বেতন বৈষম্য দূর করার দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলনের পর দাবি অনুযায়ী গ্রেড না পাওয়ায় নতুন গ্রেড প্রত্যাখ্যান করে আবারও আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন সরকারি প্রাথমিকের শিক্ষকরা। যদিও প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব বলেছেন, ‘শিক্ষকদের নতুন গ্রেডের প্রজ্ঞাপন আইনি মতামত দিয়ে জারি করা হবে।’

এদিকে সরকারি মাধ্যমিক স্কুলে প্রবেশে নন-ক্যাডার শিক্ষকরা শিক্ষানীতি-২০১০ অনুযায়ী ৯ম গ্রেডের দাবি জানিয়েছেন। ভেতরে ভেতরে অনেক দিন ধরেই তাদের মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে। খুব শিগগির সংশ্লিষ্টদের কাছে চিঠি দিয়ে দাবি জানাবেন। না মানলে কর্মসূচিতে যাবেন তারাও। অন্যদিকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত বেসরকারি কলেজে কর্মরত অনার্স ও মাস্টার্সের শিক্ষকরা গত ২৪ নভেম্বর সংবাদ সম্মেলন করে এমপিওভুক্তির দাবি জানিয়েছেন। আগামী মাস থেকে বিভিন্ন পর্যায়ে কর্মসূচি পালন শেষে কঠোর আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তারাও।

প্রাথমিক শিক্ষকদের নতুন গ্রেডে অসন্তোষ

সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের ১০ম ও সহকারী শিক্ষকদের ১১তম গ্রেডের দাবি জানিয়ে অনেক দিন ধরেই আন্দোলন করে আসছিলেন এ স্তরের শিক্ষকরা। বিভিন্ন সময়ে মানববন্ধন, অবস্থান কর্মসূচি, আমরণ অনশন এবং সমাবেশের আয়োজন করে তাদের দাবি জানিয়েছেন। তারই ধারাবাহিকতায় প্রাথমিক ও ইবতেদায়ি শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা বর্জন ঘোষণা করলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আশ্বাসে সেই কর্মসূচি থেকে সরে আসেন শিক্ষকরা। এরপর গত ৭ নভেম্বর অর্থ মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব সাদিয়া শারমিন স্বাক্ষরিত একটি নির্দেশনা গত ১২ নভেম্বর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে পাঠানো হয়। ওই নির্দেশনায় প্রধান শিক্ষকদের ১১তম গ্রেড এবং সহকারী শিক্ষকদের ১৩তম গ্রেড দেওয়ার কথা জানানো হয়। কিন্তু এই গ্রেড শিক্ষকরা প্রত্যাখ্যান করেন। তাদের দাবি, প্রধান শিক্ষকদের ১০ম ও সহকারী শিক্ষকদের ১১তম গ্রেড দিতে হবে। গত ১৫ নভেম্বর প্রাথমিক শিক্ষক ঐক্য পরিষদের পুরানা পল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংগঠনটির নীতিনির্ধারণী কমিটির এক জরুরি সভায় নতুন গ্রেড প্রত্যাখ্যান করার ঘোষণা দেওয়া হয়। একই সঙ্গে নতুন করে আন্দোলনে নামার হুঁশিয়ারিও দেন তারা।

শিক্ষকদের মতের বিরুদ্ধে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে কি-না জানতে চাইলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘শিক্ষকদের নারাজ করে কিছু করতে চাচ্ছি না। আমাদের মন্ত্রণালয় থেকে প্রস্তাব দেওয়া ছিল। অর্থ মন্ত্রণালয় ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে যে ধারণা দেওয়া হয়েছে, সে অনুযায়ী করেছি। পরে আমরা রিভিউ করেছি। আইনি মতামত দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে।’

জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি আতিকুর রহমান আতিক বলেন, ‘নতুন গ্রেড আমরা প্রত্যাখ্যান করেছি। নতুন যে গ্রেড দেওয়া হয়েছে তাতে বৈষম্য আরও বাড়বে। আমরা কোনো অযৌক্তিক দাবি করিনি। যৌক্তিক দাবি মেনে নিতে হবে। না হলে আন্দোলন আরও কঠোর হবে।’

মাধ্যমিকে প্রবেশে ৯ম গ্রেড চান শিক্ষকরা

মাধ্যমিকে প্রবেশ ৯ম গ্রেডের (মাধ্যমিক শিক্ষা ক্যাডার) দাবি করেছেন শিক্ষকরা। তারা বলছেন, জাতীয় শিক্ষানীতি অনুযায়ী ৯ম গ্রেডের দাবিদার তারা। আবার নন-ক্যাডার নিয়োগবিধি অনুযায়ীও তারা এই গ্রেড প্রাপ্য। বর্তমানে তারা ১০ম গ্রেড পান। শিক্ষক সমিতির নেতারা বলছেন, শুধু গ্রেডই নয় শিক্ষানীতি অনুযায়ী স্বতন্ত্র অধিদপ্তর, ন্যায্য আত্তীকরণ বিধিমালা প্রণয়ন, সিনিয়র শিক্ষক হিসেবে প্রমোশন, বিএড ইনক্রিমেন্ট দিতে হবে। গত শুক্রবার (২২ নভেম্বর) নায়েম অডিটরিয়ামে ৩৪তম বিসিএস (নন-ক্যাডার) মাধ্যমিক শিক্ষা বিভাগে কর্মরত শিক্ষকদের দ্বিতীয় বর্ষপূর্তিতে এক আলোচনা সভায় এসব দাবি তোলেন শিক্ষকরা।

বাংলাদেশ সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি মো. আবু সাঈদ ভুঁইয়া বলেন, ‘যৌক্তিকভাবেই মাধ্যমিকে প্রবেশে নন-ক্যাডার শিক্ষকরা ৯ম গ্রেডের দাবি রাখেন। তাদের বর্তমানে ১০ম গ্রেড দেওয়া হয়। আমরা প্রাথমিকভাবে মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়ে দাবি জানাব। দাবি মেনে নেওয়ায় কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে পরবর্তী সময়ে করণীয় ঠিক করে তা করা হবে। বর্তমানে এ নিয়ে শিক্ষকদের ভেতরে একটা অস্থিরতা ও অসন্তোষ কাজ করছে।’

বেসরকারি কলেজের অনার্স ও মাস্টার্স শিক্ষকদের এমপিও দেওয়ার দাবি

‘বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের (স্কুল ও কলেজ) জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা-২০১৮’ সংশোধন করে এমপিওভুক্তির দাবি এই স্তরের শিক্ষকদের। তারা অভিযোগ করেছেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে বারবার এ বিষয়ে অনুরোধ করে চিঠি দেওয়া হলেও তিনি কোনো উদ্যোগ নেননি। শিক্ষক নিয়োগে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় সরকারের আইনকে তোয়াক্কা করে না বলে অভিযোগ শিক্ষকদের। নিয়োগ বাণিজ্য করতেই নিয়ম মানে না কলেজ কর্তৃপক্ষ। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মধ্যে পারস্পরিক সমন্বয় না থাকার কারণে তাদের এমপিওভুক্তির বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় অনীহা প্রকাশ করে বলে জানিয়েছেন শিক্ষক নেতারা। এসব দাবি জানিয়ে গত ২৪ নভেম্বর রাজধানীতে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন বাংলাদেশ বেসরকারি অনার্স-মাস্টার্স কলেজের শিক্ষক ফোরাম।

ফোরামের আহ্বায়ক নেকবর হোসাইন বলেন, ‘বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের (স্কুল ও কলেজ) জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা-২০১৮’ সংশোধন করে সংশোধিত জনবল কাঠামোতে আমাদের অন্তভু©ক্ত করা না হলে আমাদের আত্মহত্যা করা ছাড়া অন্য কোনো উপায় থাকবে না। সেক্ষেত্রে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সব বেসরকারি কলেজে ক্লাসসহ সব পরীক্ষা বর্জন করে আমরা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে লাগাতার অবস্থান কর্মসূচি পালন করব এবং আগামী ৪ ডিসেম্বর থেকে জেলায় জেলায় মানববন্ধন ও স্মারকলিপি পেশ করব।

এদিকে বেসরকারি উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজ শিক্ষকদের অবসর সুবিধাবোর্ড ও কল্যাণ ট্রাস্টের পরিবর্তে শিক্ষক-কর্মচারীদেরকে পূর্ণাঙ্গ পেনশন চালুকরণ, পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা ও মেডিক্যাল ভাতা দেয়ার দাবিও জানিয়েছেন বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির নেতারা।

বেসরকারি উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজ শিক্ষকদের পদোন্নতিতে অনুপাত প্রথা বাতিলের দাবি জানিয়েছেন তারা। একইসাথে শিক্ষাব্যবস্থা সরকারিকরণের লক্ষ্যে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক ও সহকারী প্রধান শিক্ষকদের বেতন সরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক ও সহকারী প্রধান শিক্ষকদের অনুরূপ স্কেলে দেয়ার দাবি জানিয়েছেন তারা।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।