যেকোনো দেশের শিক্ষার ভিত্তি হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষা, যেটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সহজেই অনুমেয় যে এই ভিত্তিকে যাঁরা যত বেশি শক্ত ও মজবুত করে গড়ে তোলার চেষ্টা করেন, তাঁরাই সফলকাম। কিন্তু এই সত্যটি আমরা কেন যেন বুঝি না। প্রাথমিক শিক্ষার সার্বিক পরিকল্পনাটিই যেন অগোছালো। ওপর থেকে যদিও মনে হয় সব ঠিক আছে, কিন্তু নেই। আর নেই বলেই বেতন বৈষম্য নিরসনের এক দফা দাবিতে সর্বাত্মক আন্দোলন করেছেন সারা দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রায় পৌনে চার লাখ শিক্ষক। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ও প্রধান শিক্ষকদের মোট ১৪টি সংগঠন মিলে গঠিত হয়েছে বাংলাদেশ ‘প্রাথমিক শিক্ষক ঐক্য পরিষদ’।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকরা বর্তমানে জাতীয় বেতন স্কেলের ১১তম গ্রেডে বেতন পান। তাঁদের দশম গ্রেডে উন্নীত করার প্রস্তাব করেছিল প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। সহকারী শিক্ষকরা পান ১৪তম গ্রেডে। তাঁরা ১২তম গ্রেডে উন্নীত হবেন বলে প্রস্তাবে ছিল। প্রাথমিক শিক্ষকরা জানান, আগে প্রধান শিক্ষকদের সঙ্গে সহকারী শিক্ষকদের বেতনের পার্থক্য ছিল এক গ্রেড। প্রধান শিক্ষকদের পদমর্যাদা দ্বিতীয় শ্রেণির গেজেটেড কর্মকর্তার সমান করায় এখন সে পার্থক্য দাঁড়িয়েছে তিন গ্রেডে। এটি নিঃসন্দেহে বৈষম্য। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবে দেওয়া এ বৈষম্য কমানোর প্রচেষ্টা ছিল। বর্তমানে সারা দেশে ৬৫ হাজার ৯০২টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে এবং এগুলোতে তিন লাখ ২৫ হাজার সহকারী ও ৪২ হাজার প্রধান শিক্ষক রয়েছেন। প্রধান শিক্ষকরা দীর্ঘদিন ধরে তাঁদের বেতন স্কেল দশম গ্রেডে নেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছিলেন। এই অসন্তুষ্টি সহকারী শিক্ষকদের মধ্যেও রয়েছে। বর্তমানে একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক জাতীয় বেতন স্কেলের ১১তম গ্রেডে ১২,৫০০ টাকা বেতন পান এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সহকারী শিক্ষকরা বেতন পান জাতীয় বেতন স্কেলের ১৪তম গ্রেডে ১০,২০০ টাকা। ১৬ বছর চাকরির পর একজন প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে একজন সহকারী শিক্ষকের বেতনের ব্যবধান হবে ভাতাসহ প্রায় ২০ হাজার টাকা। শিক্ষক নেতারা বলেন, বর্তমানে একজন প্রধান শিক্ষক যে স্কেলে চাকরি শুরু করেন, একজন সহকারী শিক্ষক সেই স্কেলের এক গ্রেড নিচে চাকরি শেষ করেন। এটি সহকারী শিক্ষকদের জন্য চরম বৈষম্য। তাঁরা দাবি করেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা যে শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে চাকরিতে যোগদান করেন, একই যোগ্যতায় অন্য বিভাগে যাঁরা সরকারি চাকরি করেন তাঁদের বেতন গ্রেডও তাঁদের তুলনায় তিন থেকে চার ধাপ ওপরে। এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে শিক্ষকদের চেয়ে কম শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে অন্য ডিপার্টমেন্টে সহকারী শিক্ষকদের তুলনায় বেশি বেতনে চাকরি করেন। তাই তাঁরা সম্মানজনক বেতন স্কেল, সামাজিক মর্যাদা ও আর্থিক নিরাপত্তা নিয়ে বেঁচে থাকতে চান। এটি নিঃসন্দেহে শিক্ষার প্রতি জাতীয় চরম অবহেলার প্রমাণ। বিষয়টি অনেক আগেই দূর হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু না হওয়াটা দুঃখজনক।

২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন ও পদমর্যাদা বৃদ্ধির ঘোষণা দেন। তখন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের বেতন স্কেল নির্ধারণ করা হয় দ্বিতীয় শ্রেণির পদমর্যাদাসহ ১১তম গ্রেডে, যার পরিমাণ ছয় হাজার ৪০০ টাকা। আর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সহকারী শিক্ষকের বেতন স্কেল নির্ধারণ করা হয় তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে, ১৪তম গ্রেডে, পাঁচ হাজার ২০০ টাকা। এতে বেতন গ্রেডের পার্থক্য হয় তিন ধাপ। তৃতীয় শ্রেণি থেকে প্রধান শিক্ষকরা দ্বিতীয় শ্রেণিতে উন্নীত হলেও সহকারী শিক্ষকরা তৃতীয় শ্রেণির পদেই থেকে যান। বেতন আপগ্রেডের সময় মূল বেতনের ব্যবধান হয় এক হাজার ২০০ টাকা এবং ২০১৫ সালের অষ্টম জাতীয় পে স্কেলে সে ব্যবধান দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ৩০০ টাকা। প্রাথমিক সহকারী শিক্ষকরা বর্তমানে বেতন পান ১৪তম ও ১৫তম গ্রেডে, যা মুদ্রাক্ষরিকদের সমান। এটি কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়।

২০১৭ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যখন আন্দোলন করছিলেন, তখন সরকার নীতিগতভাবে তাঁদের দাবিদাওয়া মেনে নিয়েছিল। বলা হয়েছিল, অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা বলে এটি বাস্তবায়ন করা হবে। কিন্তু গত দুই বছরেও নতুন গ্রেড বাস্তবায়ন না হওয়া দুঃখজনক। নতুন কাঠামোয় প্রধান শিক্ষকরা ১১তম গ্রেডে ও সহকারী শিক্ষকরা ১২তম গ্রেডে বেতন পাবেন বলে কথা ছিল। এ ছাড়া সহকারী প্রধান শিক্ষকের একটি পদ চালু করারও ঘোষণা দিয়েছে সরকার। এ ঘোষণাটি ভালো, তবে বাস্তবায়ন করা হয়নি। দেশের ৬৫ হাজার ৯০২টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তিন লাখ ২৫ হাজার সহকারী শিক্ষক ও ৪২ হাজার প্রধান শিক্ষক আছেন। এই বিপুলসংখ্যক শিক্ষককে বঞ্চিত রেখে প্রাথমিক শিক্ষাকে যে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়, তা প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের অজানা নয়। দুই বছর আগে নীতিগতভাবে শিক্ষকদের দাবি মেনে নেওয়ার পর সেটি বাস্তবায়ন না হওয়া সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অমার্জনীয় উদাসীনতা বলে মনে হয়। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব বলেছেন, গ্রেড পরিবর্তনে যে বাড়তি খরচ হবে, তা দিতে অর্থ মন্ত্রণালয়ও রাজি আছে। তাহলে সমস্যাটা কোথায়?

আমরা সবাই জানি যে আমাদের প্রাথমিক শিক্ষার মান তলানিতে গিয়ে পৌঁছেছে, বিশেষ করে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যারা পড়াশোনা করে তাদের অবস্থা একেবারেই করুণ, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া। এ ঘটনা আমরা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিবেদন ও গবেষণায় দেখেছি। কিন্তু আমাদের প্রাথমিক শিক্ষা সর্বজনীন, অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক অর্থাৎ এটি পুরোপুরি রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব। কিন্তু আমরা বিষয়টিকে যেন কোনোভাবে গুরুত্ব দিচ্ছি না। এর অনেক কারণের মধ্যে একটি বড় কারণ হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ন্ত্রণ করছেন প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা, শিক্ষক প্রতিনিধি নেই এখানে। প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নের জন্য রাষ্ট্রকে এই নীতি থেকে শিগগিরই বেরিয়ে আসতে হবে। প্রাথমিক শিক্ষাকে অনেক দেশেই প্রথম শ্রেণির মর্যাদা দেওয়া হয়, আমাদের দেশে বিষয়টি এখনো সে পর্যায়ে পৌঁছায়নি। তবে আমাদের টার্গেট সেভাবেই থাকতে হবে যে প্রাথমিক শিক্ষকরা হবেন রাষ্ট্রের প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা। এটি শুধু ঘোষণা দিলেই হবে না, এটি আবেগ বা রাজনীতির বিষয় নয়। এর জন্য যথেষ্ট প্রস্তুতি থাকতে হবে, প্রকৃত অর্থে প্রথম শ্রেণির মর্যাদা পাওয়ার জন্য সেই লেভেলের প্রার্থীদের এখানে নিয়োগ দিতে হবে। নিয়োগ প্রক্রিয়া হতে হবে স্বচ্ছ, প্রতিযোগিতামূলক ও স্মার্ট এবং নিয়োগপ্রাপ্তির পর শিক্ষকদের ওপরে ওঠার সিঁড়ি থাকতে হবে। সত্যিকার একটি জাতিগঠনের জন্য প্রাথমিক শিক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে, এর মান হতে হবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের।

শিক্ষকদের দাবির মুখে শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৬৫ হাজার প্রধান শিক্ষককে ১১তম ও তিন লাখ ৪২ হাজার সহকারী শিক্ষককে ১৩তম গ্রেডে বেতন দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন, কিন্তু ১১তম ও ১৩তম গ্রেডে বেতন প্রত্যাখ্যান করেছেন প্রাথমিকের শিক্ষকরা। একই সঙ্গে প্রধান শিক্ষকদের ১০ম এবং সহকারী শিক্ষকদের ১১তম গ্রেডে বেতন দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন প্রাথমিক শিক্ষক সংগঠনের নেতারা। অবিলম্বে প্রাথমিক শিক্ষকদের জন্য প্রকৃত শিক্ষাবিদদের নিয়ে একটি জাতীয় কমিশন গঠন করে কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী প্রাথমিক শিক্ষার সার্বিক বিষয়ে একটি শান্তিপূর্ণ ও স্থায়ী সমাধানে পৌঁছানো প্রয়োজন বলে আমরা মনে করছি।

লেখক : ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশ ইংলিশ ল্যাংগুয়েজ টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন (বেল্টা)। সাবেক ক্যাডেট কলেজ ও রাজউক কলেজ শিক্ষক।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।