দেশের বিভিন্ন স্থানে বন্যার ভয়াল রূপ নিয়েছে। টানা কয়েক দিনের ভারী বৃষ্টিপাত, পাহাড়ি ও উজানের ঢলের কারণে গত ২৪ ঘণ্টায় উল্লেখযোগ্য অনেকগুলো নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। তিস্তা, ধলাই, সুরমা, যমুনা, শঙ্খসহ বেশ কয়েকটি নদীর পানি প্রবাহিত হচ্ছে বিপদসীমার অনেক ওপর দিয়ে। এতে নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, পঞ্চগড়, বগুড়া, শেরপুর, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বান্দরবানসহ ১৩টি জেলার বন্যা পরিস্থিতি অবনতির দিকে মোড় নিয়েছে।

কোথাও কোথাও বন্যা স্থায়ী রূপ নিতে যাচ্ছে। এরই মধ্যে লক্ষাধিক পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়ায় কয়েক লাখ মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছে। বেশ কয়েকটি জেলায় বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়েছে নতুন নতুন এলাকা। আবার কোথাও ব্যারাজ রক্ষার্থে গেট খুলে দেয়ায় প্লাবিত হয়েছে নিম্ন এলাকা। এ অবস্থায় পানিবাহিত রোগ ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। তবে বন্যা উপদ্রুত এলাকাগুলোতে খাবার ও পানির সঙ্কট দেখা দিলেও সরকারের পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছে ভুক্তভোগী লোকজন।

এ দিকে টানা বৃষ্টি ও জোয়ারের পানিতে চট্টগ্রাম মহানগরীর গতকাল দিনভর নিমজ্জিত ছিল। বাসাবাড়ি ও ব্যবসায় কেন্দ্রতে পানি ঢুকে যাওয়ায় অশেষ ক্ষতির মুখে পড়েছেন সেখানকার লোকজন।

নীলফামারী সংবাদদাতা জানান, তিস্তা নদীর পানি বৃদ্ধির কারণে পুরো জেলার বন্যা পরিস্থিতি আরো অবনতি ঘটেছে। গতকাল বেলা ৩টা থেকে তিস্তা নদীর নীলফামারীর ডালিয়া পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ৩৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। নদীর পানি অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় জেলার ডিমলা ও জলঢাকা উপজেলার ১৫টি চর গ্রামের প্রায় ১০ হাজার পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে বলে জানিয়েছেন সেখানকার জনপ্রতিনিধিরা। এরই মধ্যে অনেক পরিবার তিস্তা ডান তীর বাঁধসহ নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিয়েছেন।

ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুল্লাহ আল মামুন জানান, পরিস্থিতি মোকাবেলায় ব্যারাজের সব ক’টি জলকপাট খুলে রাখা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে আমরা তিস্তা অববাহিকায় হলুদ সঙ্কেত জারি করে মানুষজনকে নিরাপদে সরে যেতে বলেছি। উজানের ঢল অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। যেকোনো সময় লাল সঙ্কেত জারি করা হতে পারে।

কুড়িগ্রাম সংবাদদাতা জানান, জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটেছে। কুড়িগ্রামে ধরলা, ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা ও দুধকুমোর নদীর পানি শনিবার দুপুর থেকে বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে এ চারটি নদীর অববাহিকার চর-দ্বীপচর ও নি¤œাঞ্চল প্লাবিত হওয়ায় কমপক্ষে ২০ হাজার পরিবারের লক্ষাধিক মানুষ এখন পানিবন্দী হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। জেলার স্কুল, বাজার, মাদরাসা, মসজিদ ও মন্দিরের ভাঙন ঠেকাতে পাঁচ হাজার জিও ব্যাগ দেয়া হলেও তীব্র ভাঙন ঠেকাতে হিমশিম খাচ্ছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।

কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুল ইসলাম জানান, শনিবার দুপুর থেকে কুড়িগ্রাম জেলার ছোট-বড় ১৬টি নদ-নদীর মধ্যে ধরলায় ৫২ সেন্টিমিটার, ব্রহ্মপুত্র নদে ৩৯ সেন্টিমিটার, তিস্তায় ৯ সেন্টিমিটার ও দুধকুমোর নদীর পানি বিপদসীমার ৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ভাঙন দেখা দিয়েছে সারডোবে ধরলা নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে। চিলমারীর নয়ারহাট ও অষ্টমীরচর ইউনিয়নের কয়েকটি চরে নদীভাঙনে ৫০টি পরিবার গৃহহীন হয়েছে। কুড়িগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) হাফিজুর রহমান জানান, বন্যা মোকাবেলায় আমাদের পূর্ব প্রস্তুতি রয়েছে। ইতোমধ্যে বন্যাকবলিত উপজেলাগুলোয় ৫০ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এ ছাড়াও দেড় শ’ টন চাল ও তিন লাখ টাকা মজুদ রয়েছে।

চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, ভারী বর্ষণ অব্যাহত থাকায় কিছু কিছু এলাকা ছাড়া পুরো চট্টগ্রাম নগরীই যেন গতকাল শনিবার দিনভর পানি নিমজ্জিত ছিল। বিকেলের দিকে বৃষ্টিপাত থামলেও বেশির ভাগ এলাকা পানি নিমজ্জিত ছিল। হাঁটু পানি, কোথাও কোমর পানিতে তলিয়ে যায় নগরীর মূল সড়ক ও অলিগলি। টানা বৃষ্টির কারণে গত এক সপ্তাহ ধরে পানি নিমজ্জিত অবস্থায় নাকাল হতে হচ্ছে নগরবাসীকে। এ ছাড়া গতকাল পাহাড় ধসে মাটিচাপা পড়া দুইজনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। আহত হয়েছে আরো এক শিশু।

গত ৮ জুলাই ভারী বর্ষণে নগরীর দুই-তৃতীয়াংশ এলাকা পানিতে ডুবে যায়। এরপর থেকে বৃষ্টি এবং জোয়ারের পানিতে প্রতিদিন নির্দিষ্ট কিছু এলাকা প্লাবিত হচ্ছিল। কিন্তু গতকাল ভোর রাত থেকে একটানা মুষলধারের বৃষ্টিতে আবারো পানিতে তলিয়ে যায় নগরীর সিংহভাগ এলাকা। গতকাল সকালে একদিকে ভারী বর্ষণ অন্য দিকে জোয়ারের পানিতে মুহূর্তেই সড়ক-অলি-গলি সয়লাব হয়ে যায় নগরীর অক্সিজেন, মুরাদপুর, বহদ্দারহাট, কাতালগঞ্জ, ২ নম্বর গেট, প্রবর্তক মোড়, চকবাজার, বাকলিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকা, আগ্রাবাদ, হালিশহর, পতেঙ্গা, কালুরঘাট ভারী শিল্পাঞ্চল, নাসিরাবাদ শিল্প এলাকা, চাঁন্দগাও, চাক্তাই-খাতুনগঞ্জসহ বিস্তীর্ণ এলাকা।

নগরীর নিম্নাঞ্চলের বেশির ভাগ বাসার নিচতলায় ও দোকানপাটে পানি ঢুকে পড়ে। নগরের ব্যবসার প্রাণকেন্দ্র চাক্তাই খাতুনগঞ্জও ডুবে আছে। বেশির ভাগ দোকানে পানি ঢুকে পড়ায় ব্যবসায় বিপুল ক্ষতির আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা। এ ছাড়া ওয়াসার মোড়, আগ্রাবাদ সিডিএ, হালিশহর, বন্দরসহ বিভিন্ন স্থানে সড়ক-বাসাবাড়িতে পানি ঢুকে পড়ায় থমকে গেছে জনজীবন। আগ্রাবাদ মা ও শিশু জেনারেল হাসপাতালের নিচতলায় পানি উঠেছে। এ কারণে হাসপাতালের বিভিন্ন কার্যালয় বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। প্রধান সড়কগুলোতে পানি ওঠায় দুর্ভোগে পড়েছেন অফিস-স্কুলগামীরা। শহরজুড়ে তৈরি হয় যানজট। ভারী বর্ষণে ষোলশহরের বন গবেষণা ইনস্টিটিউটের সামনে জলবদ্ধতার কারণে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাটল ট্রেন চলাচল করতে পারেনি।

আবহওয়া অফিস জানিয়েছে, গতকাল শনিবার বেলা ৩টা পর্যন্ত পূর্ববর্তী২৪ ঘণ্টায় ১২২.৪ মিলি মিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এ ছাড়া সকালে অস্বাভাবিক জোয়ারের পানি ও বৃষ্টির পানিতে ভয়াবহ জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। জোয়ারের পানির পরিমাণ ছিল ৪ দশমিক ৬০ মিটার। যা স্বাভাবিকের চেয়ে অন্তত দুই মিটার বেশি।

এ দিকে নগরীর আরেফিন নগর এবং কুসুমবাগ আবাসিক এলাকায় পাহাড় ধসে দুইজন আহত হয়েছে। ধসের পরপরেই স্থানীয়দের সহায়তায় সেনাবাহিনীর একটি টিম এবং ফায়ার স্টেশনের দুটি ইউনিট উদ্ধার অভিযান শুরু করে। ঘটনাস্থল থেকে আহত অবস্থায় শাহানুর আক্তার (৪০) এবং মর্জিনা বেগম (১৮) নামে দুই নারীকে উদ্ধার করা হয়। সম্পর্কে মা-মেয়ে দুজনই পাহাড় ধসের কারণে ঘরে আটকে পড়েছিলেন। শনিবার দুপুর ১২টার দিকে কুসুমবাগ আবাসিক এলাকা সংলগ্ন পাহাড়ধসে তিন বছর বয়সী শিশু নুসরাত শারমিন আহত হয়েছে। তাকে উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

এ দিকে চট্টগ্রাম নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে নিয়োজিত সেনাবাহিনীর ৩৪ বিগ্রেড ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের সদস্যরা মাঠে নেমেছেন। ৬৫ সদস্যের একটি জরুরি রেসপনস টিম ভাগ হয়ে নগরীর জলাবদ্ধতাপ্রবণ এলাকাগুলোতে কাজ শুরু করেন। ফলে দ্রুত সময়ের মধ্যে সড়ক থেকে পানি নামতে থাকে।

সাতকানিয়া (চট্টগ্রাম) সংবাদদাতা জানান, সাতকানিয়ায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। ঘণ্টায় ঘণ্টায় পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় উপজেলার কয়েক লাখ মানুষ বন্যায় পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। বিভিন্ন স্থানে সড়কের ওপর দিয়ে বন্যার পানি প্রবাহিত হচ্ছে। বিশেষ করে বড়দুয়ারা এলাকায় সড়কের ওপর দিয়ে ৩-৪ ফুট উঁচু হয়ে বন্যার পানি প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে পার্বত্য জেলা বান্দরবানের সাথে টানা পাঁচ দিন ধরে সারা দেশের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। সাতকানিয়া সরকারি কলেজসহ অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বন্যার পানি প্রবেশ করায় পাঠদান কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। বন্যাকবলিত এলাকার কয়েক হাজার বসতঘরে বন্যার পানি প্রবেশ করেছে। অনেক পরিবার নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য অন্যত্র ছুটে চলছে। নদীর পানি বৃদ্ধির সাথে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে শঙ্খনদীর ভাঙন। গত ৪ দিনের ব্যবধানে শঙ্খনদীর ভাঙনে সাতকানিয়ার আমিলাইষ ও চরতি এলাকায় ২৬ বসতঘর নদীতে হারিয়ে গেছে। বসতঘর হারানো পরিবারগুলো এখন মানবেতর কাল যাপন করছে। উপজেলার ৯০ ভাগ এলাকার মানুষ বন্যায় পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। সাতকানিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ মোবারক হোসেন জানান, বর্তমানে উপজেলার ৯০-৯৫ ভাগ মানুষ পানিবন্দী অবস্থায় রয়েছে। গতকাল সব এলাকায় বন্যার পানি বৃদ্ধি পেয়েছে।

লালমনিরহাট সংবাদদাতা জানান, অবিরাম বর্ষণ ও ভারতের উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে তিস্তা-ধরলাসহ সব নদীর পানি অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় লালমনিরহাটে সৃষ্ট বন্যা পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়েছে। শনিবার সকাল ৬টা থেকে তিস্তা ব্যারাজ দোয়ানী পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ৫০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হতে থাকে। শুক্রবার গভীর রাতে পানির তোড়ে হাতীবান্ধা উপজেলার গড্ডিমারী তালেব মোড় এলাকায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ এবং শনিবার সকালে বড়খাতা-বিডিআর গেট বাইপাস সড়ক ভেঙে যায়। ফলে হাতীবান্ধা উপজেলা শহরে বন্যার পানি প্রবেশ করে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়। এতে নতুন-পুরনো মিলে অর্ধশতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়ে অন্তত ৪০ হাজার মানুষ পানিবন্দী অবস্থায় রয়েছে।

ভারতের গজল ডোবা ব্যারাজে তিস্তার পানি বিপদসীমা অতিক্রম করায় ওই ব্যারাজের গেট খুলে দেয়ায় ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তার পানিপ্রবাহ বেড়েছে বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন ডালিয়া ব্যারাজ কর্তৃপক্ষ। ফলে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়ে পাঁচ উপজেলার বন্যা পরিস্থিতি চরম অবনতি হচ্ছে। বন্যা দুর্গত এলাকার ফসলি জমি, রাস্তাঘাট তলিয়ে যাওয়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। দেখা দিয়েছে নানা পানিবাহিত রোগ। কয়েক হাজার একর আমন ধানের বীজ তলাসহ অনেক ফসলি ক্ষেত তিস্তার পানিতে ডুবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বন্যায় ভেসে যাচ্ছে শত শত পুকুরের মাছ।

রাঙ্গামাটি সংবাদদাতা জানান, থেমে থেমে অতি ভারী বর্ষণ ও সীমান্ত থেকে নেমে আসা প্রবল পাহাড়ি ঢলে রাঙ্গামাটির চারটি উপজেলার বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। কর্ণফুলীর শাখা কাচালং, মাইনী ও রাইংক্ষিয়ং নদীতে প্রবল বেগে পাহাড়ি ঢল নেমে আসায় কাপ্তাই হ্রদের পানির উচ্চতা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। বর্তমানে কাপ্তাই হ্রদের পানির উচ্চতা বেড়ে ৯৫ এম এস এলে (মীনস সী লেভেল) অবস্থান করছে।

রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ জানায়, ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে বাঘাইছড়ি, লংগদু, বরকল জুরাছড়ি ও বিলাইছড়ির নিম্নাঞ্চলের বাড়িঘর, রাস্তাঘাট ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান পানিতে তলিয়ে গেছে। চার উপজেলায় ২০০ আশ্রয়কেন্দ্রে বন্যাদুর্গত দেড় হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছে।

কমলগঞ্জ (মৌলভীবাজার) সংবাদদাতা জানান, মৌলভীবাজারের ধলাই নদীর পানি বেড়ে প্রতিরক্ষা বাঁধে নতুন ও পুরনো ভাঙন দিয়ে ৫টি গ্রাম বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। এতে ৫০০ পরিবারের মানুষজন পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। শনিবার গভীর রাতে কমলগঞ্জ পৌরসভার রামপাশা এলাকায় বাঁধ ভেঙে গিয়ে ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ড প্লাবিত হয়। এর ফলে এসব এলাকার অনেক ফসলি জমি তলিয়ে গেছে।

কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আশেকুল হক বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত ও পানিবন্দী পরিবারগুলোর মধ্যে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ত্রাণসামগ্রী বিতরণের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।

সুনামগঞ্জ সংবাদদাতা জানান, টানা ৬ দিনের বৃষ্টিতে জেলার বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। সুরমা নদীর ষোলঘর পয়েন্টে বিপদসীমার ৯৪ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। জেলার ৯ উপজেলার প্রায় ১৩ হাজার ঘরবাড়িতে বন্যার পানি প্রবেশ করায় লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী অবস্থায় রয়েছেন। বন্যার কারণে রাস্তা ভেঙে যাওয়ার ফলে জেলার বিভিন্ন উপজেলার সড়ক যোগাযোগ বিছিন্ন রয়েছে।

জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বন্যার্তদের জন্য ৩ লাখ টাকা, ৩০০ টন চাল ও শুকনো খাবার প্রদান করা হয়েছে। সরকারিভাবে ১০টি আশ্রয়কেন্দ্রসহ সব স্কুলকে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে। জেলা শহরের আশপাশ এলাকা ছাড়াও বিশ্বম্ভরপুর, তাহিরপুর, জামালগঞ্জ, দোয়ারাবাজার, দক্ষিণ সুনামগঞ্জ, দিরাই শাল্লা ও ধর্মপাশা উপজেলার নিম্নাঞ্চলের কয়েক শ’ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ২৩৮টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বন্যার পানি প্রবেশ করায় শিক্ষাকার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়েছে।

সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আহাদ নয়া দিগন্তকে বলেন, বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলায় সব ক’টি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে শুকনো খাবার বিতরণ চলমান রয়েছে।

ইসলামপুর (জামালপুর) সংবাদদাতা জানান, টানা বর্ষণ ও উজানের পাহাড়ি ঢলে ইসলামপুরে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। যমুনার পানি বাহাদুরাবাদ ঘাট পয়েন্টে বিপদসীমার ৪৮ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় উপজেলার প্রায় ৪০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে প্রায় ৩০ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। চিনাডুলী-উলিয়ার বাজার ও গিলাবাড়ী-বামনা সড়ক ভেঙে যাওয়ায় ১০ গ্রামের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। বন্যার কারণে অর্ধশতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে।

তাহিরপুর (সুনামগঞ্জ) সংবাদদাতা জানান, সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলায় টানা বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ির ঢলের পানিতে বন্দী হয়ে পড়েছে হাজার হাজার মানুষ। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে বিশুদ্ধ পানি ও খাবার সঙ্কট দেখা দিয়েছে পানিবন্দী পরিবারগুলোতে। গৃহহারা মানুষগুলো আশপাশের বিদ্যালয় কাম বন্যাশ্রয় কেন্দ্রে তাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে আশ্রয় নিচ্ছে।

শ্রীপুর দক্ষিণ ইউনিয়নের ৮নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মিয়া হোসেন বলেন, সরকারিভাবে বন্যাশ্রয়কেন্দ্র খোলা হলেও কোনো প্রকারের ত্রাণসামগ্রী বন্যাশ্রয় কেন্দ্রে এসে পৌঁছেনি। এসব কেন্দ্রে আশ্রয় নেয়া লোকজন খাদ্যের জন্য অপেক্ষা করছে। এ দিকে কিছু কিছু গ্রামে ব্যক্তিগতভাবে অর্থ ও শুকনো খাবার বিতরণ করছেন স্থানীয় ব্যক্তিরা।

পঞ্চগড় সংবাদদাতা জানান, পঞ্চগড়ের তালমা নদীতে নির্মিত রাবার ড্যামের ব্যাগে পানি ঢুকে ফুলে গেছে ১২ ফুট। এতে করে রাবার ড্যামে পানি আটকে উজানে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। ড্যামের উত্তর পাশের হিমালয় বিনোদন পার্কে কোমর সমান পানি জমে পার্কটি দর্শনার্থী শূন্য হয়ে পড়েছে। পানি উঠেছে চা বাগানেও। দ্রুত এ পানি সরে না গেলে এসব চা বাগানের বড় ধরনের ক্ষতি হতে পারে।

তালমা রাবার ড্যাম এলাকার বামনপাড়া গ্রামের বাসিন্দা জুয়েল বলেন, শুক্রবার দুপুর থেকেই ধীরে ধীরে রাবার ড্যামের ব্যাগে পানি ঢুকে সেটি ফুলতে থাকে। বিকেলের মধ্যে ড্যামটি প্রায় ১২ ফুট উঁচু হয়ে যায়। এতে করে ড্যামের উজানে পানি জমা হয়ে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হতে শুরু করে। ডুবতে থাকে আবাদি জমি, চা বাগান ও হিমালয় বিনোদন পার্ক। রাতের মধ্যে হিমালয় পার্কে কোমর সমান পানি জমে যায়।

পঞ্চগড় এলজিইডি নির্বাহী প্রকৌশলী জাহেদুর রহমান মণ্ডল বলেন, কয়েক দিনের অতিবৃষ্টি আর উজানের ঢলে হঠাৎ করেই রাবার ড্যামের ব্যাগে পানি ঢুকে ফুলে গেছে। পানি না কমলে কিছুই করার নেই। পানি কমে গেলে আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

পটিয়া-চন্দনাইশ (চট্টগ্রাম) সংবাদদাতা জানান, ৯ দিনের টানা ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে দক্ষিণ চট্টগ্রামে কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে চরম দুর্ভোগে পড়েছে। এদিকে গত দুই দিন ধরে চট্টগ্রাম-মহাসড়কের উপর দিয়ে পাহাড়ি ঢল প্রবাহিত হওয়ায় যানবাহন চলাচল মাঝে মধ্যেই বন্ধ হয়ে পড়ছে। গত কয়েক দিনের টানা বর্ষণে ও পাহাড়ি ঢলে দক্ষিণ চট্টগ্রামের উপর দিয়ে প্রবাহিত শঙ্খ নদীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়া জেলার পটিয়া, চন্দনাইশ, আনোয়ারা, বোয়ালখালী ও কর্ণফুলী উপজেলার কয়েক লাখ মানুষ কার্যত পানিবন্দী হয়ে মহা দুর্ভোগে পড়েছে।

চন্দনাইশ উপজেলা নির্বাহী অফিসার আ ন ম বদরুদ্দোজা বলেন, উপজেলার উপর দিয়ে ঢলের পানি প্রবাহিত হওয়ায় ৮০ হাজার থেকে এক লাখ মানুষ পানি বন্দী হয়ে পড়েছে। পটিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার হাবিবুল বাসার বলেন, ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে পটিয়া শ্রীমতি খালের বেড়িবাঁধ ভেঙে উপজেলার ৩০টি বসতবাড়ি খালে বিলীন হয়েছে। বাঁশখালী উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোমেনা আক্তার জানান, নদীর ঢলে উপজেলার অধিকাংশ নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে বেশ কিছু পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে।

আনোয়ারা উপজেলা নির্বাহী অফিসার শেখ জোবায়ের আহমেদ বলেন, গতকাল থেকে উপজেলার প্রায় ২০ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। বোয়ালখালী উপজেলা নির্বাহী অফিসার একরামুল ছিদ্দিকী জানান, উপজেলার অধিকাংশ নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে প্রায় অর্ধশত পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের তরফ থেকে পানিবন্দী ও ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে চাল ও খাবার বিতরণ করা হচ্ছে।

বগুড়া অফিস ও সারিয়াকান্দি সংবাদদাতা জানান, পাহাড়ি ঢল ও বৃষ্টিপাতের ফলে বগুড়ায় সারিয়াকান্দিতে যমুনা নদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করেছে। এতে যমুনা ও বাঙ্গালী নদীতীরবর্তী উপজেলার ৯টি ইউনিয়নের নিচু এলাকা ডুবে গেছে। পানির নিচে তলিয়ে গেছে আউশ ধান, আমন বীজতলা ও শাকসবজির খেত।

পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, শনিবার যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ৩ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। তবে বাঙ্গালী নদীর পানি এখনও বিপদসীমার নিচে রয়েছে। পানি বৃদ্ধির ফলে উপজেলার চালুয়াবাড়ী ইউনিয়নের ১৪০টি পরিবার গৃহহীন হয়ে পড়েছে। এ তথ্য জানিয়েছেন চালুয়াবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান শওকত আলী।

চকরিয়া (কক্সবাজার) সংবাদদাতা জানান, অব্যাহত ভারী বর্ষণ ও মাতামুহুরী নদীতে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে প্লাবিত হয়েছে, কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার ১৮টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভার বিস্তীর্ণ জনপদ। উপজেলার ৫০-৬০টি গ্রাম তলিয়ে যাওয়ায় সাড়ে ছয় লাখ মানুষের মধ্যে আনুমানিক ৭০ শতাংশ মানুষ কমবেশি পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। বেশির ভাগ টিউবওয়েল পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় পানিবন্দী মানুষ তীব্র সঙ্কটে পড়েছে বিশুদ্ধ পানীয়জলের। সাথে শুকনো খাবার সঙ্কটও রয়েছে। উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা পানিবন্দী মানুষের কাছে ত্রাণ বিতরণ করছেন। তবে সেগুলো প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল বলে জানিয়েছেন বানভাসী মানুষজন। চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নূরুদ্দীন মুহাম্মদ শিবলী নোমান বলেন, জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে চকরিয়া উপজেলার বন্যাদুর্গত এলাকার মানুষের জন্য শুকনো খাবার বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।

বাসস জানিয়েছে, শেরপুর ও বান্দরবানের বিভিন্ন এলাকায়ও বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে।

টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে চট্টগ্রাম-বান্দরবান সড়কের সাতকানিয়া উপজেলার বাজালিয়া এলাকা তলিয়ে যাওয়ায় সারা দেশের সাথে বান্দরবানের সড়ক যোগাযোগ পাঁচ দিন ধরে বন্ধ রয়েছে। এ ছাড়া বান্দরবান-রাঙ্গামাটি সড়কের বালাঘাটা এলাকায় পাহাড়ি ঢলে সড়ক ডুবে থাকায় রাঙ্গামাটির সাথে বান্দরবানের সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে বলে জানা গেছে। জনপ্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, সাঙ্গু নদীর পানি এখনো বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বান্দরবান-কেরানিরহাট সংযোগ সড়ক এবং অভ্যন্তরীণ রুটগুলো পাঁচ দিন ধরে বন্ধ থাকায় খাদ্যপণ্যের ওপর প্রভাব পড়েছে। সবজি ক্ষেত ডুবে যাওয়া বাজারে দেখা দিয়েছে সবজির সঙ্কট।

বান্দরবানের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) শামীম হোসেন জানিয়েছেন, বান্দরবান পার্বত্য জেলায় ২০ হাজার মানুষ পানিবন্দী অবস্থায় রয়েছে। বরাদ্দ পাওয়া গেছে ৪৫০ টন। তবে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় এলাকাগুলোতে ত্রাণ পৌঁছাতে বেগ পেতে হচ্ছে।

এ দিকে প্রবল বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে শেরপুরের ঝিনাইগাতী উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়নের ১৫টি গ্রামের নি¤œাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এতে পানিবন্দী রয়েছে পাঁচ হাজার পরিবার। প্লাবিত গ্রামগুলোর কাঁচা ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, রোপা আমন ধানের বীজতলা, সবজি, পুকুরের মাছ পানিতে তলিয়ে গেছে। প্লাবিত গ্রামের রাস্তাঘাট, আমন ধানের বীজতলা ও সবজি পানিতে তলিয়ে গেছে। ভেসে গেছে শতাধিক পুকুরের মাছ। এতে গৃহপালিত পশু নিয়ে কৃষক পড়েছেন চরম বিপাকে।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো: হুমায়ুন কবির জানিয়েছেন, ৬৮ হেক্টর জমির রোপা আমন বীজতলা আংশিক ও ৪৪ হেক্টর জমির সম্পূর্ণ এবং ১১ হেক্টর জমির সবজি আবাদ আংশিক ও ৮ হেক্টর জমির সম্পূর্ণ আবাদ ঢলের পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী নবকুমার চৌধুরী জানান, ভোগাই নদী ও ব্রহ্মপুত্র নদের পানি এখনো বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে ভারতে অতিবৃষ্টি হচ্ছে। যার ফলে পানি বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।