সরকারি চাকরিতে আবেদনের বয়স বাড়ানোর জন্য এখন যেই ২৬ লাখ বেকার আন্দোলন করছে তাদের অধিকাংশই সেশন জটের শিকার হয়েছে। বিশেষ করে যারা ২০০০-২০০৬ সালে এসএসসি/এইচএসসি পাশ করেছেন। ২০০০/২০০১ সালে হঠাৎ করেই স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ১ বছর করে বাড়িয়ে যথাক্রমে স্নাতক পাস কোর্সে ২ থেকে ৩ এবং স্নাতক সম্মানে ৩ থেকে ৪ বছর করা হয়।

বিএনপি–জামাত জোট সরকারের পর তত্তাবধায়ক সরকার আসার আগে কলেজ/ইউনিভার্সিটি গুলোতে হরতাল অবরোধের কারনে কোন প্রকার ক্লাস এবং পরীক্ষা সঠিক সময়ে হয়নি। তাছাড়া তত্তাবধায়ক সরকারের দুই বছরে বাংলাদেশে ৩য় ও ৪র্থ শ্রেনীর ছাড়া তেমন কোন নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি হয়নি। ২০১১ সালে অবসরের বয়স হঠাৎ করেই দুই বছর বাড়িয়ে দেয়ার ফলে চাকরির পদ শূণ্য না হওয়ায় চাকরি প্রত্যাশীদের হতাশা বেড়ে যায়। যার ফলে ২০১২ সালের ৩১ জানুয়ারি মহান সংসদে তৎকালীন স্পীকার বর্তমান মহামান্য রাষ্ট্রপতি এডভোকেট আবদুল হামিদ খান সরকারি চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা ৩৫ বছর করার জন্য আপনার দৃষ্টি অাকর্ষণ করেন।

২০১২ সাল থেকে চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা ৩৫ বছরে উন্নীত করার জন্য ছাত্র-ছাত্রীরা আজ ২০১৯ সাল পর্যন্ত অহিংস আন্দোলন করে আসছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে ৩৫ আন্দোলনের মতো এতো দীর্ঘস্থায়ী আন্দোলন আর হয়নি। সরকারি চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা ৩০ বছর থাকার কারনে বেসরকারি কোম্পানিগুলো সুযোগ বুঝে ৩০ বছরের পর আর লোকবল নিয়োগ দেয়না, যদিও দেয় তাহলে ৪/৫ বছরের অভিজ্ঞতা চায় কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে একজন ছাত্র তার পড়াশুনা শেষ করতেই যদি ২৭/২৮ বছর শেষ হয়ে যায় তাহলে ৩০ এর মধ্যে কিভাবে একজন ছাত্র ৪/৫ বছরের অভিজ্ঞতা অর্জন করবে।

একটা কথা সবারই মনে রাখা উচিত আমরা প্রতি বছর কত শতাংশ ছেলে মেয়ে সরকারি চাকরিতে সুযোগ দিতে পারি বড় জোর ৩/৪ শতাংশ। তাহলে বাকি ছাত্র-ছাত্রীদের অবশ্যই বেসরকারি সেক্টরে সুযোগ করে দিতে চাইলে অবশ্যই আবেদনের বয়স সরকারি চাকরিতে ৩৫ এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে ৩৫ এর চেয়েও বেশি সময় নিয়ে সুযোগ করে দিলে বেকারত্বের হার কমে যাবে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ৮ম সংসদের ২১ তম বৈঠকে চাকরিতে আবেদনের বয়স ৩২ বছর করার সুপারিশ করেছিল সেটিও তখন উপেক্ষা করা হয়েছে। ৯ম সংসদের ১৪তম অধিবেশনেও চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা ৩৫ এর জন্য প্রথম প্রস্তাব গৃহীত হয় কিন্তু আজ অবধী এটি বাস্তবায়ন হয়নি। ১০ সংসদের ২৯ এবং ৩১ তম বৈঠকেও অল্প সময় ব্যবধানে ৪ বার চাকরিতে আবেদনের বয়স ৩৫ বছর করার প্রস্তাব করা হয়।

১৯৯১ সালের ১৭ জুলাই তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল বিএনপি চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা ২৭ থেকে বাড়িয়ে ৩০ করে। দীর্ঘ ২৮ বছর পর দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষানীতি সবকিছুতেই পরিবর্তন এসেছে। তাহলে কেন চাকরিতে আবেদনের বয়সে পরিবর্তন হবে না? স্বাধীনতার পূর্বে দেশের সরকারি চাকরিতে আবেদনের বয়স সীমা ছিল ২৫ বছর, যা কিনা সেই ইংরেজ শাসন আমল থেকেই চলে আসছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ২৭ করা হয় এবং সর্বশেষ ১৯৯১ সালে পরিবর্তন করে ৩০ বছর করা হয়।

মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন হওয়া আমরা কি এখনো, যারা আমাদেরকে শোষণ করেছে, তাদের পদচিহ্ন অনুসরন করব? নাকি নিজেদের স্বকিয়তা ও স্বাধীনতা বজায় রেখে নিজের দেশের জনগনের কথা চিন্তা করে সিধান্ত নিব? তাছাড়া, দেশের স্বাধীনতা অর্জনের পরবর্তী অবস্থাও যদি চিন্তা করি, তাহলে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরবর্তী দুই দশকে চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা বেড়েছে মোট ৫ বছর। সেখানে সেই বয়স বৃদ্ধির হার যদি চলমান থাকত তাহলে আজকে চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা হত ৩৭ বছর, যেখানে দেশের শিক্ষার্থীরা চাচ্ছে মাত্র ৩৫ বছর। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি ২০১৯ সালে চাকরিতে আবেদনের বয়স বাড়িয়ে ৩৭ থেকে ৪০ বছর করে, এমতবস্থায়, আমাদের উচিত নয় কি যে, জনবান্ধব রাষ্ট্র হিসেবে উচ্চশিক্ষিত বেকার ছাত্র সমাজের দাবী মেনে নিয়ে চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা বাড়িয়ে একবারে ৩৫ বছর করা উচিত।

এই সেশনজটের ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীদের দ্বায়ভার রাষ্ট্রকেই নিতে হবে। তাদের কর্মসংসস্থানের ব্যবস্থা রাষ্ট্রকেই করতে হবে। অনেকেই বলে থাকেন, বয়স বৃদ্ধি করলে দেশে বেকারত্ব বেড়ে যাবে। কিন্তু একজন মানুষ বিবিধ কারনেই চাকরিতে প্রবেশে দেরি করতে পারে। হয়তবা, আর্থিক ও পারিবারিক পরিস্থিতি অথবা সেশন জট। হয়তবা বলবেন এখন সেশনজট নেই, কিন্তু এখনও বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সেশন জট আছে, যার জ্বলন্ত উদাহরণ ঢাবি অধিভুক্ত সরকারি ৭ কলেজ। এই অবস্থায় রাষ্ট্র ব্যবস্থা যদি বয়সের সীমা রেখা দিয়ে তাকে চাকরিতে আবেদনের সুযোগ না দেয়, আর বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও যদি সেই রাষ্ট্রীয় নীতি অনুসরন করে, তাহলে একজন ত্রিশোর্ধ্ব ব্যক্তি কোথায় চাকরি নিয়ে জীবিকা অর্জন করবে? বলবেন, ব্যবসা করার কথা, মূলধন তো সবার থাকে না।

ব্যাংকও তো জামানত না রেখে ধার দিবে না। তাহলে, সেই ব্যক্তি কি করবেন তার জীবিকা নির্বাহের জন্য? যেখানে গার্মেন্টস শ্রমিকদের ন্যূনতম বেতন বৃদ্ধি করা হল, সেখানে শিক্ষিত যুবকদের কর্মসংস্থানের সুযোগ না দিয়ে কি আমরা পরোক্ষ ভাবে তাদের উৎসাহিত করছি না যে, “তোমরা পড়ালেখা না করে শ্রমিক হও, অন্তত জীবিকা নির্বাহ তো হবে।” আবার অনেকেই বলছেন, প্রতিযোগীতা বেড়ে যাবে। প্রতিযোগীতাই কি মেধা নির্ণায়ক না? রাষ্ট্রের চোখে তো সবাই সমান, একজন ২৫ বছরের যুবক আর একজন ৩৩ বছরের যুবক। আর দেশের নাগরিক হিসেবে একজন ব্যক্তি যে কোন বয়সেই চাকরিতে প্রবেশের সুযোগের অধিকার রাখেন। আর যেখানে দেশের যুব নীতি ৩৫, সেখানে চাকরিতে আবেদনের বয়স ৩০ বছর অসামন্জস্যপূর্ণ। আবার, আনেকেই বলছেন নিয়োগ প্রকিয়া সম্পন্ন করতে ২-৩ বছর লেগে যায়। এই নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন মূলত কারা? নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে থাকেন মন্ত্রণালয়। আর এই দীর্ঘ সূত্রতার জন্য দ্বায়ী প্রশাসনিক জটিলতা। নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে ২-৩ বছর লেগে যাওয়ার দ্বায়ভার নিশ্চয়ই দেশের জনগনের উপর বর্তায় না, তাহলে এই সকল প্রশাসনিক জটিলতার দ্বায় ভার কেন জনগন নিবে?

অতএব, সরকারি চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা ৩০ থেকে ৩৫ বছরে উন্নীত করে দেশের উচ্চ শিক্ষিত তরুণ প্রজন্মের সময়ের দাবি মেনে নিন।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।