নাটোরের সিংড়ার হাতিয়ন্দহ ইউনিয়নের হাতিয়ন্দহ গ্রামে ১৯৭১ সালের গণহত্যার শিকার ২২ শহীদ পরিবারের ভাগ্যে জোটেনি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে আবেদন করার পরও দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন এসব শহীদ পরিবারের সদস্যরা। একই সাথে গণকবরের স্থানে স্মৃতি সৌধ নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিলেও, স্বাধীনতার ৪৯ বছরেও নেই কার্যকর কোন উদ্যোগ। শহীদ পরিবারের ভাগ্যে মিলেছে শুধুই আশ্বাস। শহীদদের স্বীকৃতিসহ গণকবরস্থানে স্মৃতি কমপ্লেক্স নির্মাণের দাবি শহীদ পরিবারসহ এলাকাবাসীর।

এলাকাবাসী সূত্রে জানা যায়, ১৯৭১ সালের ৮ এপ্রিল পাক হানাদার বাহিনী নাটোরের সিংড়া উপজেলার হাতিয়নদহ গ্রামের হিন্দু ধর্মের বিভিন্ন পেশার প্রায় ২৪ জনকে নিজ বাড়ি ও এলাকা থেকে নিয়ে যায় শিতলতলা নামক স্থানে। সেখানে সকলকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে গুলি করে ফেলে রাখা হয়। গুলি খাওয়ার পর দু’জন বেঁচে যান। পাক সেনারা দূরে সরে গেলে তারা গুলিবিদ্ধ অবস্থায় সেখান থেকে পালিয়ে প্রাণে রক্ষা পান। কয়েক ঘন্টা পর পাকসেনারা ফিরে এসে ভোলা কর্মকার, ইন্দু শেখর চক্রবর্তী, গোকুল সরকার, নরেশ কুন্ডু, মাদার দাস, পাঁচু বাদ্যকর, শশধর প্রাং, সুনীল চন্দ্র, রতি কান্ত সাহা, বিশ্বনাথ দাস, হরিদাস রায়, রথীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, সুরেশ সাহা, হারান প্রামানিক, শশী প্রামানিকসহ ২২টি মৃতদেহ একত্রে মাটি চাপা দিয়ে চলে যায়। আশপাশের মানুষ দূরে দাঁড়িয়ে প্রত্যক্ষ করলেও প্রাণভয়ে কেউ কাছে যাওয়ার সাহস পায়নি। স্বাধীনতার পর এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানিত করা হলেও গণহত্যার শিকার এই ২২ শহীদ রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি পায়নি। এসব পরিবারের অনেকেই রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির জন্য মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়ে আবেদন করেন। কিন্তু তারা শুধুই পেয়েছেন প্রতিশ্রুতি। একই সাথে গণকবরের স্থানটিও অযত্নে অবহেলায় পড়ে রয়েছে।

যুদ্ধাহত শতিশ চন্দ্র দাসের ছেলে চিত্তরঞ্জন দাস জানান, তার বাবা শতিশ চন্দ্র দাসকে পাক হানাদাররা বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায়। শিতলতলায় নিয়ে গুলি করে ফেলে রেখে চলে যান বাবাকে। বাবা সেখান থেকে কোন মতে প্রান নিয়ে পালিয়ে আসেন। যুদ্ধ শেষ হলে বাবা বহুদিন বেঁচে ছিল। শেষজীবনে ভিক্ষা করে জীবন ধারণ করেছেন তিনি। বেঁচে থাকতে কোন সরকারি সহযোগিতা পাননি বাবা। আমরা বড় হওয়ার পরে অনেক চেষ্টা করেছি যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় অন্তত তার নাম লেখানোর। কিন্তু নাম উঠেনি, পেয়েছি শুধু আশার বানী। আজ পর্যন্ত কোন মুক্তিযুদ্ধের কোন তালিকায় বাবার নাম উঠেনি। আমরা খুব কষ্টে জীবন ধারণ করছি। সরকার আমাদের দিকে একটু দৃষ্টি দিলে আমরা খুব উপকৃত হই।

আরেক যুদ্ধাহত বলরামের ছেলে জানান, বাবা সেখান থেকে প্রানে বেঁচে এসে অনেক কষ্টে আমাদের নিয়ে জীবন কাটিয়েছেন। তার জীবনকালে তো পেলামই না, মরার পরেও বাবার নামটা তালিকায় উঠলো না। অবজ্ঞা ও অবহেলার কারণে কয়েকটি পরিবার দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যান। কেউ কেউ মৃত্যুবরণ করেছেন। শহীদ এসব পরিবারের অনেকেই রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির জন্য মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়ে আবেদন করেছেন। কিন্তু তারা শুধুই পেয়েছেন প্রতিশ্রুতি।

শহীদ পরিবারসহ স্থানীয়দের অভিযোগ, স্বাধীনতার ৪৯ বছরেও শহীদদের স্বীকৃতি মেলেনি। একই সাথে গণকবরের স্থানটিও অবহেলায় পড়ে রয়েছে। গণকবরের স্থানে স্মৃতি সৌধ নির্মাণের প্রতিশ্রুতিও বাস্তবায়ন হয়নি দীর্ঘদিনে।

স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান মাহবুবুল আলম জানান, কিছু পরিবার মুক্তিযুদ্ধ তালিকাভুক্ত হয়েছেন। আর কিছু শহীদ তাদের কাগজ পত্রের ত্রুটির কারণে তালিকাভুক্ত হতে পারেনি। অনেকে তালিকাভুক্তির জন্য আবেদন করেছেন অনেক পরে। কিছুদিন আগে মুক্তিযুদ্ধা বিষয়ক মাননীয় মন্ত্রী নাটোরে সিংড়ায় এসেছিলেন। আমরা একটা প্ল্যান করে তা মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রনালয়ে প্রেরন করেছি। আশাকরি অল্পসময়ে আমরা বরাদ্দটা পেলে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানে একটা স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করতে পারবো।

নাটোর জেলা প্রশাসক মোঃ শাহরিয়াজ জানান, মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয়েছে বাংলাদেশ। সেই সকল মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণ করার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে এবং প্রশাসনের পক্ষ থেকে আমরা বিভিন্ন উদ্দ্যোগ নিয়েছি এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সেসব স্মৃতি চিহ্নগুলো সংরক্ষণের জন্য বিভিন্ন প্রকল্পও আছে। আমাদের যদি কেউ এমন সুনির্দিষ্ট তথ্য দেয় যে গণকবর আছে, সেটাকে আমরা সংরক্ষণ করব।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।