেলায় আমরা কয়েকজন আর্থিক সাহায্য যোগাড় করতে নেমে পড়লাম। দেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে খবর গেলো তানভীর অসুস্থ। এগিয়ে আসতে হবে। দেশে হরতাল অবরোধ, এইদিকে আমরাও ক্যাম্পাস থেকে বের হয়ে সবাই এলোমেলো।

সবকিছু প্রায় থেমে গেলো। খবর এলো তানভীরের কিডনি টান্সপ্লান্টেশন হবে। ইন্ডিয়া নিতে হবে। আবার কয়েকজন বন্ধু নেমে পড়ল। ক্যাম্পাসে খবর পাঠানো হলো, জুনিয়ররা তাড়াতাড়ি নেমে পড়। সবাই আবার শুরু করলো। ঢাবি, রাবি, জাবি, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বিজ্ঞান প্রযুক্তিগুলো, বিভিন্ন কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় সবখানে সবাই চেষ্টা করছে। তানভীরকে বাঁচাতে। সবারই যেন একটাই চাওয়া, বেঁচে যাক তানভীর। বেঁচে যাক একটি পরিবার। তানভীরের অবস্থা খারাপ হচ্ছে। নিয়মিত ডায়ালাইসিস শুরু হয়েছে। পরিবার,আত্মীয়-বন্ধুদের চোখে পানি। তাহলে কি আর তানভীর টিকবেই না? মানা যায় না। এমন সময় খবর এল কিডনি পাওয়া যাচ্ছে না। তারপর সবারই হাত-পা অবশ হয়ে এল। কি করা যায়। এইদিকে টাকাও খুব একটা যোগাড় হয়নি। অনেকটা সময় চলে গেলো। ডায়ালাইসিস চলছে। রমজান মাস, কিছুদিন পর বন্ধুদের একজন চলে যাচ্ছে আমেরিকায়। অনেকদিন ওর সাথে দেখা হবে না আর। নয়ন হেঁটে চলে ডায়ালিইসিস নিচ্ছে। একটা ইফতারের আয়োজন হলো। সবাই আসলো। সবার মুখে একটা ম্লান হাসি। বিদায় বেলায় মনের ভিতর আঁচড়ে গেলো সবার। শোভন চলে যাচ্ছে দেশের বাইরে।

আর নয়নের সাথে আর দেখা হবে কিনা আমরা কেউই জানি না। প্রায় বছর কেটে গেলো। ডায়লাইসিস দিতে দিতে তানভীরের চেহারা পরিবর্তন হয়ে গেলো। এইদিকে টাকাও শেষ। হঠাৎ আশার বাণী। তানভীরের কিডনি টান্সপ্লান্টেশন হচ্ছে। ততদিনে বন্ধুদের অনেকেই চাকরি শুরু করছে। আবার সবার মধ্যে যোগাযোগ হলো। সবার বেতনের একটা অংশ জমা হলো। হয়তো তানভীরের বাবা-মা দু’হাত তুলে আল্লাহ্‌র কাছে আবার আর্জিটা রাখলেন। অপারেশন যেন সফল হয়। সবাই চেয়ে আছি, চাতক পাখির মত। কি হয়। অপারেশন সফল হলো। তানভীর বেঁচে গেল। সুস্থ হতে খানিকটা সময় লেগে গেল। একজন সুস্থ তানভীরের গল্পটা এখানেই শেষ হয়ে যেতে পারতো, যদিও পুরোপুরি সুস্থ হওয়া আর সম্ভব নয়। কিন্তু এর মাঝে একটা মনশক্তি তানভীরকে হয়ত নতুনভাবে ভাবিয়েছে। দেওয়ালের ওপার থেকে মৃত্যুকে দেখা তানভীর জীবনটাকে একবার মোচড় দিয়ে ঘুরিয়ে নিল। বন্ধুরা যেখানে দু’পায়ে ভর করে জীবনটাকে অনেকখানি এগিয়ে নিয়েছে, সেখানে তানভীরের জীবন যেন নতুন আলো দেখছে। পরিবারের সবটা শেষ করে তানভীর জেগে উঠেছে আল্লাহ্‌র অশেষ মেহেরবাণীতে। আর এটা ছিল সবচেয়ে বড় সত্য। চাকরি করার মত শক্তি এই নতুন কিডনি দুটা দিচ্ছে না তানভীরকে। বেঁচে থাকা যেখানে নড়বড়ে, জীবন ভীত্তি সেখানে শক্ত করে গড়ে তোলা অচিন্তনীয়। বিশ্বের বড় বড় সফলতার গল্প হয়ত এভাবেই শুরু হয়, যেভাবে মৃত্যু দেখা তানভীরের জীবনে শুরু হলো।

তানভীর খুব ছোট পরিসরে শুরু করলো অনলাইনে পণ্য বিক্রির ব্যবসা। তখন সব নিঙড়ে মাত্র পঞ্চাশ হাজার টাকা যোগাড় করে ব্যবসা শুরু করলো। গ্রুপ খুললো গ্যাঁট গেট ছোর ন্যাড় এক্সক্লুসিভ নামে। সে ব্যবসা শুরুতে শুধুই বন্ধুদের মাঝে থাকলো। একটু শক্ত হয়ে একটু জনবল সাথে নিয়ে ব্যবসা আরো একটু বাড়লো। বাড়লো পণ্যের কালেকশন। আরো কিছু বর্ধিত পরিসর পেলো। পেলো ক্যাম্পাসের সিনিয়র-জুনিয়রদেরকে, কাস্টমার হিসেবে। দিনের পর দিন সেটা বেড়ে বেড়ে বাইরে ছড়িয়ে পড়ল। ইনভেস্টমেন্ট বেড়ে পাঁচ থেকে সাত লাখ টাকা হলো। আর মৃত্যু দেখা মানুষের সততায় সে ব্যবসার পরিধি অনলাইন থেকে নেমে এল বাস্তব জগতে। নিজ শহর কুমিল্লায় বসলো এক্সপেরিএঞ্চে জোন নামে গ্যাঁট গেট ছোর ন্যাড় এক্সক্লুসিভ এর আউটলেট। এখন সে ঢাকা, রাজশাহীসহ দেশের চারটা জায়গায় তার এক্সপেরিএঞ্চে জোন এর জন্য আউটলেট রেডি করেছে। ইন্ডিয়া, চায়না থেকে ব্রান্ডের সব জিনসপত্র ইমপোর্ট করছে নিজেই, আলি এক্সপ্রেস অ্ইআমাযত্যাদি থেকে প্রোডাক্ট আনাচ্ছে কাস্টমারদের চাহিদা মত। সাথে যুক্ত করেছে আরো ১০ জনের বেশি মেম্বার। অনলাইনে গ্যাঁট গেট ছোর ন্যাড় এক্সক্লুসিভ এর এখন বড় ঝড়। একদিন হয়ত দেশের কয়েক লক্ষ মানুষকে সেবা দিবে অথবা তার চেয়েও বেশি কিছু। এখন তানভীর একজন সফল উদ্যোক্তা, তখন তানভীর হবে উদ্যোক্তাদের অনুপ্রেরণার গল্প। মৃত্যু যেখানে বেঁচে থাকার একরাজ্য স্বপ্ন নিয়ে জীবন ফিরিয়ে দেয়, সততা যেখানে পাথেয় হয় সেখানে সফলতা আসবেই। আসতে বাধ্য। আমরা সে সফলতার বর্ধিত গল্প শোনার অপেক্ষায়। যার জন্য লেখা : তানভির সিদ্দিকি, মালিক ঃ Gadget Corner Exclusive

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।