সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ২৬ হাজার সহকারী শিক্ষক নানাভাবে বঞ্চিত হচ্ছেন বলে অভিযোগ তুলেছেন এক শিক্ষক নেতা। এছাড়া মর্যাদা, অসম্মান, অর্থনৈতিক সুবিধা ও সামাজিক মর্যাদা বিলুপ্তির হচ্ছে বলেও মনে করছেন তিনি। প্রাথমিক শিক্ষকদের বঞ্চনা থেকে মুক্তি ও মর্যাদা রক্ষায় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর খোলা চিঠিও লিখেছেন তিনি।

জাকির হোসেন হোসেন নামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী ওই শিক্ষক দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ারও দাবি তুলেছেন। তিনি বাংলাদেশ প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক সমাজের কেন্দ্রীয় কমিটির সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপ সাম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। তার চিঠিটি  পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে ধরা হল।

‘মাননীয় সচিব মহোদয়,
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সর্বোচ্চ চেয়ারে অধিষ্ঠিত করেছেন আপনাকে বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। নিশ্চয়ই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনাকে ভরসা পেয়েছেন যে, আপনিই পারবেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উন্নয়নের বিপ্লব ঘটাতে।

যুগে যুগে হাজার হাজার নেতার জন্ম নিবে, কিন্তু কোন নেতার জন্ম হয় প্রচলিত কিছু নিয়মকে ভেঙ্গে চুরমার করে সৃজনশীল চিন্তাধারার উন্নয়নের লক্ষ্যে কিছু নয়, সময়োপযোগী অনেক কিছু পরিবর্তন করতে। এমনই এক নেতা ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান’।

আমাদের সেই চিরজীবী শ্রদ্ধেয় নেতা বাংলাদেশ সৃষ্টি করেছেন যেমনটি করে, ঠিক তেমনই নতুনভাবে সৃষ্টি করেছিলেন বাংলাদেশে ৩৬+ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়কে। তিনি তার দূরদর্শী চিন্তাভাবনা থেকে জেনেছিলেন যে, বেতন বৈষম্য নিয়ে একই বিদ্যালয়ে কর্মরত সকল শিক্ষকের মধ্যে যেন হতাশা, হিংসা, বিদ্বেষ কাজ না করে। তাই প্রধান ও সহকারী শিক্ষকের মাঝে বিশাল দূরত্ব না রেখে, অর্থকে প্রাধান্য না দিয়ে, সম্মানকে বিভাজন করে স্বল্প টাকার ব্যবধান রেখে দিয়েছিলেন আলাদা দুটি স্কেলে। তিনি জানতেন, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন শিক্ষকের আন্তরিকতা না থাকলেও একজন শিক্ষার্থী তার নিজস্ব চেষ্টায় সর্বোচ্চ পর্যায়ে যেতে পারে। কিন্তু পারবেনা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নিজস্ব চেষ্টায় এগুতে।

আর তাই তৎকালীন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা কর্নধারেরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কার্যক্রম প্রচলিত অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের অধিনস্তদের মতো প্রশাসনিক ছকে না সাজিয়ে সাজিয়েছে আন্তরিকতার ছকে। যেন বিদ্যালয়ের সকল শিক্ষক নিজের পেশাকে নিজের দায়িত্ব, নিজের কর্তব্য মনে করে আন্তরিকতার শেষ বিন্দু দিয়ে হলেও কাজ করে।
ক্ষোভ ছিলনা দুটি পদের মোহ নিয়ে। শুধুমাত্র যারাই ছিল বেশি আন্তরিক শুধু তারাই নিয়েছেন প্রমোশন প্রধান শিক্ষক পদে। আর সেই জন্যই বিদ্যালয়ও চলেছে গোছানো ভাবে।

কিন্তু বর্তমানে এই দুটি পদের গ্রেডের পার্থক্য অনেকে বেশী হওয়ার প্রধান শিক্ষকের মতো পদের দায়িত্ব ও কর্তব্য বিমুখ সহকারীও প্রমোশন নিচ্ছে অর্থলোভী হয়ে। যা বিদ্যালয় পরিচালনা ও কাঙ্খিত মানে হওয়ার এক মহা বাঁধা। এই জন্যই প্রধান শিক্ষক, সহকারী প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকের ব্যবধান অর্থ দিয়ে লোভনীয় না করে যোগ্য ও আন্তরিকতার বিবেচনায় এনে শতভাগ প্রমোশনের কালজয়ী সিদ্ধান্ত নেওয়ায় উত্তম হবে বলে আমি মনে করি।

বঙ্গবন্ধুর সিদ্ধান্ত যে ভুল ছিলনা তারই প্রমাণ মিলেছে আপনাদেরই মতো অতি উচ্চমাত্রার মেধাবী মুখে। একদিন আপনি থাকবেন না। কিন্তু আপনার চেয়ার ঠিকই থাকবে। আপনার চেয়ারের পদধারী মহোদয় ঠিকই পাব, শুধু পাবনা আপনাদের মতে চৌকস মেধাবী, সৎ ও কর্মঠ।

কেননা বর্তমানে এটা প্রমাণিত হয়েছে যে , শিক্ষার মান নেই, অথচ আছে পাশের হার বৃদ্ধি। সেকালে ৬০% নম্বর পেতে হাটুতে প্যান্টের কাপড় ছিঁড়ে গেছে শিক্ষার্থীর, আর একালে ১০০% নম্বর পেতে একটু কৌশলী হলেই চলে।

মাননীয় মহোদয়,
বাবার পথ ধরে তারই কন্যা বাংলাদেশের চার বারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ২৬+ হাজার বিদ্যালয় জাতীয়করণ করে সৃষ্টি করেছেন ইতিহাসের দ্বিতীয় অধ্যায়। আরো ইতিহাস রেখেছেন নতুন জাতীয়কৃত বিদ্যালয়ের দায়িত্বে থাকা প্রধান শিক্ষকের পদ বহাল রেখে। যে কারণে সরকারী বিদ্যালয়ের ২৬ হাজার সহকারী শিক্ষক বঞ্চিত হতে হয়েছে প্রধান শিক্ষকের পদের প্রমোশন পেতে।

প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির আন্দোলনের ২০১৪ সালে প্রধান শিক্ষককে দ্বিতীয় শ্রেণী ঘোষণা করে আর সহকারীদের প্রধান শিক্ষকের চেয়ে তিন ধাপ নীচের স্কেল ঘোষণা করলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের মধ্যে শুরু হয় মর্যাদা, অসম্মান, অর্থনৈতিক সুবিধা ও সামাজিক মর্যাদা বিলুপ্তির কালবৈশাখী ঝড়। তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটছে আজও।

মাননীয় মহোদয়,
সকল নেতা যেমন বিপ্লব ঘটাতে পারে না, তেমনি সকল সচিব, সকল মন্ত্রীও বিপ্লব ঘটাতে পারে না। তার জন্য সবচেয়ে বেশী যেটি দরকার হয় তা হলো Situation. আর সেই Situation যে এখনই সৃষ্টি হয়েছে তা অস্বীকার করার নয়।এখন যদি আপনি বা আপনারা তিন লক্ষাধিক সহকারী শিক্ষকের মানসিক ভারসাম্য অবস্থান বিবেচনা করে সৃষ্ট পরিস্থিতির মোকাবেলা করে বিপ্লব না ঘটানো যায়, তাহলে শিক্ষকদের আন্তরিকতা বিমুখ পরিবেশে কঠিন থেকে কঠিনতম প্রশাসনিক কার্যক্রম নিয়েও লাভ হবে না। মানসম্মত পাঠের ব্যত্যয় ঘটবে তা নিশ্চিত।

কেননা, আমি আমার ১৯ বছরের শিক্ষকতা থেকে ধাপে ধাপে উপলব্ধি করতে পেরেছি যে, মানসম্মত পাঠের জন্য আন্তরিকতা ও প্রশাসনিক চাপ দুইয়েরই দরকার।

পরিশেষে মহোদয়ের নিকট বিনীত নিবেদন যে, আপনিই পারবেন প্রাথমিক শিক্ষার মান উন্নয়নে গ্রহণযোগ্য বেতন বৈষম্যের নিরসনের প্রধান ও সহপ্রধানকে একই গ্রেডে অথবা সহপ্রধান ও সহকারী শিক্ষকের একই গ্রেডে অন্তর্ভুক্ত করে অথবা সহপ্রধান পদটি সৃষ্টি না করে পার্থক্য কমিয়ে ক্রসপন্ডিং সুবিধা দিয়ে বিপ্লব ঘটাতে। যা আগামী প্রজন্মের শিক্ষকেরা শ্রদ্ধাভরে লালিত করবে, এগিয়ে যাবে প্রাথমিক শিক্ষার অগ্রযাত্রা।

জাকির হোসেন
সহকারী শিক্ষক,
সহ- সম্পাদক,
সাহিত্য ও সংস্কৃতি, কেন্দ্রীয় কমিটি
বাংলাদেশ প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক সমাজ – ১২০৪৮,ঢাকা

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।