বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলার ১১৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রভাব খাটিয়ে কথিত দুই শিক্ষক নেতা কোটিপতি বনে গেছেন। অভিযোগ রয়েছে এই দু’শিক্ষকের কারণে আজ শরণখোলার প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা জিম্মি হয়ে পড়েছে।

জানা যায়, উপজেলা শিক্ষা অফিসের সাথে যোগসাজশে শিক্ষক বদলি, গাইড বই ধরানো, বিভিন্ন উন্নয়ন তহবিলের অর্থ আত্মসাৎ করে কোটিপতি বনে গেছেন ওই দুই নেতা। তাদের বদলি বাণিজ্যের কারণে উপজেলা সদরের আশপাশের স্কুল গুলোতে ১০/১২ জন করে শিক্ষক-শিক্ষিকা থাকলেও গ্রাম এলাকায় মাত্র দুই-একজন শিক্ষক দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। ফলে প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা বেহাল দশায় পতিত হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শরণখোলা উপজেলার চারটি ইউনিয়নে ১১৪টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এর মধ্যে শুরু থেকে সরকারি হওয়া ৩৪টি স্কুলের সভাপতি হারুন আর রশিদ ও সাধারণ সম্পাদক আলমগীর হোসেন এবং ৭১টি রেজিস্ট্রি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সভাপতি মোল্লা মশিউর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির দায়িত্ব পালন করেন।

পরে ২০১১ সালে রেজিস্ট্রি স্কুলগুলো সরকারি হওয়ার পর ওই দুই সভাপতি অবসরে চলে যান। কিন্তু এরপর থেকে নতুন কোন কমিটি গঠন করা না হলেও আলমগীর হোসেন ও জাকির হোসেন দু’জনই সাধারণ সম্পাদক হিসাবে তথাকথিত শিক্ষক নেতা সেজে প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগ নিয়ন্ত্রণ করে চলছেন। তারা ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের ম্যানেজ করে বিভিন্ন কৌশলে অর্থ বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন। অন্যত্র বদলি বা হয়রানি হওয়ার ভয়ে সাধারণ শিক্ষকরা তাদের বিরুদ্ধে কথা বলতে সাহস পায়না।

উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা গেছে, গত অর্থ বছরে ৮৮টি স্কুলের অনুকূলে ৫০ হাজার করে স্লিপের ৪৪ লাখ, এ ছাড়া ১১৪টি স্কুলে ৪০ হাজার করে রুটিন মেইন্টেইনেন্সের ৪৫ লাখ ৬০ হাজার, ১০ হাজার করে প্রাক প্রাথমিকের ১১ লাখ ৪০ হাজার, দুর্যোগকালীন প্রস্তুতির জন্য পাঁচ হাজার করে পাঁচ লাখ ৭০ হাজার, অন্তঃক্রীড়া প্রতিযোগিতার জন্য ২১ শত করে ২ লাখ ৩৯ হাজার, বঙ্গবন্ধু-বঙ্গমাতা ক্রীড়া প্রতিযোগিতার জন্য ১৫শ’ করে এক লাখ ৭১ হাজার, বিজয় ফুল তৈরি বাবদ দুই হাজার করে দুই লাখ ২৮ হাজার, বই পরিবহনের জন্য চারশত করে ৪৫ হাজার ছয়শ এবং ২৬ টি শিশু বান্ধব স্কুলে ৫০ হাজার করে ১৩ লাখ, ২৫টি স্কুলের ক্ষুদ্র মেরামত খাতে ৫০ লাখ টাকা বরাদ্দ আসে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিক্ষকরা জানান, ওই বরাদ্দ থেকে নাম মাত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে দেয়া হয়। বাকি টাকা শিক্ষক নেতারা সংশ্লিষ্টদের সাথে ভাগ বাটোয়ারা করে নেন। তারা আরো জানান, আত্মসাতের কৌশল হিসাবে ক্ষুদ্র মেরামতের ৫০ লাখ টাকা গত মে মাসে বরাদ্দ আসলেও কাজ না করে ওই টাকা উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার ব্যক্তিগত ব্যাংক হিসাবে জমা রাখা হয়। এরপর শিক্ষক নেতারা টাকা বরাদ্দের জন্য তাদের পছন্দ মতো স্কুলের তালিকা করেন। পরবর্তীতে ওই টাকার কথা কেউ খোজ খবর না নিলে নাম মাত্র খরচ দেখিয়ে দুই শিক্ষক নেতা সংশ্লিষ্টদের নিয়ে তা ভাগ বাটোয়ারা করে নেন। পরে ভুয়া ভাউচার জমা করে দেন সংশ্লিষ্ট দপ্তরে।

এছাড়া প্রতি বছরের জানুয়ারি মাস থেকে বদলির মৌসুমে শিক্ষক নেতারা জেলা ও উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে শিক্ষকদের ইচ্ছা মাফিক বদলি অথবা অনিচ্ছাকৃত বদলি ঠেকাতে মোটা অংকের বাণিজ্যে করে থাকেন। এসময় অনেক ক্ষেত্রে বদলির নিয়মশৃঙ্খলাও মানা হয় না। চলতি বছরে শিক্ষক আমিনুল ইসলাম, হ্যাভেন জাহান, কাজলী রানী, গৌরঙ্গ লাল মিস্ত্রী ,শারমিন আকতার, শামসুন্নাহার, জয়ন্ত রানী, নুসরাত, আখিনুর ও মনিমালাসহ ১০-১২ জনকে মোটা অঙ্কের বিনিময় বদলি করা হয়েছে।

অপরদিকে, সরকার গাইড বই নিষিদ্ধ করলেও শিক্ষক নেতাদের কাছে সেটি বাণিজ্যিক পণ্য হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। প্রতিবছরের শুরুতে ছাত্র-ছাত্রীদের গাইড বই ধরানোর জন্য বিভিন্ন প্রকাশনী সংস্থার কাছে দেন দরবার করেন তারা। যে প্রকাশনী সংস্থা বেশি টাকা দিবেন তাদের গাইড বই নিম্নমানের হলেও ছাত্র-ছাত্রীদের সেই বই ধরানো হয়। বাধ্য হয়ে অধিক মূল্য দিয়ে ওই গাইড বই কিনতে দারিদ্র অভিভাবকদের হিমশিম খেতে হয়। ছাত্র-ছাত্রীদের জিম্মি করে এভাবে তারা লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। এভাবে প্রতি বছর লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়ে কোটিপতি বনে গেছেন ওই দুই শিক্ষক নেতা। আর জরাজীর্ণ অবস্থায় থেকে যাচ্ছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলো।

সাউথখালী ইউপি চেয়ারম্যান মোজাম্মেল হোসেন জানান, তার ইউনিয়নটি উপজেলা সদর থেকে দূরত্ব বেশি হওয়ায় সেখানের স্কুলগুলোতে শিক্ষক স্বল্পতার কারণে লেখাপড়া বিঘ্নিত হচ্ছে। বিষয়টি উপজেলা পরিষদের একাধিক সভায় উত্থাপন করলেও কোন লাভ হয়নি।

রায়েন্দা ইউপি চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান মিলন জানান, সাধারণ শিক্ষকরা তাদের কাছে জিম্মি। বছরের পর বছর এতো দুর্নীতি করেও আজ পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। বরং শিক্ষা অফিস থেকে দুর্নীতির সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়ার জন্য আলমগীর হোসেনকে বারবার উপজেলা শিক্ষা কমিটির সদস্য মনোনীত করা হয়।

এ ব্যাপারে শিক্ষক নেতা আলমগীর হোসেন ও জাকির হোসেন তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, বদলীসহ সরকারি অর্থ বিতরণ ও তদারকির দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট শিক্ষা কর্মকর্তার। তবে শিক্ষকদের অনেক দাবির কারণে আমাদের অফিসে যেতে হয়।

উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আশরাফুল ইসলাম তাদের সম্পৃক্ততার বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে বলেন, শিক্ষকরা আমাদের কাছে কখনো অভিযোগ করে না। এছাড়া তারা মাসিক সভায় উত্থাপন করলে ব্যবস্থা নিতে পারি।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সরদার মোস্তফা শাহীন বলেন, এ বিষয় কিছু কিছু সংবাদ আমি শরণখোলায় যোগদান করেই জানতে পেরেছি। আরো খোজ খবর নিয়ে ঘটনার সত্যতা পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।