শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদ
পহেলা মে মহান শ্রমিক দিবস। ফাইল ছবি

আল আমীন হোসেন মৃধা;  ছোট বেলায় যখন ক্লাস ফাইভে পড়তাম, স্কুলের এক শিক্ষক ক্লাসে এসে জিজ্ঞেস করলেন- মে দিবস কি বলো তো? আমরা যারা শয়তান টাইপের ছিলাম, জোরে বলে উঠলাম- স্যার ছুটির দিন। কিন্তু অতিমাত্রায় বই পড়ুয়া চশমা পরিহিত কিছু ছেলে বলে উঠলো- স্যার শ্রমিক দিবস। স্যার বললেন, হ্যাঁ, ১ মে বিশ্বব্যাপী শ্রমিক দিবস। শ্রমিকদের জন্যেও যে দিবস আছে, ছোট বেলায় সেই প্রথম স্যারের কাছে শুনেছিলাম।

পৃথিবীর প্রতিটা দিনই কোন না কোন দিবস। মে দিবস সারা পৃথিবীর মেহনতি শ্রমজীবী মানুষের জন্য একটি ঐতিহাসিক দিবস। এ দিনটা শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের দিন, সংগ্রামের দিন। এই দিনে ৮ ঘন্টা কাজের দাবিতে আমেরিকার শ্রমজীবী মানুষেরা সকল শিল্পাঞ্চলে আন্দোলন গড়ে তুলেছিল, হতাহত হয়েছিলেন অসংখ্য শ্রমিক, নিহত হয়েছিলেন বেশ ক’জন, শ্রমিক নেতাদের মিথ্যে মামলায় ফাঁসিতে ঝুলানো হয়েছিল। সারা পৃথিবীতে শ্রমজীবী মানুষের আজকের এই শ্রমিক দিবস পালিত হলেও খোদ মার্কিন মুল্লুকে আজও মে দিবস সরকারিভাবে স্বীকৃত নয়।

মে দিবসের ঘটনাঃ

৮ ঘন্টা কাজের দাবিতে আমেরিকার শ্রমিকেরা আন্দোলন-সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছিলো দীর্ঘদিন। সে ধারাবাহিকতায় ১৮৮৬ সালের ১ মে শনিবার আমেরিকার সকল শিল্পাঞ্চলে অনুষ্ঠিত হয়েছিলো ধর্মঘট। এই আন্দোলনের প্রধান কেন্দ্র ছিলো শিকাগো শহর। আর এই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন বামপন্থী ট্রেড ইউনিয়ন সমূহের সমন্বয়ে গঠিত আট ঘন্টা শ্রম সমিতি। ১ মে’র ধর্মঘটে শিকাগোতে তিন লক্ষ শ্রমিক কাজ বন্ধ রাখেন। সকাল থেকেই শ্রমিকরা পরিবারের সদস্যদের নিয়ে শিকাগোর মিসিগান এভিনিউয়ে সমাবেশে যাবার প্রস্তুতি নিলে কারখানার মালিকরা আতংকিত হয়ে বিভিন্নভাবে শ্রমিকদের মাঝে গুজব ও আতংক ছড়ানোর চেষ্টা করে আন্দোলনকে স্তব্ধ করার জন্য পুলিশ ও গুন্ডাবাহিনী জড়ো করে। শ্রমিকরা সকল বাধা অতিক্রম করে ধর্মঘটকে সফল করেন। এই আন্দোলনে ১ লক্ষ ২৫ হাজার শ্রমিক ৮ ঘন্টা কর্মদিবসের দাবি আদায় করতে সক্ষম হয়। এই সাফল্য মালিকদের ভিত যেমন নাড়িয়ে দেয়, তেমনি আন্দোলনরত শ্রমিকদের নতুন করে প্রেরণা যোগায়। ২ মে রোববার ছুটির দিনে ধর্মঘটকে বিস্তৃত করার জন্য তৎপরতা চলে। ৩ মে’র ধর্মঘট আরো ব্যাপক আকার ধারণ করে।

এদিকে মালিক পক্ষ ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে আন্দোলনকে নস্যাৎ করার লক্ষে দালাল শ্রমিকদের দিয়ে দিয়ে শ্রমিক নেতাদের মধ্যে ফাটল ধরানোর চেষ্টা করে এবং আন্দোলনকারীদের উপর পুলিশী নির্যাতন আরম্ভ করে। শ্রমিকরা শত বাধা অতিক্রম করে শান্তিপূর্ণভাবে ৩ মে ম্যাককর্মিক ফসল কাটার কারখানায় এক আলোচনা সভায় মালিকদের প্রেরিত দালালদের মোকাবেলা করে এবং এর পর মুহুর্তে শ্রমিকদের এই সভায় পুলিশ অতর্কিত হামলা চালায়। এতে ঘটনাস্তলে ৬ জন নিহত হয়, আহত হয় অনেকে। এই নৃশংস হত্যাকান্ডের কাছেই চলছিলো কাঠ চেরাই শ্রমিকদের সভা। সভায় বক্তৃতা করছিলেন শ্রমিকদের এই আন্দোলনের অন্যতম নেতা স্পাইজ। স্পাইজ শ্রমিকদের সভায় গুলি বর্ষণের খবর পেয়ে তাৎক্ষনিকভাবে সহকর্মীদের সাথে আলোচনা করেন এবং এই পাশবিক হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে ৪ মে হে মার্কেটে প্রতিবাদ সমাবেশের আহ্বান জানান।

৪ মে হে মার্কেটের ঘটনাঃ

৪ মে হে মার্কেটে বিরাট শ্রমিক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশের কাছেই প্রচুর পুলিশ মোতায়েন করা হয়। হে মার্কেটের খালি জায়গায় স্কোয়ারে শ্রমিক নেতা বক্তৃতা শুরু করেন। শ্রমিক নেতা স্পাইজ এর বক্তৃতা শেষে রাত ১০ টা পর্যন্ত বক্তৃতা করেন অপর শ্রমিক নেতা পার্সন। সমাবেশে শেষ বক্তা সাম ফিল্ড বক্তব্য শেষ করার পর শ্রমিকরা যখন সমাবেশস্থল থেকে উঠে যাচ্ছিল, ঠিক এমনি সময়ে ওয়ার্ড নামের এক পুলিশ মঞ্চে উঠে বলা শুরু করে, “ইলিনয়া রাজ্যের জনগণের নামে আমি অবিলম্বে ও শান্তিপূর্ণভাবে সভা বন্ধ করার নির্দেশ দিচ্ছি।” শ্রমিক নেতা ফিলডেন এর উত্তরে বলে ওঠেন, “আমরা তো শান্তিপূর্ণভাবেই আছি।” তার কথা শেষ না হতেই ছদ্মবেশী পুলিশ আন্দোলনকে বানচাল করার জন্য বোমা বিস্ফোরন ঘটায়। সুযোগ সন্ধানী পুলিশ এই সুযোগে শুরু করে শ্রমিক জনতার উপর মুহুর্মুহু গুলিবর্ষণ। ঘটনাস্থলেই মারা যান ৪ জন, আহত হন বহু শ্রমিক। রক্তে রঞ্জিত হয়ে ওঠে হে মার্কেটের স্কোয়ার চত্বর। হে মার্কেটের হত্যাকান্ডের পর ঘটনা এখানেই শেষ নয়। শুরু হয় শ্রমিক এলাকাগুলোতে শ্রমিকদের উপর নির্যাতন-নিপীড়ন, মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার করা হতে থাকে শ্রমিক নেতাদের।

মিথ্যা মামলায় বিচারের নামে শুরু হয় প্রহসন। মামলা বিচারের আগেই বিচারকগন দোষী সাব্যস্ত করতে থাকেন শ্রমিক নেতাদের। বিচারের আগ পর্যন্ত পলাতক ছিলেন শ্রমিক মেহনতি মানুষের প্রিয় নেতা পারসন। বিচার শুরু হয় ২১ শে জুন। বিচারের দিন শিকাগো আদালতে হাজার হাজার মানুষ জড়ো হয়। বিচার শুরু হবার ঠিক আগ মুহূর্তে সবাইকে অবাক করে দিয়ে আদালতের কাঠগড়ায় হাজির হন শ্রমিক নেতা পারসন। আত্মপক্ষ সমর্থন করে শ্রমিক নেতা পারসন কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে দৃপ্ত কন্ঠে বলেন, “হে মাননীয় বিচারক, আমি এসেছি আমার নিরপরাধ কমরেডদের সাথে বিচারের সম্মুখীন হতে। কারণ, আমার বন্ধুদের শাস্তি হবে আর আমি পালিয়ে থাকবো, এটা করা আমার পক্ষে অসম্ভব।”

বিচারের রায় হয় ১৮৮৬ সালের ৯ অক্টোবর। অস্কার নীবেকে ১৫ বছর কারাদণ্ড আর অন্যান্যদের ফাঁসির রায় হয়। এই অন্যায় রায়ের বিরুদ্ধে সারা দেশের শ্রমিক সংগঠন, হাজার হাজার শ্রমজীবী মানুষ, বিশিষ্ট নাগরিক ও বিভিন্ন রাষ্ট্র প্রতিবাদ করে শ্রমিক নেতাদের মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে দাঁড়ালেও আমেরিকার সুপ্রিম কোর্ট রায় পুনরায় নিরিক্ষণে অস্বীকৃতি জানায়। অবশেষে ১৮৮৭ সালে ১১ই নভেম্বর ফাঁসির রায় নির্ধারিত হয়।

মৃত্যুর কয়েকদিন আগে শ্রমিক নেতা পারসন তাঁর স্ত্রীকে একটা চিঠি লিখেছিলেন। চিঠিতে লেখা ছিল, আমার অসহায় প্রিয় বউ…তোমাকে আমি জনগণের কাছেই অর্পণ করছি, জনগণের এক নারী। তোমার কাছে আমার অনুরোধ, আমি যখন রইবো না, তখন কোনো বেপরোয়া কাজ করো না, … সমাজতন্ত্রের মহান আদর্শ আমি যেখানে রেখে যেতে বাধ্য হলাম, সেখান থেকে তাকে তুলে ধরো।’ পার্সনের সেই চিঠি আজ সত্যিকার অর্থেই বাস্তবে রুপায়িত হয়েছে। সারা পৃথিবীর মেহনতী মানুষ আজকের দিনকে এই শহীদদের স্মৃতিকে চিরঞ্জীব করেছে। শ্রমিক সংগ্রামের প্রেরণা যোগাচ্ছে।
মে দিবসের ঘোষণাঃ

১৮৮৯ সালে সমাজতান্ত্রিকদের ২য় আন্তর্জাতিক সম্মেলনে সিদ্ধান্ত হয় ১৮৯০ সালের ১ মে হে মার্কেটের শ্রমিকদের স্মরণ করে মে দিবস পালন করার। সেখানে দাবি করা হয়, ৮ ঘন্টা শ্রমদিবস ঘোষণা করতে হবে, শ্রমিকদের স্বাস্থ্যসম্মত কর্মক্ষেত্র তৈরি করতে হবে এবং আরো অন্যান্য দাবি ঠিক করা হয়। সেখান থেকে শ্রমিকদের জন্য রক্তঝরা ‘লাল প্রতাকা’ ঠিক করা হয়। সেই থেকে ১৮৯১ সালে রাশিয়ায়, ১৯২০ সালে চীনে, ১৯২৭ সালে ভারতে মে দিবস পালন করা হয়। এখন আমেরিকা ছাড়া দুনিয়ার প্রায় সব দেশে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস পালিত হয়।

বাংলাদেশের শ্রমজীবী মানুষের কাছে মে দিবস একটি নিছক আনন্দে পরিণত করা হয়েছে। হাওরাঞ্চলের শ্রমিকদের হাহাকার, রানা প্লাজা, তাজরিন গার্মেন্টস, ট্যাম্পাকো সহ শত কারখানার দূর্ঘটনায় হাজারো নিহত শ্রমিকের পরিবারের আহাজারি, আহত-পঙ্গুত্ব বরণকারী শ্রমিকদের অসহায় জীবন যাত্রা শ্রমিক দিবসকে মূল্যহীনে পরিণত করেছে। ৮ ঘন্টা কর্মদিবসের দাবিতে আজ যে শ্রমিক দিবস, সেই ৮ ঘন্টা কর্মদিবস সরকারি আমলাদের জন্য হলেও শ্রমিকদের জন্য রয়ে গেছে সেই ১২-১৪ ঘন্টার কর্মদিবস। যে লক্ষ্য নিয়ে মহান মে দিবস ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল, আমাদের দেশের শ্রমিকরা তা আজও অর্জন করতে পারে নাই।

আজ ১৩৪ তম শ্রমিক দিবসে যে সকল শহীদেরা জীবন দিয়েছিল, তাঁদের জন্য রইলো প্রাণঢালা শ্রদ্ধাঞ্জলি। সেই সাথে শ্রদ্ধা জানাচ্ছি এদেশে বিভিন্ন সময় দূর্ঘটনায় নিহত শ্রমিকদের।

লেখক, সম্পাদক আমাদের বাণী ডট কম 

আমাদের বাণী ডট কম/০১ মে  ২০২০/পিপিএ 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।