কালের পরিক্রমায় প্রতি বছরই খুশির বার্তা নিয়ে ঈদের আনন্দ-উৎসবের আগমন ঘটে। এ উৎসব উদযাপনে সব মুসলমানের সমান অধিকার আছে। তাই বিশ্বের সব দেশের ও সব পেশার মুসলমানেরা ঈদ উদযাপন করে থাকেন। নির্দিষ্ট কোনো গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের জন্য ঈদের আনন্দ সীমাবদ্ধ নয়। কিছু লোকের একক আধিপত্যও নাই ঈদের উৎসবে। ঈদের আনন্দ সবার জন্যই অবারিত। ধনীর অট্টালিকায় আর দরিদ্রের জীর্ণ কুটিরেও ঈদের আনন্দ প্রবাহিত। তবে আমাদের জনগোষ্ঠীর বিশাল অংশ কৃষকেরা ঈদের আনন্দ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। এ দেশের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ কৃষিজীবী। কৃষির ওপর নির্ভরশীলের সংখ্যা আরো বেশি। আর কৃষকদের প্রায় সবাই মুসলিম। তাই বাংলাদেশে ঈদের সাথে কৃষি ও কৃষকের গভীর সম্পর্ক থাকাই স্বাভাবিক। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। ঈদের উৎসবে বেশির ভাগ কৃষক থাকেন নিরানন্দ। সামাজিক অবহেলা ও সরকারি বঞ্চনা এর প্রধান কারণ।

আমাদের দেশের কৃষকদের বেশির ভাগই গরিব এবং প্রান্তিক চাষি। তাদের মধ্যে ভূমিহীনের সংখ্যাই বেশি। তারা অন্যের জমি বর্গা নিয়ে চাষাবাদ করেন। এতে তাদের উৎপাদিত ফসলের বেশির ভাগই চলে যায় জমিওয়ালাদের ঘরে। ফলে চাষি পরিবারের সদস্যদের বেশির ভাগ দিন কাটে অনাহারে-অর্ধাহারে। তাই দারিদ্র্যের কশাঘাতে নিষ্পেষিত বাঙালি কৃষকের ঘরে ঈদের যথার্থ আনন্দ পৌঁছে না। বেশির ভাগ কৃষক ও তাদের পরিবারের সদস্যদের ভাগ্যে ঈদের উৎসবে নতুন জামাকাপড় জোটে না। তাদের অনেকেই ঈদের বিনোদন বোঝেন না। তাদের ঘরে ঈদ আসে ধর্মীয় বার্তা নিয়ে। ঈদের উৎসবে আনন্দের চেয়ে ধর্মীয় চেতনাকে তারা বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন। তাই কৃষকের ঈদে আনন্দের চেয়ে ধর্মীয় বিষয় প্রাধান্য পেয়ে থাকে। তারা সারা মাস সিয়াম সাধনার পর ঈদের দিনে মহান আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তারা ঈদের দিনে খুব ভোরে উঠে ফজরের নামাজ আদায়, ঈদগাহে বিশাল জামাতে অংশগ্রহণ, পরস্পরের সাথে কোলাকুলি, আত্মীয়স্বজনের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ প্রভৃতি কার্যাবলি সম্পাদন করেন ধর্মীয় অনুভূতি নিয়ে। ভিনদেশী ও বিজাতীয় সংস্কৃতির খাবারের সমারোহ নয় বরং দেশীয় সংস্কৃতির সেমাই-পায়েস জাতীয় মিষ্টান্ন খাবারকে তারা মহানবী সা:-এর সুন্নত মনে করেন। বাঙালির ঐতিহ্যবাহী গোশত-খিচুড়ি জাতীয় সুস্বাদু-উপাদেয় খাবারের আয়োজন করেন তারা পবিত্র ঈদের দিনে। শুধু সৌজন্য-ভদ্রতা রক্ষার জন্য নয়, বরং আত্মীয়স্বজনের সাথে তারা দেখা-সাক্ষাৎ এবং শুভেচ্ছা বিনিময় করেন পরম মমতা ও আন্তরিকতা নিয়ে। রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধার কিংবা সামাজিক প্রভাব-প্রতিপত্তি বাড়ানোর লক্ষ্যে নয়, বরং ঈদের দিনে কৃষকরা সাধ্যমতো দান-খয়রাত করেন মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে।

সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবী ও অন্যান্য পেশার মানুষেরা ঈদের উৎসবভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পান। অধিকন্তু ঈদ উপলক্ষে সব পেশার লোকজনের বাড়তি উপার্জনের ধুম পড়ে যায়। প্রজাতন্ত্রের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জনগণের পক্ষ থেকে বিশেষ ‘উপরি’ পান! পরিবহন মালিক-শ্রমিকেরা সারা বছরের মন্দা ব্যবসায়ের অজুহাতে ঈদ উপলক্ষে ভাড়া কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেন। দোকানিরাও বিভিন্ন পণ্যের দাম বাড়িয়ে সারা বছরের অতিরিক্ত মুনাফা আদায় করে নেন। ঈদের চড়া দামে দর্জি দোকানে প্রবেশ করাই দায়। এ ছাড়া পবিত্র ঈদের অতিরিক্ত খরচ বহন করতে ‘ঈদ সালামি’ আদায়ের নামে আইনশৃঙ্খলায় নিয়োজিত সদস্যরা হয়রানির মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। বিভিন্ন স্তরের কর্মচারীরা ঈদ উপলক্ষে বিশেষ ‘বখশিশ’ পান। ঈদ উপলক্ষে ডাকাত-ছিনতাইকারীরাও অপরাধের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়! এমনিভাবে প্রায় সব পেশার লোকজনের ঈদ উপলক্ষে অতিরিক্ত অর্থ উপার্জিত হয়। কিন্তু সবার অন্ন জোগানদাতা কৃষকের ভাগ্য অপরিবর্তিতই থেকে যায়। ঈদ উপলক্ষে তারা সরকারি-বেসরকারি সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়। পরম যতœ-স্নেহে লালন করা গবাদি পশু, হাঁস-মুরগি বিক্রি করে তারা ঈদ উৎসবের প্রয়োজন মেটানোর চেষ্টা চালায়। কিন্তু মধ্যস্বত্বভোগী দালাল চক্রের প্রতারণায় সহজ-সরল কৃষকেরা যথার্থ মূল্য ও ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। এভাবে ঈদের পবিত্র উৎসব উদযাপনে কৃষকেরা বরাবরই উপেক্ষিত থেকে যায়।
ঈদ উপলক্ষে সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানে কয়েক দিনের সাধারণ ছুটি দেয়া হয়। কিন্তু ঈদের দিনেও কৃষকদের মাঠে কাজ করতে হয়। অন্যান্য পেশায় নিয়োজিত লোকজন ছুটি ভোগ করতে পারলেও কৃষকের ভাগ্যে কোনো ছুটি জোটে না। কাজ না করলে তাদের সংসার চলে না। এ জন্য ঈদের নামাজ শেষে তাদের মাঠে বেরিয়ে পড়তে হয় রিজিকের সন্ধানে। একই ভাগ্যবরণ করতে হয় রিকশা-পরিবহন শ্রমিক ও দিনমজুরদের। এ কারণে কৃষক-দিনমজুরেরা বঞ্চিত হন ঈদের যথার্থ আনন্দ উপভোগে।

ঈদ উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও রাজনৈতিক নেতারা, বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ঈদ শুভেচ্ছাবিনিময় অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। এতে পদস্থ কর্মকর্তা, রাজনৈতিক হোমড়া-চোমড়া, সমাজের বিশেষ ব্যক্তি, ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার লোকজনকে আমন্ত্রণ জানানো হলেও কোনো কৃষককে আমন্ত্রণ জানানো হয় না। অবশ্য যারা কখনো হাতে লাঙ্গল ধরেননি, ধান কাটতে মাঠে নামেননি, যাদের গায়ে কখনো মাঠের কাদা লাগেনি এমন কিছু শঠ-প্রতারক নিজেদের কৃষক প্রতিনিধি পরিচয় দিয়ে এসব শুভেচ্ছা বিনিময়ে অংশ নিয়ে থাকেন। অথচ তারা বোঝেন না কৃষকের দুঃখ-বেদনা, কখনো শোনেননি কৃষকের বুকফাটা কান্না। তারা কখনো এগিয়ে আসেননি কৃষকের ন্যায্য অধিকার আদায়ে বরং দালালি করে বারবার কৃষককে ঠকিয়েছেন। এসব ঠকবাজের কারণে ঈদের দিনেও কৃষকরা উঁচুতলার মানুষদের সাথে সাক্ষাৎ-সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত থাকেন। অন্যদিকে পত্র-পত্রিকা রেডিও-টেলিভিশনসহ বিভিন্ন গণমাধ্যম ঈদ উপলক্ষে চাকরিজীবী ও ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন পেশাজীবীদের সুবিধার্থে বিনোদন কর্মসূচি নির্মাণ ও প্রচার করে থাকে। এতে কৃষকের বিনোদন অনুপস্থিত থাকে। অবশ্য সাম্প্রতিককালে কিছু গণমাধ্যম কৃষকের ঈদ উৎসব নিয়ে বিশেষ বিনোদন কর্মসূচি প্রচার করছে।

প্রকৃতপক্ষে ঈদ মুসলমানদের জাতীয় উৎসব। আর এ উৎসব উদযাপনে সব মুসলমানের সমান অধিকার থাকলেও অবহেলিত ও বঞ্চিত থাকেন বেশির ভাগ কৃষক, যা ঈদ সংস্কৃতির সাথে মোটেও সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, বরং এতে জাতীয় উৎসবের আনন্দ ম্নান হয়। তবে সরকারি পোষকতা ও সামাজিক ন্যায়পরায়ণতা তাদের বঞ্চনা দূর করতে পারে। এতে পুরনো দিনের হিংসাবিদ্বেষ দূর হয়ে মুসলিম সমাজের ঐক্য, সৌহার্দ্য ও ভ্রাতৃত্ববোধ সুসংহত হবে। হ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।