বিশ্ব্যাংকের নতুন এক প্রতিবেদন অনুযায়ী দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। কিন্তু গত সপ্তাহেই ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের আরেক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অর্থনীতি বেশ নাজুক চিত্র উঠে আসে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের সম্মেলনে অংশ নেয়ার সপ্তাহখানেক পরেই ‘গ্লোবাল কমপিটিটিভনেস রিপোর্ট ২০১৯’ প্রতিবেদন প্রকাশ করল সংস্থাটি।

প্রতিবেদনটি বলছে, বিশ্বের ১৪১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০৫। কিন্তু গত বছরই এই তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১০৩।

যে খাতগুলোতে নাজুক বাংলাদেশ : গত বছরের তুলনায় সঙ্ঘবদ্ধ অপরাধ, খুন, সন্ত্রাস ও পুলিশের ওপর আস্থা ও নির্ভরশীলতা- এসব নিরাপত্তা ইস্যুতে পিছিয়ে পড়েছে বাংলাদেশ। আর পুলিশের ওপর আস্থা ও নির্ভরশীলতায় দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে তলানিতে আছে দেশটি। অন্য দিকে বিচারিক স্বাধীনতা বা বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা বলতে কোনো দেশের সরকার, ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বিচারব্যবস্থাকে কতটা প্রভাবিত করতে পারে তা বোঝানো হয়েছে। এক্ষেত্রে গতবারের স্কোর ছিল ৩৮ (১০০-এর মধ্যে)। আর দেশভিত্তিক অবস্থান ছিল ৯৩তম। আর এ বছর ৩৫.২ স্কোর নিয়ে অবস্থান ৯৬তম। এটিও দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিন্ম।

নিয়োগ-বরখাস্ত ও শ্রমিক অধিকার : শ্রমিকদের সুযোগ-সুবিধা এবং নমনীয়তা- এসব বিষয়কে শ্রমবাজারের আওয়তায় এনে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। গত বছর ১১৫তম অবস্থান থেকে এ বছর ১২১ অবস্থানে এসে ঠেকেছে। শ্রমিকদের নিয়োগ ও বরখাস্ত করা কতটা সহজ সেই প্রশ্নে এবার ২৫ ধাপ পিছিয়েছে বাংলাদেশ।
শ্রমিক অধিকার প্রশ্নে সতেরো ধাপ পিছিয়ে এসে ঠেকেছে ১০৯তম অবস্থানে।

নাজুক ব্যাংকিং ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা : প্রাইভেট সেক্টরের জন্য বাণিজ্যিক ব্যাংকের আর্থিক সহায়তা, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের অর্থসংস্থান, উদ্যোক্তাদের জন্য মূলধনের প্রাপ্যতা, বীমা সুবিধা এবং ব্যাংকিং খাতের অবস্থা ও স্থিতিশীলতা- এই সূচকে গত বছর থেকে তিন ধাপ পিছিয়েছে বাংলাদেশ। তবে স্কোর সামান্য [৫২.৮ থেকে ৫২.১] উন্নতি হয়েছে। ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনা, ক্রেডিট গ্যাপ, ব্যাংকঋণ ইত্যাদি সূচকে আফ্রিকার দেশ মালি বা ঘানা থেকেও নিচে অবস্থান করছে বাংলাদেশ (১২৯তম)। এক্ষেত্রে ব্যাংকিং খাতের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার বিষয়ে বাংলাদেশ একদমই দুর্বল বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।

রিপোর্টার্স উইদআউট বর্ডার্সের ‘ওয়ার্ল্ডস প্রেস ফ্রিডম ২০১৯’ সূচক থেকে তথ্য নিয়ে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, দক্ষিণ এশিয়ায় গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সবচেয়ে কম। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৪০টি দেশের মধ্যে এ বছর মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বাংলাদেশের অবস্থান ১২৩তম (স্কোর ৪৯.৩)। আর গত বছর ছিল ১১৯তম (স্কোর ৫১.৪)। অবশ্য রিপোর্টার্স উইথআউট বর্ডার্সের মূল ইনডেক্সে ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ এখন ১৫০তম। দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল সর্বশেষ ২০১৮ সালে যে প্রতিবেদন দিয়েছিল, তাতে ২৬ স্কোর নিয়ে বাংলাদেশ এবং উগান্ডা একই অবস্থানে (১২৫তম)। আর গত বছর ২৮ স্কোর নিয়ে ১২০তম অবস্থানে ছিল বাংলাদেশ।

কপিরাইট বা বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি কতটা সুরক্ষিত সেই প্রশ্নেও বেশ তলানিতে বাংলাদেশ। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের জরিপে ২০১৮ সালে ৩৯.২ স্কোর নিয়ে ১১৯তম অবস্থানে ছিল বাংলাদেশ। আর এ বছর স্কোর কমে দাঁড়িয়েছে ৩৬.৬, অবস্থান ১২৫এ।

সেবাখাত নিন্ম মুখী : যোগাযোগ অবকাঠামো এবং বিদ্যুৎ-গ্যাস-পানির মতো সেবা খাতগুলোর অবকাঠামো পর্যালোচনা করে বলা হচ্ছে এসব ক্ষেত্রেও বিশেষ ভালো অবস্থানে নেই বাংলাদেশ। ১৪০টি দেশের মধ্যে দুটোতেই অবস্থান ১০০-এর নিচে।

সড়ক, রেল ও বিমান যোগাযোগ ব্যবস্থায় গতবছর থেকে মোটামুটি সন্তোষজনক হলেও সড়কে সবচেয়ে বেশি খারাপ অবস্থান (১২৪তম)। আর সেবাখাতে গতবছর থেকে আরো নিচে নেমেছে [১০৯ থেকে ১১৩তম অবস্থানে] দেশটি। এক্ষেত্রে পানি ব্যবস্থাপনার প্রশ্নে সবচেয়ে বেশি অবনমন হয়েছে। নিরাপদ পানির প্রাপ্যতা এবং পানি সরবরাহের উপর নির্ভরশীলতা, এই সূচকে গতবছর ১১৬তম অবস্থানে থাকলেও এবারের অবস্থান ১২৪এ।

তথ্য-প্রযুক্তি গ্রহণে সক্ষমতা : তথ্য প্রযুক্তিকে কোন দেশে কিভাবে গ্রহণ করা হচ্ছে – তাও তুলে ধরা হয়েছে গ্লোবাল কম্পিটিটিভ ইনডেক্সে। এরমধ্যে রয়েছে মোবাইল টেলিফোন ও ইন্টারনেট ব্যবহারসহ ইত্যাদি। ১৪১টি দেশের মধ্যে গতবছর ৩৯.৮ স্কোর পেয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১০২। আর এ বছর ছয় ধাপ পিছিয়ে অবস্থান ১০৮ (স্কোর ৩৯.১)।
সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা : মুদ্রাস্ফীতি এবং ঋণের বৈচিত্র্য বিশ্লেষণ করে তৈরি করা সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতায় গত বছরের ৮৮তম অবস্থান থেকে ৯৫তম অবস্থানে এখন বাংলাদেশ। ২০১৮ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, মুদ্রাস্ফীতিতে ১০৫ এবং ঋণের বৈচিত্র্য সূচকে ৮০ থাকলে এবার যথাক্রমে ১১৪ এবং ৮৩ অবস্থানে দেশটি। তবে বিশ্বব্যাংক রোববারের প্রতিবেদনে বলেছে, শক্তিশালী সামষ্টিক অর্থনীতি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বা জিডিপি ৭ শতাংশের উপর রাখতে সহায়তা করছে।

গ্রাজুয়েটদের মান, শ্রেণিকক্ষে পাঠদান : মাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে বের হওয়া শিক্ষার্থীরা দেশের বিভিন্ন ব্যবসায়িক বা অর্থনৈতিক কাজের জন্য যে দক্ষতা প্রয়োজন তার কতটা অর্জন করতে পারে- এমন প্রশ্নে ৩৯.৯ স্কোর নিয়ে ১২৩এ ঠেকেছে বাংলাদেশের অবস্থান। এখানে গত বছর দেশটির অবস্থান ছিল দুই ধাপ উপরে। এবারেরটা দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিন্ম তো বটেই, এমনকি কাছাকাছি যে দেশ নেপালের অবস্থানও ৯৭তম।

কোনো দেশে শিক্ষার্থীদের পাঠদানে শিক্ষকরা কি মুখস্থবিদ্যার উপর জোর দেন নাকি উদ্ভাবনী ও ক্রিটিক্যাল চিন্তাভাবনাকে উৎসাহিত করেন সেই প্রশ্নে বাংলাদেশ আট ধাপ পিছিয়ে এবার ১১৫তম অবস্থানে। এটিও দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিন্ম ।

ব্যবসায় বৈচিত্র্য : আর্থিক সামর্থ্য, ব্যবসা শুরু করার সময় ও উদ্যোক্তা সংস্কৃতি নিয়ে ব্যবসায় বৈচিত্র্য ধারণাটির সূচক অনুযায়ী গত বছরের চাইতে একধাপ পিছিয়েছে বাংলাদেশ। এবারের অবস্থান ১২০।

উদ্ভাবনী সক্ষমতা : বৈচিত্র্যপূর্ণ দক্ষকর্মী, বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে সাহায্য-সহযোগিতা, গবেষণা ও উন্নয়ন এবং বাণিজ্যিকীকরণে কোন দেশ কতটা এগিয়ে সেই সূচকে তিন ধাপ পিছিয়ে এবারের অবস্থান ১০৫।

বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র প্রকাশ, বিশেষ সুবিধা ও বরাদ্দ এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানের নামডাক- এই প্রশ্নে পাঁচ ধাপ পিছিয়েছে বাংলাদেশ। এবারের অবস্থান ৮২।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।